শাড়ি পরে দুর্গাপুজো করেছিলেন শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, রানি রাসমণির বাড়ির পুজোতে এসেছিলেন রবি ঠাকুরও

শতাব্দী প্রাচীন এই পুজোয় অন্যান্য রাজবাড়ির মতো বাঈজী নাচের আসর বসেনি, টাকা ওড়েনি, মদ-মাংসের ফোয়ারা ছোটেনি। ইংরেজদের তোয়াজ করার চেষ্টা হয়নি। এই পুজো ছিল একেবারে জনসাধারণের পুজো। শ্রীরামকৃষ্ণ থেকে ঠাকুরবাড়ির দ্বারকানাথ, রবীন্দ্রনাথ, বঙ্গ রত্নদের সমাহার ছিল রানি রাসমণির বাড়ির পুজো। 

রানি রাসমণির বাড়ির পুজোর কাহিনি শুরু করতে হলে 'প্রীতরাম মাড়ের পুজো' থেকে শুরু করতে হয়। প্রীতিরাম মাড়ের পুজোই পরিচিতি লাভ করেছিল রানি রাসমণির পুজো বলে। লিখেছেন, সংবাদ প্রতিনিধি অনিরুদ্ধ সরকার।

জানবাজারের যে বাড়িতে এখন দুর্গাপুজো হয় এবং যা রানি রাসমণির বাড়ির পুজো হিসেবে পরিচিত এই বাড়িতে পুজো শুরু করেন রাসমণির শ্বশুরমশাই প্রীতরাম মাড়। আমতার ঘোষালপুর গ্রামে ছিল তাঁর আদি নিবাস। খুব অল্প বয়সে পিতৃমাতৃহীন হয়ে ছোট দুই ভাইকে নিয়ে জানবাজারে এক জমিদার আত্মীয়ের বাড়ি এসে ওঠেন তিনি। এই জমিদার পরিবারের এক সদস্য ছিলেন ডানকিন নামে এক সাহেবের দেওয়ান। বেলেঘাটায় ছিল তাঁর নুনের কারবার।সেখানেই মুহুরীর কাজ পেলেন প্রীতরাম। ভালোই চলছিল। হঠাৎই ভাগ্যবিপর্যয় ঘটল। মারা গেলেন ডানকিন সাহেব।

Latest Videos

এরপর প্রীতরাম অন্য উপায়ে শুরু করলেন রোজগার। প্রথমে বাঁশের ব্যবসা সেখান থেকে জেলাশাসকের সেরেস্তায় চাকরি, নাটোরের স্টেটের দেওয়ানের কাজ।সঙ্গে করলেন আরও অনেক কিছুই। ততদিনে বাংলার সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজিও আয়ত্ত করেছেন মেধাবী প্রীতরাম। ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দে নাটোর রাজের অধীনস্থ মকিমপুরে ১৯ হাজার টাকায় কিনে নিলেন। এই সময়েই কলকাতায় শুরু করলেন কিছু ব্যবসা। জানবাজারে বানালেন বিরাট সাতমহলা বাড়ি।তখনকার যুগেপ্রাসাদোপম এই বাড়ি তৈরি করতে নাকি খরচ হয়েছিল ৫ লক্ষ টাকা!সময় লেগেছিল প্রায় দশ বছর। দেখার মতো ঠাকুরদালান ছিল এর শোভা। বাড়ি তৈরির আগেই প্রীতরাম ঠিক করেছিলেন, এখানে দুর্গাপুজো করবেন। এরপরই ধুমধাম করে শুরু হল মাতৃআরাধনা। 


রানি রাসমণির পুজো- 
১৮৩৬ সালে স্বামী রাজচন্দ্র দাসের মৃত্যুর পর নিজের কাঁধে পুজোর সমস্ত দায়িত্ব তুলে রানি রাসমণি। মাত্র ১১ বছর বয়সে জানবাজারের জমিদার প্রীতরাম দাস মাড়ের ছেলে রাজচন্দ্রের সঙ্গে বিয়ে হয় রাসমণির। রানির আমলে এই পুজোর ধূমধাম ছিল চোখে পড়ার মতো। ভক্তিভরে রাসমণি ঠাকুরদালানে শাস্ত্রপাঠের আসর, পুরাণ-চণ্ডীপাঠ, এমনকি রামায়ণ-মহাভারত পাঠও করাতেন। দুর্গাপুজোয় যাত্রাপালার আয়োজনও করা হতো বলে জানা যায়। পালাগান, কথকতা, কবিগানের লড়াই সব মিলিয়ে উনিশ শতকের সন্ধিলগ্নের বৈশিষ্ট্যগুলি সবই জানবাজারের রানি রাসমণির পুজোয় দেখা যেতো। অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি, রামরাম বসু, ভোলা ময়রা প্রমুখ বিখ্যাত কবিয়ালরা এই বাড়িতে এসে কবির লড়াইয়ে অংশ নিয়েছেন বলে জানা যায়। 




