Bus Accident- ক্রেন দিয়ে বাস টেনে তুলতেই মিলল একাধিক দেহ, রায়গঞ্জ বাস দুর্ঘটনায় রাতভর উদ্ধার অভিযান

দুর্ঘটনার খবর পেতেই ঘটনাস্থলে ছুটে আসে বিশাল পুলিশবাহিনী। চলে আসে দমকল কর্মীরা এবং জেলা বিপর্যয় মোকাবিলা দল। সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাঁরাও উদ্ধারকাছে হাত লাগায়। সরকারি বাহিনী উদ্ধারকাজ শুরু করার আগেই স্থানীয় বাসিন্দারা অধিকাংশ জীবিত এবং অল্প-বিস্তর জখম যাত্রীদের উদ্ধার করে রাস্তার উপরে নিয়ে আসে। 
 

Asianet News Bangla | Published : Sep 23, 2021 2:28 AM IST / Updated: Sep 23 2021, 08:55 AM IST

কৌশিক সেন, প্রতিনিধি, রায়গঞ্জ- রাত ১টা নাগাদ দুর্ঘটনাগ্রস্থ বাসটিকে (Raiganj Bus Accident) ক্রেন দিয়ে খাড়া করতে সমর্থ হয় পুলিশ (West Bengal Police)। আর বাস খাড়া হতেই আতঙ্কের মাত্রা যেন আরও বেড়ে যায়। কারণ, বাসের যে দিক নয়ানজুলির মধ্যে কাদায় ডুবে গিয়েছিল- সেই দিকে দেখা যায় একাধিক মৃতদেহ (Many Bodies Have been recovered)। হয় এগুলো বাসের বাইরে ঝুলছে না হয় অর্ধেক বাসের ভিতরে এবং অর্ধেক বাইরে বেরিয়ে রয়েছে। পুলিশ, দমকল (Fire Brigrade) এবং বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী (Disaster Management Force)এক এক করে দেহগুলিকে বাস থেকে নামিয়ে নিয়ে আসে। অ্যাম্বুল্যান্সে করে দেহগুলি পাঠানো হয় রায়গঞ্জে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে (Raiganj Medical College Hospital)। নয়ানজুলির কাদা এই মানুষগুলির প্রাণ কেড়ে নিয়েছে তা প্রমাণ স্পষ্ট। কারণ প্রতিটি দেহ কাদায় এক্কেবারে মাখামাখি হয়েছিল। বিশেষ করে যে দেহগুলি বাসের জানলার পাশে বা বাসের বাইরে আটকে ছিল সেগুলির মাথা-মুখ এক্কেবারে কাদায়ে ভরে ছিল। 

 

রাত ২টো পর্যন্ত পুলিশ সূত্রে বাস দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে যে তথ্য পাওয়া গিয়েছে, তাতে ৪ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করা হয়। কোনও শিশু বা মহিলার মৃত্যর খবর জানানো হয়নি। বাসের চালক এবং কন্ডাক্টর ও খালাসিরা জীবীত না মৃত সেই তথ্যও জানায়নি পুলিশ। তবে বাসে সওয়ারি যাত্রীদের কাছ থেকে পাওয়া বয়ানে জানা গিয়েছে, বাসটি ৯৫ শতাংশ আসন ভর্তি ছিল পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে। এদের সকলেরই বাড়ি ঝাড়খণ্ডের পাকুর জেলা থেকে শুরু করে পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলা এবং উত্তর দিনাজপুর জেলার বিভিন্ন এলাকায়। বাসটি পাকুর থেকে পরিযায়ী শ্রমিকদের তুলতে তুলতে মালদহ-রায়গঞ্জ হয়ে বিহারের দিকে যাচ্ছিল। সেখানেও আরও কিছু পরিযায়ী শ্রমিকদের বাসে তোলার কথা ছিল। আপাতত জানা গিয়েছে যে বাসটির গন্তব্যস্থল ছিল লখনউ। যদিও, বাসে থাকা কিছু পরিযায়ী শ্রমিক জানিয়েছেন তাঁরা দিল্লি যাচ্ছিলেন। এরা সকলেই উত্তরপ্রদেশ এবং দিল্লির বিভিন্ন এলাকায় ও লাগোয়া অঞ্চলে পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে কাজ করতেন। কিন্তু, করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ আছড়ে পড়ায় ও লকডাউন ঘোষণা হয়ে যাওয়া বাড়ি ফিরে এসেছিলেন। পুজোর আগে উৎসবের মরসুমে কিছু রোজগারের আশায় এরা ফের পুরনো জায়গায় কাজে ফেরার জন্য বাসটিতে চেপেছিলেন। 

