Kadambini Ganguly: ঘরে ৮ সন্তান রেখেই ডাক্তারি পড়তে বিলেতে পাড়ি, কাদম্বিনী গাঙ্গুলি ছিলেন ভারত ও দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম মহিলা ডাক্তার

কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়-- এই বাঙালিনীর নাম আজও বিশ্বজুড়ে সোচ্চারে উচ্চারিত হয়। যার গুণমুগ্ধ ছিলেন খোদ ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলও। জন্মেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময়েই। আজও শ্রদ্ধা সহকারে উচ্চারিত হয় কাদম্বিনীর নাম।

 

সমাজের হাজারো চোখ রাঙানি। কি না- একটি মেয়ে- তাও আবার যার ছোট ছোট সব সন্তান এবং স্বামী ঘরে- সে নাকি ঢ্যাং ঢ্যাং করে চলেছে বিলেতে! ডাক্তারি পড়তে! কাদম্বিনীর ডাক্তারি পড়া নিয়ে এমন ছিল সমাজের লাল চক্ষু। যদিও, কাদম্বিনীর সামনে এই সব লাল চক্ষুর কোনও বাধাই ছিল না, কারণ তিনি নিজেই কোনও দিন এই সব বিধিনিষেধকে পাত্তা দেননি। একবার রক্ষণশীল বাংলা পত্রিকা বঙ্গবাসী পরোক্ষভাবে কাদম্বিনী সম্পর্কে খারাপ ভাষা প্রয়োগ করে প্রতিবেদন ছেপেছিল। সমাজের রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে বরাবর লড়াই করে আসা কাদম্বিনী বঙ্গবাসী পত্রিকার সম্পাদক মহেশচন্দ্র পালের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন। আদালতের রায়ে মহেশচন্দ্র পালকে ১০০ টাকা জরিমানা দিতে হয় এবং ৬ মাস জেল খাটতে হয়েছিল।

কাদম্বিনী শুধু এই বঙ্গের মহিলাদের গর্ব ছিলেন না, তিনি ভারতবর্ষ এবং দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে তামাম মহিলাবর্গের কাছে ছিলেন অনুপ্রেরণা। কারণ তিনি ছিলেন ভারত তথা দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম মহিলা ডাক্তার। ১৮৮৮ সালে ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলও আমেরিকায় বসে জানতে পেরেছিলেন কাদম্বিনীর কথা। জেনেছিলেন কীভাবে এক রক্ষণশীল সমাজের বিরুদ্ধে গিয়ে ডাক্তার হওয়ার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন কাদম্বিনী। নিজের এক বন্ধুকে চিঠিতে কাদম্বিনী সম্পর্কে লিখেছিলেন ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল। সেই চিঠি কাদম্বিনী-র কীর্তিতে এক মাত্রা যোগ করেছে।

Latest Videos

কাদম্বিনীর জন্ম ১৮৬১ সালের ১৮ জুলাই। এর কয়েক মাস আগেই জোড়াসাঁকোতে জন্ম হয়েছিল কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। বলতে গেলে এক্কেবারে সমবয়সী ছিলেন কাদম্বিনী ও রবীন্দ্রনাথ। কাদম্বিনীর জন্ম হয়েছিল বিহারের ভাগলপুরে। তাদের আদি বাড়ি ছিল আধুনা বাংলাদেশএর বরিশালে। ছোট থেকেই পড়াশোনায় চৌখস ছিলেন কাদম্বিনী। সেই সঙ্গে তাঁর উপস্থিত বুদ্ধিমত্তা সকলেরই প্রশংসা পেত।

১৮৭৩ সালে কলকাতায় হিন্দু মহিলা মহাবিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু করেন কাদম্বিনী। পরে নাম বদলে এটি হয় বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয়। এর বছর দুয়েক বাদে এই বিদ্যালয় বেথুন স্কুলের সঙ্গে মিশে যায়। বেথুনে কাদম্বিনীর সহপাঠিনী ছিলেন চন্দ্রমুখী বসু। একই সঙ্গে দুই বান্ধবী এন্ট্রান্স পরীক্ষায় পাশ করে নজির স্থাপন করেন। তাঁরাই প্রথম মহিলা যারা এন্ট্রান্সের গণ্ডী পার করেছিলেন। ১৮৮৩ সালে চন্দ্রমুখী রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এবং কাদম্বিনী অঙ্কে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এতে সমাজে আলোড়ন পড়ে যায়। কারণ ব্রিটিশ শাসনকালে তাঁরা দুজনে ছিলেন প্রথম মহিলা গ্র্যাজুয়েট। কাদম্বিনী ও চন্দ্রমুখী-কে নিয়ে কবি হেমচন্দ্র লিখে ফেললেন কবিতা। এই দুজন মহিলা গ্র্যাজুয়েটকে দেখতে বেথুন কলেজের গেটে এক ভিড় হয়েছিল যে পুলিশকে লাঠি চালাতে হয়েছিল।

গ্র্যাজুয়েট হয়ে কাদম্বিনী ভর্তি হন মেডিক্যাল কলেজে। ততদিনে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন কাদম্বিনী। বিয়ে করেছেন পিসতুতো দাদার বন্ধু পেশায় শিক্ষক দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়কে। কাদম্বিনী তখন ২১ বছরে, আর ৩৯ বছরের দ্বারকানাথ বিপত্নীক। ঘরে একাধিক মা-হারা সন্তান। সমাজের রক্তচক্ষুর সামনে কাদম্বিনীকে সমানে সাহস জুগিয়ে গিয়েছিলেন স্বামী দ্বারকানাথ। আর ছিলেন অবশ্যই কাদম্বিনীর পিসতুতো দাদা এবং বাবা।