পুজো জুড়ে ছিল ভক্তি- 

সে সময় যখন শহর কলকাতার রাজবাড়ি ও জমিদারবাড়ির লোকেরা ইংরেজদের তুষ্ট করতে ব্যস্ত ছিলেন তখন রানি রাসমণি তা একেবারেই করেননি  উলটে ভক্তিভরে পুজো করেছেন। সেসময়  অন্যান্য বড় বাড়ির পুজোর মতো এখানে বাঈজী নাচের আসর বসেনি, টাকা ওড়েনি, মদ-মাংসের ফোয়ারা ছোটেনি। এই পুজো ছিল জনসাধারণের পুজো। এই পুজোয় কেউই কোনোভাবে ইংরেজদের তোষামোদ করে আদর-আপ্যায়ন করেন নি। উলটে বেধেছিল ইংরেজদের সাথে বিরোধ। রানির আমলে ষষ্ঠীর দিন কলাবৌ স্নানকে ঘিরে ব্রিটিশ সাহেবের সঙ্গে কলহ বেধেছিল। রানি রাসমণির প্রধান পুরোহিত সেই ষষ্ঠীর ভোরে এসে রানিকে জানান যে কলাবৌ স্নানের সময় ঢাক-ঢোলের শব্দে ঘুম ভেঙে যাওয়ায় মামলা ঠুকেছেন এক ব্রিটিশ সাহেব। পরেরদিন আরো লোকলস্কর আর বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে রানি গঙ্গাস্নানে পাঠান মহিলাদের। তাতে আরো ক্ষুব্ধ হন সাহেব। এমনকি পঞ্চাশ টাকা জরিমানাও হয় রানির। এর প্রতিশোধ নিতে ধর্মতলা চত্বরে নিজেদের এলাকাজুড়ে দুপাশে বাঁশের খুঁটি পুঁতে গাড়ি-ঘোড়া যাওয়ার পথ আটকে দেন রানি রাসমণি। অবশেষে রানির সঙ্গে মীমাংসা করে নেন সেই সাহেব। সেই থেকে মুখে মুখে ছড়া হয়ে যায়-‘অষ্ট ঘোড়ার গাড়ি দৌড়ায় রাণী রাসমণি/ রাস্তা বন্ধ কর্ত্তে পারল না ইংরেজ কোম্পানী।’ এই পুজো সে-আমল থেকেই ছিল স্বমহিমায় উজ্জ্বল। আর শ্রীরামকৃষ্ণ থেকে ঠাকুরবাড়ির দ্বারকানাথ, রবীন্দ্রনাথ - কে আসেননি এই পুজোয়।


পুজোয় এসেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ -
রানির এই পুজোতেই শাড়ি পরে, সখী বেশে মায়ের পুজো করতে এসেছিলেন রামকৃষ্ণদেব ৷ পাছে লোকের তাঁকে চিনে ফেলে হৈ-চৈ বাঁধিয়ে দেয়, সে কারণেই ছদ্মবেশ ধরতে হয়েছিল পরমহংসদেবকে ৷ যখন গাড়ি থেকে নেমে মথুরবাবুর স্ত্রী-র পাশে দাঁড়িয়ে মা-কে চামর দুলিয়ে তিনি যখন হাওয়া করছিলেন, তখনও তাঁকে দেখে কেউ চিনতেই পারেননি ৷ এমনকী মথুরবাবুও নাকি পরে স্ত্রী জগদম্বাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘উনি কে গো ? ঠিক চিনতে পারলুম না ৷’ জগদম্বা তখন তাঁকে বলেছিলেন, ‘ও যে আমাদের ছোট ঠাকুর ৷’

আরও পড়ুন-
বাঈজি নাচ থেকে বলড্যান্স, নবাব সিরাজের অর্থ পেয়ে শোভাবাজার রাজবাড়ির দুর্গাপুজোয় এসেছিল ইংরেজরেজদের বৈভবের ছাপ
১৭৫৭ সালের কাঠামোতেই এখনও গড়ে ওঠে শোভাবাজার রাজবাড়ির বড় তরফের দুর্গা প্রতিমা, জেনে নিন সেই পুজোর ইতিহাস
স্বৈরাচারী রাজার বিনাশের পর কীভাবে শুরু হয়েছিল সাবর্ণ রায় চৌধুরীদের বাড়ির দুর্গাপুজো?

Read more Articles on
Share this article
click me!

Latest Videos

জঙ্গি গ্রেফতারে কড়া বার্তা মিঠুনের | Mithun Chakraborty #shorts #mithunchakraborty #shortsvideo
Viral Video! আবাসের টাকা ঢুকতেই বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাটমানি চাইছেন TMC কর্মী | Murshidabad Latest News
প্রেমের আড়ালে লক্ষাধিক টাকা লুঠ! প্রতারণার নেপথ্যে চাঞ্চল্যকর কাহিনি | South 24 Parganas News Today
ফিরহাদকে কড়া ডোজ দিলেন শুভেন্দু | Suvendu Adhikari #shorts #shortsvideo #suvenduadhikari #shortsfeed
ক্যানিং-এ এসে ভেবেছিল ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকবে! রাতেই গ্রেপ্তার কাশ্মীরি জঙ্গি | Canning News Today