বুধবার রাত সাড়ে দশটা নাগাদ পরিযায়ী শ্রমিক ভর্তি এই বাসটি উত্তর দিনাজপুরের রায়গঞ্জের কাছে রূপাহার-এ নয়ানজুলিতে গিয়ে উল্টে পড়ে। স্থানীয় মানুষই প্রথমে উদ্ধারকাজ শুরু করে। প্রায় তিরিশ মিনিট পরে দমকল এবং একে একে পুলিশ ও বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী ঘটনাস্থলে পৌঁছয়। গভীররাতে বাসটিকে ক্রেনের সাহায্যে নয়ানজুলি থেকে একটু টেনে তুলে রাস্তায় আনতে সমর্থ হয় উদ্ধারকারী বাহিনী। এরপরই নয়ানজুলিতে নেমে তল্লাশি অভিযান শুরু করে বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী। নয়ানজুলির গভীরতা সেভাবে ছিল না। কিন্তু কাদার পরিমাণ এতটাই মারাত্মক যে প্রবল ভার নিয়ে বাসের একটা দিক কাদের মধ্যে গেঁথে বসে গিয়েছিল। নয়ানজুলির মধ্যে রাতের অন্ধকারে টর্চ জ্বালিয়ে এবং মোবাইলের আলোয় আহত ও মৃতদের খোঁজে তল্লাশি চালায় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী। কাদার মধ্য়ে আরও কোনও দেহ চাপা পড়ে রয়েছে কি না তা দেখতে বেলচা দিয়ে কাদা খোঁড়া হয়। 

স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, রাত ১০টা ৩০ মিনিটে বাসটি নয়ানঝুলিতে উল্টে যায়। এক বিকট আওয়াজ শুনে লোকজন বাইরে বেরিয়ে আসেন। তারাই তড়ডিঘড়ি উদ্ধারকাজে নেমে পড়েন। জানা গিয়েছে, বাসটি ঝাড়খণ্ডের (Jharkhand) পাকুর জেলা (Pakur District) থেকে পরিযায়ী শ্রমিকদের (Migrate Labour) তুলতে তুলতে রায়গঞ্জের দিকে যাচ্ছিল। বাসটি লখনউ (Lucknow) যাওয়ার কথা ছিল।  সরকারি বাহিনী উদ্ধারকাজ শুরু করার আগেই স্থানীয় বাসিন্দারা অধিকাংশ জীবিত এবং অল্প-বিস্তর জখম যাত্রীদের উদ্ধার করে রাস্তার উপরে নিয়ে আসে। কিন্তু বাসের বের হওয়া দরজা কাদার মধ্যে চেপে পড়ে থাকায় অনুমান করা যাচ্ছিল না ঠিক কতজন মারা গিয়েছেন। পরে পুলিশ ক্রেন নিয়ে এসে কাদের দিকে থাকা বাসের অংশটিকে টেনে তোলে। তখনই দেখা যায় অসংখ্য দেহ বাসের জানলা ও দরজায় আটকে রয়েছে। প্রতিটি দেহই কাদা চেপে যে বসেছিল তা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। অনুমান এই মানুষগুলি উল্টে যাওয়ার বাসের দিকের অংশে এক্কেবারে ছিলেন। যার ফলে নয়ানজুলির কাদায় বাসটি কাত হয়ে আটকে যেতেই এরা তাতে চাপা পড়ে যান।

কৃষ্ণা মণ্ডল নামে এক বাসযাত্রী জানিয়েছেন যে, বাসটি পাকুর থেকে আসছিল। লখনউ যাওয়ার জন্য পাকুর জেলার সোনাঝুড়ি মোড়ের সামসারা গ্রাম থেকে বাসে চেপেছিলেন কৃষ্ণা। তাঁর সঙ্গে তাঁর স্ত্রী ও সন্তানেরা ছিল। নিজে কোনও মতে বাস থেকে বেরিয়ে এলেও স্ত্রী ও সন্তানের কোনও খবর বের করতে পারেননি। তিনি জানিয়েছেন, বাসে ওঠার পর থেকেই দেখেন চালক বেলাগামভাবে বাস ছোটাচ্ছেন। কৃষ্ণার অভিযোগ, চালক মত্ত অবস্থায় ছিলেন। দুর্ঘটনার এক ঘণ্টা আগেই বাসটি একটি ধাবায় রাতের খাবারের জন্য থেমেছিল। সেখানে চালক আকুন্ঠ মদ্যপান করে বলে অভিযোগ কৃষ্ণার। দুর্ঘটনার কিছু সময় আগে বাসের চালক একটি গাড়িকেও  ধাক্কা মেরেছিল বলে কৃষ্ণা অভিযোগ করেছেন। তাঁর অভিযোগ, আচমকাই দেখেই তাদের বাস জলের মধ্যে ডুবে যাচ্ছে। পরে কোনওমতে বাইরে বেরিয়ে এসে কৃষ্ণা দেখেন বাসটি একটি কাদার উপরে একদিকে পাল্টি খেয়ে পড়ে রয়েছে। 
আরও পড়ুন- Bus Accident-নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে নয়ানজুলিতে পরিযায়ী শ্রমিক ভর্তি বাস, হুহু করে বাড়ছে মৃতের সংখ্যা