১৮৮৬ সালে কাদম্বিনী চিকিৎসা বিদ্যায় জিবিএমসি বা গ্র্যাজুয়েট অফ বেঙ্গল মেডিক্যাল কলেজের স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৮৮৮ সালে চিকিৎসা বিদ্যায় আরও ডিগ্রি লাভের উদ্দেশে বিলেতে পাড়ি দেন কাদম্বিনী। বেঙ্গল মেডিক্যাল কলেজ থেকে বেরিয়ে মাঝে আবার লেডি ডাফরিন হাসপাতালে মাসিক ৩০০ টাকায় কাজও করেন তিনি। কাদম্বিনী যখন বিলেতে পাড়ি দেন ঘরে তখন তাঁর অষ্টম সন্তান এক্কেবারে দুধের শিশু। কিন্তু স্বামী দ্বারকানাথ জোর করেই কাদম্বিনীকে বিলেতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।

বিলেতে ৩ মাসে তিনটি ডাক্তারি ডিপ্লোমা অর্জন করে সবাইকে অবাক করে দেন কাদম্বিনী। এরপর যখন তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন তখন তাঁর ছোট ছেলে তাঁকে চিনতেই পারেনি। দুঃখ ভুলে কাজে নেমে পড়েছিলেন কাদম্বিনী।

রোগীর রোগ সারানোতে যেমন তিনি নিপূণভাবে ডায়গোনেসিস করতেন, তেমনি নিপূণ দক্ষতায় রোগীর অস্ত্রোপচারও করতেন। পোয়াতি মহিলাদের প্রসবে তাঁর হাত ছিল অসামান্য। অন্যদিকে আবার অবসরে ঘরে বসে নিপূণ দক্ষতায় কাপড়ের উপরে এমব্রয়ডারি করে যেতেন। বলতে গেলে সর্বগুণ সম্পন্না। সেই সময় বাঙালি মহিলারা তাদের রোগ সারানোর জন্য কাদম্বিনীর পথ চেয়ে থাকতেন। এরা কিছুতেই ব্রিটিশ পুরুষ ডক্টরদের দেখাতে চাইতেন না। যার ফলে বলতে গেলে বহু ব্রিটিশ চিকিৎসকের পেটে কিলও মেরে ছিলেন কাদম্বিনী। নামমাত্র অর্থে তিনি রোগী দেখতেন। অসহায়, গরীবদের কাছ থেকে কোনও অর্থ আবার নিতেন না।

১৮৮৯ সালে বোম্বতে কংগ্রেসের পঞ্চম অধিবেশনে প্রথম যে ছয় নরী প্রতিনিধি হিসাবে নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্য অন্যতম ছিলেন কাদম্বিনী। ১৯১৪ সালে কলকাতায় সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের অধিবেশনে সভাপতির দায়িত্বও পালন করেছিলেন কাদম্বিনী। এই সভা মহাত্মা গান্ধীর সম্মানে আয়োজন করা হয়েছিল। চা-বাগানের শ্রমিকদের উপর ব্রিটিশদের অত্যাচার এবং অন্যায়ভাবে তাঁদের অসমের চা-বাগানে কাজ করানোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে সোচ্চার হয়েছিলেন কাদম্বিনী। কবি কামিনী রায়ের সঙ্গে ১৯২২ সালে বিহার এবং ওড়িশায় নারী শ্রমিকদের অবস্থা তদন্ত করতেও গিয়েছিলেন।

কাজ ছাড়া কিছুই বুঝতেন না কাদম্বিনী। আর সেই সঙ্গে পরিবার ও সন্তানদের দেখভালে ছিল সদা নজর। ১৯২৩ সালের ৩ অক্টোবর রোগী দেখে বাড়ি ফিরছিলেন। রাস্তায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে প্রয়াত হন বাংলা ও বাঙালির গর্ব এবং দেশ ও মহাদেশের অনুপ্রেরণা কাদম্বিনী বসু গঙ্গোপাধ্যায়।

Read more Articles on
Share this article
click me!

Latest Videos

হঠাৎ করে TMC নেতারা পুলিশের বিরুদ্ধে কেন? কী উদ্দেশ্যে? প্রশ্ন অগ্নিমিত্রার | Agnimitra Paul
Naihati-তে কার পাল্লা ভারী? ফল ঘোষণার আগে উত্তেজনা তুঙ্গে গোটা এলাকায় | Naihati By Election Results
ট্যাব কেলেঙ্কারির প্রতিবাদে শিক্ষকদের জোরদার বিক্ষোভ! দাবি সঠিক তদন্তের! | Bengal Tab Scam
'কয়লার ৭৫ ভাগ তৃণমূলের (TMC) পকেটে যায়' বিস্ফোরক অভিযোগ শুভেন্দুর (Suvendu Adhikari)
Bear Rescue Operation | বরফের মধ্যে ভাল্লুকের প্রান বাঁচাল ভারতীয় সেনা, দেখুন দুঃসাহসিক ভিডিও