প্রথম প্রদর্শনীতে একটি পোশাকও বিকোয়নি, পরবর্তীতে তিনি হয়ে ওঠেন পুরুষ ফ্যাশেনিস্তা শর্বরী

  • পুরুষদের ফ্যাশন জগতে এক কিংবদন্তি নাম
  • বাংলা ছেড়ে ভারত ও বিশ্ব চাক্ষুষ করেছে তাঁর ফ্যাশন
  • ছোট থেকে বেড়ে ওঠা এক রাবীন্দ্রিক মহলে 
  • পরবর্তীকালে যা তাঁর ফ্য়াশনের একটা সিগনেচার হয়েছিল
     

মিডিয়া রিলেশন কীভাবে করতে তা কোনও দিনই জানতেন না শর্বরী দত্ত। ফলে, তাঁর প্রথম প্রদর্শনীতে মিডিয়া-কেই ডাকেননি। ইচ্ছা ও এক অসামান্য আবেগে পা বাড়িয়েছিলেন পুরুষকে বাঙালি ফ্যাশনে ফ্যাশানেবল করতে। ফলে মিডিয়ায় বিষয়টি তাঁর মাথায় আর রাখা হয়নি। মানুষের সঙ্গে মিশে যাওয়া এবং আন্তরিকতায় ভরিয়ে দেওয়াটা যেন ছিল তাঁর সহজাত প্রতিভা। একবার কারও নাম মনে রাখলে ভুলে যেতেন না। মিডিয়ায় সমস্ত পুরুষ সাংবাদিকরাই হয় তাঁর ভাই, না হয় বন্ধু না হয় সন্তানসম। আসলে এটাই শর্বরী দত্তের সিগনেচার টিউন। এটাই তাঁর ইউএসপি। আর সেই কারণেই তিনি শুধু কলকাতা বা ভারতবর্ষ নয়, বিশ্বের ফ্যাশন ওয়ার্ল্ডেও পুরুষদের ফ্যাশনে এক নাম। বরাবরই বলতেন 'আমি পুরুষদের ফ্য়াশনকেই বেশি করে মাথায় রাখি। মেয়েদের জন্য ডিজাইন করতে হয় বটে, কিন্তু সেটা তেমন কিছু নয়। আসলে মেয়েদেরও খুশি করতে হবে তো।' হাসতে হাসতেই একটা সময় এমনই কথা বলেছিলেন শর্বরী। 

আরও পড়ুনঃ পজিটিভিটির রঙে বুনছিলেন পোশাক, শূণ্য জুড়ে থেকে যাবে শর্বরী দত্তের ভাবনা, দর্শণ, কালেকশন

Latest Videos

যাত্রাটা শুরু হয়েছিল ১৯৯১ সালে। পার্ক সার্কাসে দুম করে একটি প্রদর্শনী করে ফেললেন শর্বরী। যেখানে শুধুই ঠাঁই পেয়েছিল পুরুষদের উপরে ফ্য়াশন করা পোশাক। নানা রঙের ধুতি-র পাড়ে সমস্ত কারুকার্য করা। সঙ্গে বিভিন্ন ডিজাইনে করা পঞ্জাবি। তার উপরে বিভিন্ন মোটিফ। প্রথম প্রদর্শনীতেই যে অভিনব্তের ছোঁয়া দিয়েছিলেন শর্বরী তাতে সন্দেহ ছিল না। অনেকে বাহারি রঙের সব ধুতি আর তাতে করা কাজ দেখে হেসেছিলেন। শর্বরী নিজেই জানিয়েছিলেন, অনেকেই বলেছিল আরে এতো শাড়ির মতো দেখতে। অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন- পুরুষদের আদৌ পছন্দ হবে তো। অথচ, সেই ধুতির খোঁজেই পরে পুরুষরা হয়েছে পাগল। বাঙালি-তো ছেড়়ে দিন, অবাঙালিরা পর্যন্ত শর্বরী দত্তের ডিজাইন করা সেই ধুতি নিতে কলকাতায় ছুটে এসেছেন। ভিড় জমেছে শর্বরীর কলকাতার স্টুডিও-তে। পুরুষদের এমন পাগলপারা ভিড় দেখে কলকাতার একের পর এক পোশাক বিক্রেতা পুরুষদের ফ্যাশনেবল পোশাকের জন্য ছুটে গিয়েছেন শর্বরীর কাছে। এহেন শর্বরী তাঁর প্রথম প্রদর্শনীতে একটি পোশাক কিন্তু বিক্রি করতে পারেননি। সে কাহিনিও ফলাও করে তিনি বলতেন। 

