লকডাউনে খাদ্য বলতে কচুপাতা সেদ্ধ, অন্নের হাহাকারের কান্নায় ১০০টি প্রান্তিক পরিবারের

  • চলছে লকডাউন, কিন্তু অন্নের জন্য হাহাকারে কিছু পরিবার
  • আপাতত কচুপাতা সিদ্ধ করেই চলছে দিনের মতো পেট ভরানো
  • যেটুকু চাল জুটছে তা বাচ্চাদের মুখেই তুলে দেওয়া হচ্ছে
  • মর্মান্তিক এই ছবি মালদহের হরিশ্চন্দ্রপুরের ১ ও ২ নম্বর ব্লকে

'ভানোস এসি গেলা! আর তারপর যা হইলা, তাতে আর কি কইব বাবা! চাল-ডাল যা ছিল সবই ফুরাই গেল। মাঝে পাঁচ কিলো করে চাল দিয়াছিল বটে, খাইয়া-দাইয়া তাও শেষ হয়ে গেল বটে বাবা!'-- এরপর বাকিটুকু কান্না আর এক বৃদ্ধার অন্নের জন্য হাহাকার। কান্নাভেজা কন্ঠে নামটুকুও ঠিক করে বোঝাও গেল না। যেটা বোধগম্য হল তা হল এই মুহূর্তে অর্থাৎ ৫ এপ্রিল বিকেল পর্যন্ত হরিশ্চন্দ্রপুর ১ নম্বর ব্লকের মুশহর, বেদে ও বিনে সম্প্রদায়ের বস্তিতে অন্নের অভাব প্রকট। করোনাভাইরাস কি তা এখানকার অধিকাংশ মানুষ-ই জানেন না। ভাইরাস-কে ভানোস নামেই তাঁরা তাঁদের কাছে পরিচিত করে নিয়েছেন। আর বুঝেছেন এই ভানোসের জন্য তাঁদের রুটি-রুজিতে এখন তালাবন্ধ। আর সেই সঙ্গে তালা পড়ার উপক্রম হয়েছে পেটের অন্ন সংস্থানেও। হরিশ্চন্দ্রপুর ১ নম্বর ব্লকের বাইসা বাগান ও গড়গড়িতে ১০০টি মুশহর, বেদে ও বিনে সম্প্রদায়ের পরিবারের বাস। এদের অধিকাংশের ঘরেই এখন খাবার বলতে কচুপাতা সিদ্ধ এবং সঙ্গে লবণ। 

Latest Videos

 

বস্তির এক যুবক জানালেন, লকডাউনের আগে প্রশাসন থেকে কিছু চাল-ডাল দেওয়া হয়েছিল বস্তিতে। কিন্তু, পরিবার প্রতি পাঁচ কিলো করে পাওয়া সেই চাল ফুরিয়ে গিয়েছে। অনেকের কাছে রেশন কার্ড আছে। তাঁরা মাঝে কিছু ফ্রি রেশন তুলে এনেছিলেন। কিন্তু, পর্যান্ত রেশন পাওয়া যায়নি। যেটুকু রেশন পাওয়া গিয়েছিল তা ভাগ-বটোয়ারা করে নেওয়া হয়েছিল। এখন তাও নিঃশেষিত। ফলত এই মুহূর্তে বনে বাদারে ঘুরে-ঘুরে কচুপাতা সংগ্রহ করা হচ্ছে। আর তাই সিদ্ধ করে খাওয়া চলছে। ১০০টি পরিবারে গড়ে অন্তত ৪ জন করে সদস্য রয়েছে। এদের সকলেরই খাবার এখন কচুপাতা সেদ্ধ। 

 

ওই যুবক-ই জানালেন, কিছু মানুষ এদিক-সেদিকে ভিক্ষের খোঁজে বের হচ্ছে। লকডাউন এবং করোনাভাইরাসের আতঙ্কে ভিক্ষেও ঠিক করে মিলছে না। যেটুকু চাল মিলছে তা রেঁধে বাচ্চাদের দেওয়া হচ্ছে। শুধু ভাত আর সঙ্গে কচুপাতা সিদ্ধ- এই খাবার-ই পরমানন্দে মুখে তুলে নিচ্ছে কচি-কাচাদের দল। যারা একটু বড় তারা বাবা-মা-কাকা-জেঠিমা-দিদামাদের মতোই কচুপাতা সিদ্ধ খেয়েই পেট ভরাচ্ছে। 

 

হরিশ্চন্দ্রপুরের ১ ও ২ নম্বর ব্লকে এমন আরও কয়েক শ' মুশহর, বেদে এবং বিনে সম্প্রদায়ের পরিবার রয়েছে। এদের সকলেরই অন্নের সংস্থানে অভাব তৈরি হয়েছে বলে অভিযোগ। বহু বছর ধরে এই পরিবারগুলি হরিশ্চন্দ্রপুরে ছোট-ছোট কয়েকটি বস্তি গড়ে তুলেছে। এই বস্তি-তে থেকেই এরা রোজকার রুটি-রুজি-র খোঁজে বের হয়। এদের কেউ মাদারির খেলা দেখায়। কেউ আবার বিভিন্ন জড়ি-বুটি বিক্রি করে। কেউ আবার মধু বিক্রি-র পেশার সঙ্গে জড়িত। কেউ আবার সাপ নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে ভিক্ষে করে। কিন্তু লকডাউনেক বাজারে এখন সমস্তটাই বন্ধ। দিন-আনা দিন খাওয়া পরিবারগুলি-র চোখে এখন অন্ধকার। 

