পেশায় একজন হিন্দু পুরোহিত। ঘরে একজন মুসলিমকে ঠাঁই দিলে যজমানদের মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার আশঙ্কা ছিলই। কিন্তু সেসবে আমল দেননি মুর্শিদাবাদের হরিহরপাড়ার এঁদোচোঁয়া গ্রামের সুভাষ রায়চৌধুরী। গ্রামের মাতব্বরদের হুঁশিয়ারি, হুমকিকে উপেক্ষা করেই রাস্তা থেকে সহায়, সম্বলহীন এক স্বামী পরিত্যক্তা মুসলিম গৃহবধূ ও তাঁর দুই নাবালক সন্তানকে তুলে এনে বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছেন তিনি। সুভাষবাবুর পাশে দাঁড়িয়েছে তাঁর পরিবারও।
এর ফলও অবশ্য ভুগতে হচ্ছে সুভাষবাবু এবং তাঁর পরিবারকে। ঘটনার কথা জানাজানি হতেই গ্রামের মধ্যে কার্যত সামাজিক বয়কটের মুখে পড়তে হয়েছে ওই পরিবারকে। চাপ দিচ্ছেন গ্রামের মাথারাও। যজমানরাও মুখ ফিরিয়ে নেওয়ায় উপার্জনে টান পড়েছে। কিন্তু তাতেও নিজের সিদ্ধান্তে অনড় সুভাষবাবু। তাঁর কাছে মানব ধর্মই যে আসল।
সুভাষবাবু যে গৃহবধূকে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছেন, তাঁর নাম সখিনা বিবি। একদিন যজমানের বাড়ি থেকে পুজো শেষ করে বাড়ি ফিরছিলেন সুভাষবাবু। পথে তিনি অসহায় অবস্থায় দুই সন্তানকে নিয়ে সখিনা বিবিকে বসে থাকতে দেখেন। তাঁর সঙ্গে কথা বলে সুভাষবাবু জানতে পারেন, জলঙ্গীর শ্বশুরবাড়ি থেকে স্বামী তাঁকে দুই সন্তান-সহ ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছে। বাপের বাড়িতেও আশ্রয় হয়নি। ঘুরতে ঘুরতে ওই গ্রামে এসে পৌঁছন সখিনা এবং তাঁর দুই সন্তান।
সব শুনে আর এক মুহূর্ত দেরি না করে পুরোহিত সুভাষবাবু সখিনাকে তাঁর দুই পুত্র-সহ নিজের বাড়ীিতে নিয়ে আসেন। সুভাষবাবুর স্ত্রী ইলা দেবী ও তাঁর মেয়ে কাকলি সকলেই একবাক্যে সখিনা ও তাঁর সন্তানদের আপন করে নেন। প্রথম দিকে এই ঘটনা প্রকাশ না পেলেও দু'- একদিনের মধ্যেই গোটা গ্রাম জুড়ে খবর ছড়িয়ে পড়ে। আর তাতেই তেলে বেগুনে রেগে যায় গ্রামীণ মাতব্বরদের দল। এক এক করে অনেকেই সুভাষবাবুর পরিবারকে একঘরে করতে শুরু করে। নিজের সিদ্ধান্তে অনড় সুভাষবাবু বলেন, 'আমার কাছে একটাই ধর্ম, সেটা হল মানব ধর্ম। আমি বিপদে পড়া একজন মা ও তার নাবালক সন্তানদের ঠাঁই দিয়েছি। এটা কোনও অপরাধ হতে পারে না। আমার পুরো পরিবার আমার সঙ্গে আছে।' সুভাষ বাবুর স্ত্রী ইলাদেবী ও মেয়ে কাকলি বাবার কাজে পূর্ন সমর্থন জানিয়ে বলেন, 'একজন অসহায় মহিলা তাঁর সন্তানদের নিয়ে চরম বিপদে পড়েছেন। তার পাশে দাঁড়ানোটাই আসল ধর্ম। তাতে আমাদের কেউ একঘরে করে দিলেও আমরা সিদ্ধান্ত বদলাবো না।সখিনা যতদিন চাইবেন, আমাদের পরিবারের একজন হয়েই থাকবেন।' সুভাষবাবুর পরিবারের একজন হয়ে ওঠা সখিনাও বলেন, 'এখানে আমি আমার সন্তানদের নিয়ে শান্তিতে আছি। ওঁনারা না থাকলে আমার নাবালক ছেলেরা হয়তো না খেয়েই মরে যেত হয়ত। এই পরিবারের কাছে আমি চির ঋণী। এটাও আমরা বাবার বাড়ি বলেই আমি মনে করি।'
গ্রামে একঘরে হতে হলেও সুভাষবাবুর পাশে দাঁড়িয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। হরিহরপাড়ার বিডিও পূর্ণেন্দু স্যান্যাল বলেন, 'সুভাষবাবু ও তাঁর পরিবার যে কাজ করে দেখিয়েছেন, তার কোনও তুলনা হয় না। উনি আমাদের সকলের চোখ খুলে দিয়েছেন। এই পরিবারের পাশে সব রকম ভাবে প্রশাসন থাকবে। যাতে কোনও রকম সামাজিক অপমান বা হেনস্থার মুখে তাঁদের পড়তে না হয়, সে দিকেও আমরা নজর রাখছি।' ইতিমধ্যেই সুভাষবাবু এবং তাঁর পরিবারের সঙ্গে এসে দেখা করে পাশে থাকার আশ্বাস দিয়ে গিয়েছেন কলকাতার প্রাক্তন মেয়র এবং আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য, শিক্ষাবিদ ইমানুল হক- সহ বেশ কিছু বিশিষ্টজন।