তিনি বাংলার নিজের মেয়ে- এটাই প্রমাণ করতে সর্বদা একটা প্রচ্ছন্ন প্রয়াস চালিয়ে গেছেন। শুধু আজ নয়। সালটা ছিল ১৯৭৫। সেই সময় প্রভাশালী নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণের গাড়ি বনেটে উঠেছিলে। সেই সময় তিনি চলে এসেছিলেন। সেই সময় রাজ্যজুড়ে প্রচারও পেয়েছিলেন। তারপর ১৯৮৪ সাল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক জীবনে টার্নিং পয়েন্টও বলা যেতে পারে। যাদবপুর কেন্দ্র থেকে হারিয়েছিলেন সংসদীয় রাজনীতির নক্ষত্র সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে। তবে তারপর পর থেকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। রাজনীতির অলিগলিকে বিচরণ করতে করতে কেটে গেছে প্রায় ৪০টি বসন্ত। বর্তমানে তিনি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। দেশের একমাত্র মহিলা মুখ্যমন্ত্রী। বাংলা ছাড়িয়ে গোটা দেশের কাছেই এখন তিনি দিদি নামে পরিচিত।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক জীবনও কম বৈচিত্রময় নয়। দীর্ঘ ৩৪ বছরের বাম জমানার অবসান ঘটেছিলেন তাঁরই নেতৃত্ব। পরপর দুটি বিধানসভা নির্বাচনে একচ্ছত্র আধিপত্য বজায় রেখতে পেরেছেন তিনি। তবে ২০২১ এর রাজ্যে ভোটের লড়াই কিছুটা হলেও অন্যমাত্রায় পৌঁছেছে। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাতনে এই রাজ্যের বিজেপির উত্থান ও ১৮ জন সাংসদ দিল্লিতে যাওয়ায় রাজ্যের রাজনৈতিক সমীকরণ বর্তমানে অনেকটাই বদলে গেছে। বর্তমানে এই রাজ্যে ত্রিমুখী লড়াই। একদিকে বিজেপি, অন্যদিকে তৃণমূল কংগ্রে। কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও বাম কংগ্রেসের সংযুক্ত মোর্চার জোট বারবারই জানান দিচ্ছে তাঁরা বিনা লড়াইতে মাঠ ছাড়তে নারাজ।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এতটি বাংলায় তিনটি M(এম)কে কাজে লাগিয়ে রাজ করেছেন- মা মাটি মানুষ। কিন্তু বর্তমানে আরও তিনটি M রাজ্যরাজনীতিতে ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছে- মোদী, মমতা আর মুসলিম। এই রাজ্যের মুসলিম ভোট সর্বদাই নির্ণয়ক ভূমিকা গ্রহণ করে। এবারও তার অন্যথ্যা হবে না বলেও আশা করা হচ্ছে। কিন্তু কিন্তু চলতি নির্বাচনে মুসলিম ভোট কতটা মমতার ঝুলিতে পড়বে তাই নিয়েও আশঙ্কা তৈরি করেছেন ফুরফুরা শরিফের পীরজাদা আব্বাদ সিদ্দিকি। বাম-কংগ্রেসের জোটে নাম লিখিয়ে তিনিও মমতার মুসলিম ভোটের সামনে প্রশ্ন চিহ্ন লাগিয়ে দিয়েছে। রাজনৈতিক মহলের ধারনা সেই কারণেই মমতা এবার শুধু মুসলিম নয়, হিন্দু ভোট পেতেও মরিয়া প্রয়াস চালিয়েছেন। একের পর এক জনসভায় মন্ত্র উচ্চারণ করছেন। নিজেকে ব্রাহ্মণ প্রমাণে বারবার চেষ্টা করছেন। মঙ্গলবার নন্দীগ্রামে শেষ নির্বাচনী প্রচারেও নিজেকে সান্ডিল্য গোত্রের বলে জনিয়েছেন জনসভায়।
রাজ্যরাজনীতিতে সর্বদা শিরোনামে থেকেছেন তিনি। বাম জমানায় একের পর এক কর্মসূচি গ্রহণ করে প্রচারের আলো কেড়ে নিয়েছিলেন তিনি। সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম আর চমকাইতলাকে আন্দোলনের মাধ্যমেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিয়ে গিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় প্রচারে। সেই সময় মমতাকে বাংলার অগ্নিকন্যাও বলা হত। সরকারে থেকেই বিরোধী নেত্রীর আচরণ তাঁকে বারবার প্রচারের আলোয় নিয়ে এসেছে।