এশিয়ানেট নিউজ বাংলার পক্ষ থেকে হরিশ্চন্দ্রপুর ১ নম্বর ব্লকের বিডিও অনির্বাণ বসু-র সঙ্গে কথা বলা হয়। তিনি জানান, এই বিষয়ে খবর তাঁর দফতরে এসেছে। তিনি হরিশ্চন্দ্রপুর থানার আইসি-কে বিষয়টি তদন্ত করতে নির্দেশ দিয়েছেন। রিপোর্ট পেলেই তিনি যথাযথ পদক্ষেপ নেবেন। সেইসঙ্গে তিনি জানিয়েছেন, লকডাউনের পরিবেশে স্থানীয় প্রশাসন হরিশ্চন্দ্রপুরের প্রতিটি মানুষের সঙ্গে রয়েছে। লকডাউনের আগেও এই মানুষগুলির হাতে চাল-ডাল দেওয়া হয়েছিল। যদি দেখা যায় সত্যি তারা অন্নের অভাবে রয়েছেন, তাহলে সর্বোতভাবে তাদের কাছে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া হবে। যদিও, যে ভাবে অভাবের বিষয়টি নিয়ে সংবাদমাধ্যম খবর করছে তাতে লকডাউনের নিয়ম লঙ্ঘিত হয়েছে বলেও তিনি দাবি করেন। তিনি জানিয়েছেন, একসঙ্গে বহু লোককে একসঙ্গে দাঁড় করিয়ে ছবি তোলানো হয়েছে তাতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধের নীতি মানা হয়নি। 

 

ব্লক আধিকারিকে এই অবস্থানে পাল্টা কিছু যুক্তি-ও খাড়া হয়েছে, তাতে স্পষ্টতই দাবি করা হচ্ছে, যে মানুষগুলোর পেটে ঠিক করে খাবার ঢুকছে না, তাঁদের কাছে জীবন-মৃত্যুর মানে কী? ঘরের কোণে থাকা বাচ্চা যখন দুধের জন্য কেঁদে ওঠে তখন অভিভাবকদের কাছে পুষ্টিকর খাবারের সংস্থান বড় না আইসোলেশনের বিধিনিষেধ? ঘটনাস্থলের অধিকাংশ ঘরে-ঘরে যখন একই ছবি- তখন সকলেই গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে কী করে সমস্যার মোকাবিলা করা যায় সেই চেষ্টাই করা হচ্ছে বলেও দাবি করা হয়েছে মাদারিদের পক্ষে থেকে। আর যদি, আইসোলেশন এতটাই কঠোর তাহলে মুশহর, বেদে ও বিনে সম্প্রদায়ের বস্তিতে কী চলছে সে খবর প্রশাসনের কাছে সঠিকভাবে পৌঁছল না কেন? এমন প্রশ্নও উঠেছে। 

অন্নের এই হাহাকারে কোনও রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের দর্শনও মেলেনি বলেও অভিযোগ। স্থানীয় তৃণমূল নেতা থেকে শুরু করে কংগ্রেস, সিপিএম বা বিজেপি-কারোরই কোনও দেখা মেলেনি। মালদহ জেলা ফরওয়ার্ড ব্লকের সাধারণ সম্পাদক শ্রীমন্ত মিত্র জানিয়েছেন, হরিশ্চন্দ্রপুরের মুশহর, বিনে ও বেদে সম্প্রদায়ের মানুষদের এই অবস্থার খবর পেয়ে তিনি তাঁর কিছু প্রতিনিধিদের সেখানে পাঠিয়েছিলেন। তাঁরা কথা বলে এসেছেন এবং তাঁরা চেষ্টা করছেন যদি কোনওভাবে কিছু ত্রাণ এই অভাবি পরিবারগুলির হাতে পৌঁছে দেওয়া যায়। বিষয়টি ফরওয়ার্ড ব্লকের রাজ্য নেতৃত্বকেও জানানো হয়েছে বলে তিনি জানান। রাজ্য ফরওয়ার্ড ব্লকের সাধারণ সম্পাদক নরেন চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন, প্রশাসনের উচিত অবিলম্বে বিষয়টিতে হস্তক্ষেপ করা। সেইসঙ্গে তিনি এমনও অভিযোগ করেন, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় লকডাউনে-র মধ্যে তাঁর কাছে পৌঁছতে একটি ই-মেল আইডি দিয়েছেন, কিন্তু তাতে ই-মেল বহু সময় বাউন্স-ব্যাক করছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন। 

Share this article
click me!

Latest Videos

Viral Video! আবাসের টাকা ঢুকতেই বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাটমানি চাইছেন TMC কর্মী | Murshidabad Latest News
প্রেমের আড়ালে লক্ষাধিক টাকা লুঠ! প্রতারণার নেপথ্যে চাঞ্চল্যকর কাহিনি | South 24 Parganas News Today
‘প্রণামের সংস্কৃতি ভুলে যাচ্ছে বাঙালি’ বিস্ফোরক মন্তব্য Dilip Ghosh-এর, দেখুন কী বলছেন | Dilip Ghosh
'কুমিল্লা ছেড়ে চলে যা' কুমিল্লায় বৃদ্ধ মুক্তিযোদ্ধার গলায় জুতোর মালা! | Bangladesh News |
শীতের রাতে যমুনার আতঙ্ক! একের পর এক জঙ্গল দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বাঘিনী | Bandwan Tiger News