আসলে শর্বরী দত্ত প্রায় তিন দশক ধরে তিলে তিলে পুরুষকে বাঙালি সাজে সাজিয়ে তুলেছেন। একের পর এক ডিজাইন নিয়ে করেছেন পরীক্ষা-নিরিক্ষা। ফ্যাশনের কোনও প্রথাগত শিক্ষা কোথাও নেননি। তাহলে, কী করে সম্ভব হল এক এক অসামান্য প্রতিভার উন্মেষ? বাবা ছিলেন বাংলার প্রখ্যাত সাহিত্যিক অজিত দত্ত। ছোট থেকেই একটা রাবীন্দ্রিক মহলে বেড়ে ওঠা। নৃত্য ও সঙ্গীতে ছোট থেকেই ছিলেন পটিয়সী। নিজস্ব ভাবনার আদলে নৃত্য-নাট্য-কে কীভাবে কোরিওগ্রাফ করতে হয় তা রপ্ত করে ফেলেছিলেন শর্বরী। বোঝাই যায় এই ধরনের প্রয়াস তাঁর সৃষ্টিশীলতাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছিল। পড়াশোনাতেও যথেষ্ট মেধাবী। স্নাতক হন প্রেসিডেন্সি থেকে।  এরপর দর্শন নিয়ে স্নাতকোত্তর সম্মান লাভ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে শর্বরী একাধিকবার বলেছিলেন দর্শনের প্রতি আসক্তি তাঁর মনের ভাবনার পরিধি-কে অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছিল। বহু জিনিসকে তিনি নতুন করে দেখতে শিখেছিলেন। এর সঙ্গে যোগ হয়েছিল বাড়ির রাবীন্দ্রিক হাওয়া এবং নৃত্য ও গানের শিক্ষা। যা তারমধ্যে একটা আবেগ তৈরি করেছিল। যে আবেগেই তিনি তাঁর ফ্যাশনের মধ্যে দিয়ে ফুঁটিয়ে তুলতে পেরেছিলেন। 

আর এই আবেগ আর রবীন্দ্রনাথের প্রতি এক গভীর অনুরাগ তাঁকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল পুরুষদের ফ্যাশন জগতে। ফ্যাশনের সঙ্গে সঙ্গে নিজেরও একটা ব্র্যান্ড তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন শর্বরী দত্ত। এর জন্য তাঁর সবচেয়ে বড় হাতিয়ার ছিল তাঁর নিজের পোশাক। এক বাঙালি গৃহবধূ শাড়ি পরে, গলায়-কানে বড় অলঙ্কার লাগিয়ে, কপালে বিশাল টিপ দিয়ে-- যে ফ্যাশন ডিজাইনার হয়ে নাম করতে পারে তা আগে কেউ ভাবতে পারতো না। বিশেষ করে ফ্যাশন ওয়ার্ল্ডে এই ধরনের সিগনেচার টিউন নব্বই দশকের আগে দেখা যায়নি। এবং অবশ্যই এই সিগনেচার টিউনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তাঁর ব্যক্তিত্ব এবং ঋজুতা। যা তাঁকে অন্যান্য ফ্য়াশন ডিজাইনারদের থেকে আলাদা করে দিয়েছিল। এরপর যাঁরা শর্বরীর কাজ চাক্ষুষ করতেন তাঁদের বাহবা করা ছাড়া অন্য কোনও রাস্তাও থাকতো না। মনে হতে পোশাকের উপরে যেন নক্সা দিয়ে কবিতা এঁকে গিয়েছেন তিনি। তাঁর পিছন পিছন বাংলাদেশের বিবি রাসেলেরও উত্থান ঘটেছিল। কিন্তু, শর্বরীর মতো তিন দশক ধরে কোথায় দাপিয়ে যেতে পারলেন বিবি রাসেল। 

