জুতো ব্যবসায়ী থেকে ধর্মপ্রচারক, বাংলায় গদ্য সাহিত্যের জনক উইলিয়াম কেরি

  • জুতোর ব্য়বসায় মন টেকেনি
  • ধর্ম প্রচার করতে চলে এসেছিলেন ভারতে
  • বাংলায় প্রথম গদ্য় লিখেছিলেম উইলিয়াম কেরি
  • হুগলির শ্রীরামপুরে ছাপাখানা খুলেছিলেন তিনি
     

Asianet News Bangla | Published : Aug 18, 2020 7:11 AM IST

তপন মালিক: ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে বেশ কিছু মিশনারি কলকাতায় এসে ভিড় জমায়। ব্যাপারটা যে ব্রিটিশরা খুব একটা ভালভাবে নিয়েছিল তাও নয়। কারণ কোম্পানি তখনও এ দেশে ব্যবসা করতে চাইছিল। তাই ধর্ম প্রচার ঘিরে কোনও সমস্যা তৈরি হোক সেটা কোম্পানি চাইছিল না। ধর্মপ্রচারকরা অনেকেই চলে গেলেন শ্রীরামপুরে। সেই শহরটা তখন ডেনমার্ক সরকারের অধীনে। সে দেশের রাজা ধর্মপ্রচারকদের সাহায্য করতে উৎসাহী ছিলেন।

আরও পড়ুন: ফাঁসির কি ছিল ক্ষুদিরামের শেষ ইচ্ছা, যা পূরণ করেছিলেন তাঁর পাতানো দিদি

আরও অনেকের মতো ইংল্যান্ড থেকে এসেছিলেন উইলিয়াম কেরি। তিনি কাজ করতেন একটা জুতো তৈরির কারখানায়। কিছু দিন পর তিনি বিয়ে করেন জুতো কারখানার মালিকের শ্যালিকাকে। মালিকের মৃত্যু পর তিনিই হয়ে যান মালিক। কিন্তু এই মালিকটির ঝোঁক ছিল ভাষা শেখা ও ধর্ম প্রচার। ব্যবসা চালাতে চালাতেই তিনি শিখে ফেলেন হিব্রু, ইতালিয়ান, ডাচ, ফ্রেঞ্চ আর গ্রিক ভাষা। তাঁর পাণ্ডিত্যের কারণে তিনি একটি স্কুলে পড়াবার জন্যও ডাক পান। তিনি নিয়মিত গির্জায় গিয়ে ভাষণ দিতেন। এরপরই তাঁর মনে হয় পৃথিবীর মানুষকে খ্রিস্টধর্মের পবিত্র আলোকের মধ্যে নিয়ে এসে দীক্ষা দেওয়া উচিত। 

একদিন উইলিয়াম কেরি ধর্ম প্রচারের মহান ব্রত নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। জুতোর ব্যবসা-ট্যাবসা সব গুটিয়ে তিনি একদিন সপরিবারে ভারতে পৌঁছলেন। এখানে এসে পড়লেন মহা সমস্যায়। কোনও মানুষই তাঁর কথা বুঝতে পারে না। মাত্র কয়েকজনের যৎসামান্য ইংরেজি জ্ঞান। কেরি বুঝলেন তাঁকে বাংলা  শিখতে হবে। কিন্তু বাঁচতে একটা কাজ চাই। পেয়েও গেলেন। এক নীলের কারখানায় ম্যানেজার হয়ে সপরিবারে চলে গেলেন মেদিনীপুর। সেখানে কেরি ছ’বছর কাজ করেছেন পাশাপাশি যথেষ্ট বাংলা শিখে ফেলেন। কেবল তাই  নয়, নিউ টেস্টামেন্ট-এর অনুবাদও করে ফেলেন। ইতিমধ্যে তাঁর স্ত্রী ডরোথি বাকি জীবনের জন্য বদ্ধ উন্মাদ হয়ে যান।

আরও পড়ুন: সাহস দিলেন সারা বাংলাকে, ৭২-র নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ বিয়ে করলেন হাঁটুর বয়সী মহিলাকে

কেরি মেদিনীপুর থেকে শ্রীরামপুরে চলে এলেন। তখনও  বিদ্যাসাগরের জন্ম হয়নি। রামমোহনও কেরির থেকে বেশ ছোট। বাঙালিরা তখন বাংলা ভাষাতেই কথা বলে, কিন্তু বাংলা গদ্য ভাষাটা একেবারেই আয়ত্তে ছিল না বলা যায়। ছাপাখানা এসে গেছে, কিন্তু কিছু চিঠিপত্র ছাড়া বাংলা সাহিত্য বলতে পুরনো কালের কবিতা। অথচ পৃথিবীর অন্যান্য অনেক ভাষাতেই গদ্য ভাষায় রচিত হচ্ছে গল্প-উপন্যাস। কিন্তু বাংলায় তা লেখার মতো কেউ নেই।  শ্রীরামপুরে কেরি একটা ছোটখাটো প্রেস চালু করলেন। সেখানে নানা ভাষায় বাইবেল ছাপাচ্ছিলেন। এর মধ্যে তিনি সংস্কৃত, ওড়িয়া ভাষাও শিখলেন। বাংলায় একটা বই রচনা করে ছাপালেন নিজেদের প্রেসে। সে বইটির নাম ‘ইতিহাসমালা’। কিন্তু তা কোনও ইতিহাসের বই নয়। ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যেও রচিত নয়। তাতে ছিল অনেকগুলি ছোট ছোট গল্প। বেশিরভাগই লোককাহিনি। যা সাধারণত লোকের মুখে মুখে ছড়ায়। তবে সেই বই রচনায় তাঁর মুন্সি রামরাম বসুর যথেষ্ট সাহায্য নিয়েছিলেন।

কিন্তু একজন ধর্মপ্রচারক এই গল্পের বই ছাপলেন কেন? শুধু কি বাংলা গদ্যের একটা স্পষ্ট রূপ দেওয়াই তাঁর উদ্দেশ্য ছিল? ‘ইতিহাসমালা’বাংলা ভাষার অন্যতম প্রথম গদ্য গল্পের বই। কিন্তু দুঃখের বিষয় বইটি ছাপা হওয়ার পরই আগুন লেগে প্রেস ও গুদামের অনেকখানি ধ্বংস হয়ে যায়। বিশেষ করে ইতিহাসমালা সমস্ত বইগুলি। কেউ বলেন ওই বইয়ের কিছু কিছু গল্পে নীতিবাগীশদের আপত্তি ছিল, তাদেরই কারও নির্দেশে আগুন লাগানো হয়। যাই ঘটুক বাংলা প্রথম গদ্য সাহিত্য গণ্য হওয়ার মতো বইটির কথা কেউ জানতে পারল না। লং সাহেবের বাংলা মুদ্রিত গ্রন্থের তালিকায় এই বইয়ের নাম নেই। এমনকী কেরি সাহেবের রচনাবলিতেও এই বইয়ের নাম স্থান পায়নি। কোনওক্রমে ইতিহাসমালার বেঁচে যাওয়া দু’চার কপির একটি খুঁজে পেয়ে প্রথম মুদ্রণের একশো ষাট বছর পরে ফাদার দ্যতিয়েন একটি সটীক সংস্করণ প্রকাশ করেন। সেটিও অমিল হয়ে যায়। ফের একটি নতুন সংস্করণ প্রকাশ করে ‘গাঙচিল’। বইটি সম্পর্কে লেখেন চিন্ময় গুহ এবং রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়।

Share this article
click me!