নয়ানজুলিতে বাস পড়ে গিয়েছে- এই খবর পেতেই ঘটনাস্থলে ছুটেছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা প্রণব রায়। তিনি জানিয়েছেন, তাঁরা গিয়ে দেখেন বাসের একটি জল ও কাদার মধ্যে ডুবে গিয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দারাই বাসের অন্যদিকের জানলা ভেঙে বহু মানুষকে ভিতর থেকে টেনে বের করে। এরপর দমকল বাহিনী এবং বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী এসে আরও কিছু মানুষকে টেনে বার করে। এদের মধ্যে কারওর মাথায়, কারও শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত ছিল। কয়েক জন আবার পায়ে এবং হাতে গুরুতর চোট পেয়েছেন বলেও জানিয়েছেন প্রণব। তাঁরা এমন ৪ শিশুকে উদ্ধার করেছেন যাদের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলেও জানিয়েছেন তিনি।  
আরও পড়ুন- পুজোর আগে সুখবর, রাজ্যে পৌঁছাল ৪০ টন পদ্মার ইলিশ

অসুস্থ ও আহত যাত্রীদের উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানো হয়। পুলিশ জানিয়েছে, রাত ১০টা নাগাদ বাসটি মালদহ-র দিক থেকে আসছিল। সেই সময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে নয়ানজুলিতে পড়ে যায়। পুলিশের প্রাথমিক অনুমান চালক মত্ত অবস্থাতে থাকাতেই দুর্ঘটনা। দুর্ঘটনায় চালক বেঁচে রয়েছেন না মারা গিয়েছেন তা নিশ্চিত করতে পারেনি পুলিশ। এমনকী মৃতের সংখ্যা নিয়েও কোনও চূড়ান্ত তথ্য তারা দেয়নি। দুর্ঘটনাস্থলে থাকার সময় পুলিশের কর্তা সাফ জানিয়ে দেন, এই মুহূর্তে তারা উদ্ধারের কাজে এবং জখম ও আহতদের হাসপাতালে পাঠানোর বিষয়টি চূড়ান্ত করছেন। তারমধ্যে জাতীয় সড়কের মেরামতির কাজ চলছে। এই অবস্থায় দুর্ঘটনাগ্রস্থ বাসটিকে রাস্তার উপরে ক্রেন দিয়ে টেনে নিয়ে গিয়ে রাখার যানজট শুরু হয়। যদিও তড়িঘড়ি দুর্ঘটনাগ্রস্থ বাসটিকে ক্রেন দিয়েই রাস্তার একপাশে করে দেওয়া হয়। 
আরও পড়ুন- চন্দননগরে পুলিশের জালে ৩ ডাকাত, উদ্ধার আগ্নেয়াস্ত্র সহ লক্ষাধিক টাকা

স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, দীর্ঘদিন ধরেই ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক সম্প্রসারণের কাজ চলছে। কিন্তু এত ঢিলে তালে কাজ চলছে যে এইখান দিয়ে চলাচলকারী যানবাহনের ঝুঁকি বাড়ছে। আর এই ঝুঁকির হাত ধরেই এদিন এই ভয়াবহ বাস দুর্ঘটনা বলে মনে করছেন বহু স্থানীয় বাসিন্দারা। চালক মত্ত অবস্থায় থাকায় বাস দুর্ঘটনা ভয়াবহ আকার নিয়েছে বলেও মনে করছেন তাঁরা। 

শ্যামল মণ্ডল নামে এক বাস যাত্রী জানিয়েছেন তিনি রায়গঞ্জের কাছেই ইটাহারের নন্দনগ্রাম থেকে সওয়ারি হয়েছিলেন। তাঁর দিল্লি যাওয়ার কথা ছিল। চালক যে অপ্রকৃতস্থ অবস্থায় ছিল সে কথা জানিয়েছেন শ্যামল। তিনি দিল্লি যাবেন বলে বাসে উঠেছিলেন। পেশায় রাজমিস্ত্রি শ্যামল। তাঁর পায়ে চোট লেগেছে। দুর্ঘটনার পর কোনওমতে বাসের জানলার কাঁচ ভেঙে বাইরে আসেন তিনি। বাসে ঠিক কত জন যাত্রী ছিল তা বলতে পারেননি শ্যামল। তবে তাঁর অনুমান ১০০ বেশি যাত্রী ছিল। এদের মধ্যে বেশকিছু মহিলা ও শিশুরাও ছিল বলে জানিয়েছেন শ্যামল। 

Share this article
click me!