'রাজা তোর কাপড় কই!' নীরেন্দ্র নাথ চক্রবর্তীর উলঙ্গ রাজা কবিতার সেই সারমর্ম যেন উঠে এল পুরুলিয়ার কোটশিলার বেগুনকোদর গ্রাম পঞ্চায়েতে। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী-র এই উলঙ্গরাজার অনুপ্রেরণা ছিল লিও টলস্টয়ের দ্য নেকেড কিং। কাহিনির সারমর্ম ছিল যে রাজার রাজ্য পরিচালনা এবং চিন্তা-ভাবনা কতটা নগ্নরূপ ধারণ করেছে তা তুলে ধরা। সেই সঙ্গে রাজার তোষামোদকারীদের স্থীরবুদ্ধি ও পদলেহনের ছবিটাকেও পরিস্কার করে দেওয়া। যেখানে একটি শিশু পুরো বাস্তব চিত্রটাকে রাজার সামনে তুলে ধরছে। পুরুলিয়ার কোটশিলা-তেও ঘটল এমনই এক ঘটনা। যেখানে স্থানীয় পঞ্চায়েত এবং প্রশাসনের স্থবিরতা ও ধীরগতির বিরুদ্ধে গর্জে উঠে নিজেকে নগ্ন করলেন বেগুনকোদর গ্রামপঞ্চায়েত ছোটু রাজোয়াড়। বেগুনকোদর গ্রাম পঞ্চায়েতের দপ্তরের সামনেই শরীর থেকে খুলে ফেলে দিলেন সমস্ত বস্ত্র। তাঁর একটাই কথা- ' আমার বাড়ি যখন নগ্ন, আমার বাড়ির মহিলাদের বর্ষার হাত থেকে বাঁচতে যখন অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিতে হচ্ছে, আর যেখানে সব জেনেও পঞ্চায়েত নিজেকে অসহায় বলে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করছে, সেখানে সব নগ্নতা যখন সামনে বেরিয়ে আসছে, তাই নিজেকে নগ্ন করে দেওয়া ছাড়া উপায়টা কি!
আরও পড়ুন, ভ্য়াকসিনের নামে অ্যামিকাসিন দিতেন দেবাঞ্জন, কসবাকাণ্ডে ধৃত আরও ৩
পুরুলিয়ার বেগুনকোদর মানেই এক রুখা-শুখার জমির এলাকা। ইতিহাস বলছে এই এলাকার রুক্ষতার সঙ্গে লড়াই করতে করতে কোথাও যেন এখানকার মানুষগুলোর মধ্যেও এক দৃঢ়-কঠিন লড়াকু চরিত্র তৈরি হয়ে গিয়েছে। যারা দিনের পর দিন আর্থিকভাবে পিছিয়ে রয়েছেন তাঁদের মধ্যে এই প্রতিবাদের শরীরিভাষাটা আরও প্রকট। আপাতত শান্ত, পরিশ্রমী এই সব মানুষের দল এমনিতে সাত চড়ে মুখে রা কাটেন না। কিন্তু, যখন তা এক কঠিন পরিস্থিতি সম্মুখে দাঁড় করিয়ে দেয় তখন ছোটু-র মতো লোকেদের গর্জে ওঠা ছাড়া উপায়ান্ত থাকে না।
দিন কয়েক আগেই স্থানীয় পঞ্চায়েত অফিসে গিয়েছিলেন ছোটু। অন্তত একটা ত্রিপলের জন্য কাকুতি-মিনতি। কিন্তু মেলেনি সেই ত্রিপল, যা দিয়ে তিনি তাঁর লড়ঝড়ে হয়ে যাওয়া খড়ের চালের উপর আচ্ছাদন দিতে পারেন। অন্তত বর্ষার হাত থেকে ঘরে জল ঢোকাটা বন্ধ করতে পারেন! পঞ্চায়েতের না- স্বাভাবিকভাবেই আঘাত করে ছোটু-কে। দিনের পর দিন বেগুনকোদর গ্রাম পঞ্চায়েতের পরিচালনা নিয়ে ক্ষোভ জন্মেছে ছোটুদের মতো মানুষদের। কারণ, সরকার বলছে বিনামূল্যে রেশন- অথচ, ছোটুর অভিযোগ, সরকারের