শর্বরীর ফ্যাশনের যেমন নিজেকে সাজিয়ে একাধিক বাঙালি সেলিব্রিটি, তেমনি কলকাতায় এসে শর্বরীর স্টুডিও-তে ভিড় করে গিয়েছিলেন সচিন তেন্ডুলকর থেকে অমিতাভ বচ্চন, অভিষেক বচ্চন, ঐশ্বর্যের মা- বৃন্দা, যিনি আবার ঐশ্বর্যের ভাই-এর জন্য পোশাক নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিবেক ওবেরয় এবং মেয়ে ঐশ্বর্যের জন্যও পোশাক কিনেছিলেন শর্বরীর কাছে। এমনকী, বিদেশে পালিয়ে যাওয়া বিজয় মালিয়াও ছিলেন শর্বরীর একজন নামি-দামি ক্লায়েন্ট। যদিও  সে সময় বিজয় মালিয়া দেশের অন্যতম গণ্যমান্য একজন ব্যবসায়ী। আর্থিক তচ্ছরূপে অভিযুক্ত পলাতক নন। 

শর্বরী বাংলা-র একদিকের চির ঐতিহ্যশালী বুনুনকে যেমন তাঁর ফ্যাশনের অঙ্গ করেছিলেন, তেমনি পোশাকের শরীর জুড়ে ফুটিয়ে তুলেছেন বাংলার বিভিন্ন ঐতিহ্যশালী কারুকলা এবং মোটিফকে। এমনকী তাঁর ফ্যাশনে ফুঁটিয়ে তুলেছেন রাজস্থানী মোটিফের ছোঁয়া থেকে শুরু করে পঞ্জাবী ঘরানা, আফ্রিকান ফোক, মিশরীয় আর্ট থেকে মধুবনী, কালীঘাটের পটশিল্প, রাশি চক্র এবং মকবুল ফিদা হুসেনের আর্ট মোটিফ। 

২০১৬ সালে এক প্রখ্যাত বাংলা দৈনিকের সাংবাদিক দীপান্বিতা মুখোপাধ্যায় ঘোষকে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে বলেছিলেন, 'রঙিন ধুতি তো নতুন নয়। শ্রীকৃষ্ণও পরতেন। পীতাম্বর। হলুদ ধুতি। ক্যালেন্ডারে কৃষ্ণের ছবিতে দেখবেন পীতাম্বর পরানো। বাউল মানেই গেরুয়া। তিরুপতি বা পুরীর মন্দিরে যান। দেখবেন পুরোহিতরা সকলেই রঙিন ধুতি পরেন। তার মানে জিনিসটা রয়েছে। আমরা জানি, কিন্তু নিজেরা পরি না। আমি সেই কাজটাই করছি।' ধুতির ফ্যাশনের ভাবনা কোন স্তরে গিয়ে ভেবেছেন সাক্ষাৎকারের এই লাইনগুলো-তেই স্পষ্ট। আর যার জন্যই শর্বরীর ফ্যাশনে সবধরনের পুরুষরাই ভেসে গিয়েছেন। সে ফ্য়াশনেবল কোনও পুরুষ হন বা আইআইটি পড়ুয়া অথবা সেলিব্রিটি বা সাধারণ চাকুরে, অথবা অল্পবয়ী ছেলে-ছোকরা-যারা সদ্য যৌবনে পা রেখেছেন। শর্বরী মানেই তাই পুরুষদের ফ্য়াশনে এক কিংবদন্তি। যিনি চলে গেলেন এক রহস্যকে সামনে রেখে। কিন্তু, তার কাজ তাঁকে বাঙালির মনের কোলে জাগিয়ে রাখবে- তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

Share this article
click me!

Latest Videos

Suvendu Adhikari Live : বারাসত থেকে বাংলদেশকে চরম আক্রমণে শুভেন্দু অধিকারী
Sukanta Majumdar : BSF-কে লক্ষ্য করে গুলি বাংলাদেশীদের, ক্ষোভ উগরে দিয়ে যা বললেন সুকান্ত
চোখের সামনেই গুঁড়িয়ে পড়লো আস্ত Ranaghat-এর এক বিল্ডিং! আতঙ্কে গোটা এলাকা | Nadia Latest News Today
Suvendu on Firhad : বাঘাযতীনে এসে ফিরহাদ হাকিমকে ধুয়ে দিলেন শুভেন্দু অধিকারী, দেখুন কী বলছেন
১৯৭১ সাল থেকে আর দেখা যায়নি | Socorro Doves | London Zoo | Doves