তবে ২০২১ এর নির্বাচনে এখনও পর্যন্ত প্রচারের সব আলোই শুষে নিতে পেরেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আচমকাই জনসভা থেকে ঘোষণা তাঁর প্রিয় কেন্দ্র ভবানীপুর থেকে নন্দীগ্রামের প্রার্থী হওয়ার কথা। এই কেন্দ্রে বরাবারই অধিকারী পরিবারের দপট বেশি। শুভেন্দু অধিকারী আর শিশির অধিকারীর ওপর ভর করেই দুই মেদিনীপুরে প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিলেন তৃণমূল নেত্রী মমতা। আর সে অতীর। কংশাবতী নদী দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। ডিসেম্বরে শিবির বদল করেন শুভেন্দু ও তাঁর বাবা শিশির অধিকারী সদ্যোই দল বদল করে এখন বিজেপির প্রতিনিধি। এই অবস্থায় নন্দীগ্রামে মমতা ও শুভেন্দুর লড়াই ঘুম ছুটিয়েছে দেশের শীর্ষস্থানীয় প্রচার মাধ্যমগুলিরও। মমতা বনাম শুভেন্দুর লড়াইয়ের কারণেই নন্দীগ্রাম একটি হাইপ্রফাইল কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।
একটা সময় বাজপেয়ীর মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু বর্তমানে তিনি বিজেপির বিরেোধী। ২০১৪ সালের নির্বাচনেই গোটা রাজ্য দেখেছিল মোদী-মমতার বাকযুদ্ধ। ২০১৯ -এর লোকসভা নির্বাচনে মোদীর বিরুদ্ধে আরও সক্রিয় হন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অবিজেপি ও অকংগ্রেসি জোট তৈরিরও একটা চেষ্টা করেন। যদিও তেমন সফল হননি। কিন্তু সেই সময় থেকেই তিনি দেশের কাছে মমতা দিদি হিসেবে পরিচিত হয়েছেন। ভোট পরবর্তী সিএএ, কৃষক আন্দোলনেও সক্রিয় বিরোধী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন তিনি।
ব্যাটেল গ্রাউন্ড নন্দীগ্রামে প্রচারে টক্কর অমিত-মমতার, শুভেন্দুর হয়ে রোডশো কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর ...
১৯৭০ সালে রাজনৈতিক যুব কংগ্রেস কর্মী হিসেবে রাজনৈতিক পথচলা শুরু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। পরবর্তীকালে মহিলী কংগ্রেস ও সর্বভাবরতীয় যুব কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক হন তিনি। ১৯৮৪ সালে লোকসভা নির্বাচন সিপিএম প্রার্থী সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে হারিয়ে সংসদীয় রাজনীতিতে প্রবেশ। পিভি নরসীমা রাও, অটলবিহারী বাজপেয়ী ও মনমোহন সিং-এর মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন তিনি। কয়লা ও খনি, রেল, মানবসম্পদ উন্নয়ন - মন্ত্রকের গুরু দায়িত্ব সামলেছেন তিনি। টাইম ম্যাগাজিকে ১০০ প্রভাবশালীর তালিকায় নাম লিখিয়েছিলেন তিনি।
নিম্ম মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠেএসেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামিক ইতিরাসে স্নাতকোত্তর। রয়েছে আইনের ডিগ্রিও। পুরো সময়ের রাজনৈতিক কর্মী হিসেবেই লড়াই শুরু করেছিলেন তিনি। তবে হাত খরচার জন্য স্টেনোগ্রাফার ও গৃহশিক্ষকতার কাজও করেছেন। আজ মুখ্যমন্ত্রী হয়েও সাধারণ জীবন যাপনের ছবি তিনি তুলে ধরেন। সাদা রঙের সুতির শাড়ি আর হাওয়ায়ই চপি তাঁর ফ্যাশান স্টেটমেন্ট। তবে এখনও মাইলের পর মাইল হাঁটতে ভালোবাসেন মুখ্যমন্ত্রী। কবিতা লেখেন, ছবি আঁকের।