দেওয়া চারটি রেশন কার্ড বাড়িতে থাকলেও রেশন মিলছে না তাতে। এর বদলে পঞ্চায়েত থেকে ইস্যু করা একটি সবুজ কার্ডে রেশন দেওয়া হচ্ছে। ঘরে শিশু সন্তানদের ধরে মোট ৬টা প্রাণী। কিন্তু সবুজ কার্ডে মাত্র ১ কিলো চাল ছাড়া আর কিছু মিলছে না। ছোটু জানিয়েছেন, বাধ্য হয়ে বাজার থেকে বেশি দামে চাল কিনতে হচ্ছে। স্থানীয় জঙ্গলে কাঠ, মরা গাছের ডাল-পালা কুড়িয়ে তা বিক্রি করা এবং শ্রমিকের কাজ করে কোনওমতে সংসারের জন্য অন্নের সংস্থান করেন ছোটু। লকডাউনে এই কাজেরও বেহাল দশা। এমতাবস্থায় স্থানীয় পঞ্চায়েতের উদাসীনতায় এখন তিনি ক্লান্ত ও অবশ্রান্ত। তাঁর মতে. এই প্রতিবাদের ভাষা কঠোর না হলে এই পঞ্চায়েতের ঘুম ভাঙবে না।
আরও পড়ুন, 'মোদী ম্যাজিক ফেল', RSS যোগ তুলে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে বিস্ফোরক অধীর
এমনকী ছোটুর অভিযোগ, দীর্ঘদিন আগে আবাস যোজনায় বাড়ি দেওয়া হবে নাম নথিভুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু তার এখন পর্যন্ত কোনও পাত্তা নেই। স্থানীয় পঞ্চায়েত প্রধান শনি চরণ সিং মূড়া-ও স্বীকার করেছেন যে ২০১১ সালে আবাস যোজনায় বাড়ি দেওয়ার জন্য তালিকা তৈরির কাজ শুরু হয়েছিল। সেই তালিকা মেনেই ঘর দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু তাতে ছোটুর নাম আছে কি না তা তাঁর জানা নেই। তবে, ১০ বছর ধরে যে তালিকা রয়েছে তাতে কেন আজও এই প্রকল্পের আওতায় থাকারা ঘর পেয়ে উঠলেন না? এর কোনও সদুত্তর দিতে পারেননি শনি চরণ সিং মূড়া।
আরও পড়ুন, ভাইরাল হওয়া অডিও ক্লিপে অস্বস্তিতে তৃণমূল, তীব্র কটাক্ষ BJP-র
ঝালদা দু'নম্বর ব্লকের আওতাধীন বেগুন কোদর গ্রাম পঞ্চায়েত। ১১ সদস্যের এই গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান সিপিএম-এর। এছাড়াও আরও ২ জন সদস্য রয়েছেন সিপিএম থেকে। উপপ্রধান রয়েছেন বিজেপি থেকে। এখানে বিজেপি-র সদস্য সংখ্যা ৪। কংগ্রেসের ২ জন এবং ফরওয়ার্ড ব্লক ও তৃণমূল কংগ্রেসর ১ জন করে সদস্য রয়েছেন এই গ্রাম পঞ্চায়েতে। জেলা পরিষদের তৃণমূল সদস্য এবং এই এলাকার বাসিন্দা রমেশ সিং ঘাটুয়ালের অভিযোগ, দীর্ঘদিন ধরেই বিজেপি-র সমর্থন নিয়ে এই পঞ্চায়েতে টিকে রয়েছে। এই গ্রাম পঞ্চায়েতের বিরুদ্ধে বহু সময় নানা দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। এলাকার মানুষও সঠিকভাবে পরিষেবা পাচ্ছে না বলে দাবি রমেশের। যদিও, স্থানীয় পঞ্চায়েত জানিয়েছে, ছোটু-র বিষয়টি তাঁরা খোঁজ খবর নিচ্ছেন। তাঁর অভাব-অভিযোগ মেটানোর চেষ্টা চলছে।