একাধিক ব্রিটিশ গবেষক গগণ ঠাকুরের রাতে দুর্গা বিসর্জনের ছবিটিকে মাস্টারপিস হিসেবে উল্লেখ করেছেন।গগনেন্দ্রনাথের আঁকা এই ছবিটিতে রয়েছে রাতের আলোয় বিসর্জনের দৃশ্য।
রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্র এবং অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা গগনেন্দ্রনাথ ছিলেন আধুনিক ভারতীয় চিত্রকলার প্রধান পথপ্রদর্শকদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর একটি জনপ্রিয় ছবি ‘প্রতিমা বিসর্জন’। এই ছবিটিকে অনেক গবেষকই গগণেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা সেরা ছবিগুলির মধ্যে একটি বলে মনে করেন। একাধিক ব্রিটিশ গবেষক গগণ ঠাকুরের দুর্গা বিসর্জনের ছবিটিকে মাস্টারপিস হিসেবে উল্লেখ করেছেন। গগনেন্দ্রনাথের আঁকা এই ছবিটিতে রয়েছে রাতের আলোয় বিসর্জনের দৃশ্য। লিখছেন সংবাদ প্রতিনিধি অনিরুদ্ধ সরকার।
গগনেন্দ্রনাথের আঁকা এই ছবিটিতে রয়েছে রাতের আলোয় বিসর্জনের দৃশ্য। ছবির বাঁ-দিকে উত্তর কলকাতার রাস্তা মশালের আলোয় আলোকিত। সেখানে প্রকাণ্ড দুর্গা মূর্তির সামনে জড়ো হয়েছেন বহু মানুষ। বিসর্জনের শোভাযাত্রার আগে দেবীর বরণ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এই আলোকিত অংশের প্রতিফলিত আলো এসে পড়েছে ছবির বাকি অংশে, আবছা একটা রহস্যময় অন্ধকার দেখতে পাওয়া যায়। সামান্য অংশের আলো পড়ছে রাস্তার ধারে থাকা কয়েকটি বাড়ির ওপরে। তেমনই একটি বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে অন্তঃপুরের মহিলারা দেবীর বরণ দেখছেন।
এছাড়া গগণ ঠাকুর আরেকটি ছবি আঁকেন দুর্গা বিসর্জনের ওপর যেখানে জোড়া নৌকায় বিসর্জনের দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়।
দুর্গা বিসর্জনের রাতের মত গগণ ঠাকুর চৈতন্যদেবেরও একটি সিরিজ এঁকেছিলেন। গগন ঠাকুর ‘চৈতন্যদেবের মুত্যু’ নামে একটি ছবি এঁকেছিলেন। ছবিটিতে দেখতে পাওয়া যায়, সমুদ্রের ঢেউয়ের মধ্যে শুধু চৈতন্যদেবের মুখটুকু।
ছবি ঘিরে এক ভাব-তন্ময়তার জগৎ তৈরি করেছিলেন গগন ঠাকুর। গগনেন্দ্র, অবনীন্দ্র, সমরেন্দ্র- ঠাকুরবাড়ির গুণেন্দ্রনাথের তিন ছেলেই ছিলেন নামজাদা শিল্পী। সঙ্গে ছিল বাড়ির সাংস্কৃতিক পরিবেশ এবং অতি অবশ্যই রবিকাকার সান্নিধ্য। মা সৌদামিনী শেষ বয়সে পুরীর জগন্নাথ দর্শনের ইচ্ছে জানালে মায়ের ইচ্ছেয় পুরীতে সমুদ্রের ধারে বাড়ি তৈরি করেন ছেলেরা। বাড়ির নাম দেন, 'পাথার পুরী'। আর সেখানেই গগণ ঠাকুরের তুলিতে ধরা দিয়েছিল পুরী সিরিজের একের পর এক ছবি। পাণ্ডাদের ছবিও এঁকেছিলেন গগন ঠাকুর। পুরী সিরিজে পাণ্ডাদের প্রায় ১৫টি ছবির নিদর্শন পাওয়া যায়। পুরীর মতো রাঁচি সিরিজেও একাধিক ছবি এঁকেছিলেন গগণেন্দ্রনাথ।
ইংরেজ আমলে ভারতের অধিকাংশ প্রথম শ্রেণীর শিল্পীর কাছে কলকাতা বা দেশের অন্য বড় কোনও নগরের সেভাবে ছবিতে অস্তিত্ব ছিল না। তারা নগরের ছবি আঁকতেন না। এক বেনারস,উজ্জয়িনী ছাড়া আধুনিক নগরের ছবি সেযুগে শিল্পীরা খুব একটা আঁকতেন না। আর যদিও বা কখনো নগরের ছবি তারা আঁকতেন, এমন দৃশ্য সাধারণত আঁকতেন যা বোঝা শক্ত হয়ে যেত যে ছবিটি কোন শহরের কিম্বা কোন নগরের।
গগনেন্দ্রনাথ সেযুগে এঁকেছিলেন শহর কলকাতার নাগরিক ছবি। কারণ গগণ ঠাকুর শহরকে ধারণ করতেন মনে প্রাণে, কারণ তাঁর মেজাজ ছিল একান্ত সামাজিক, শহুরে। সন্ধ্যার পর শহরের কোনও বাড়ির বারান্দায় কিম্বা খোলা ছাদে দাঁড়িয়ে তিনি আকাশ দেখতেন। রেখা আঁকতেন। যার ফলে তাঁর ছবিতে কলকাতা ফুটে উঠত নিখুঁত ভাবে। শহরের সান্ধ্য আকাশটা, বাজার,পথ থেকে ঠাকুর বিসর্জনের দৃশ্যকে চিনে নিতে বিন্দুমাত্র কষ্ট হয় না কারোর। কলকাতাই ছিল গগনেন্দ্রনাথের ছবি আঁকার মূল অনুপ্রেরণা। দুর্গা প্রতিমা বির্জনের যে ছবি তিনি এঁকেছিলেন, তা এককথায় কলকাতার রাস্তার ছবি তা যেমন বুঝতে কারোর অসুবিধা হয় না তেমনই কলকাতাকে যারা আরও কাছ থেকে চেনেন তাঁদের পক্ষে এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না যে রাস্তাটি কর্ণওয়ালিস স্ট্রিট। এখানেই গগণ ঠাকুরের রূপদক্ষতা।
আরও পড়ুন-
দশমীর বিদায় বেলা, সাঙ্গ হল সিঁদুর খেলা, রাঙা আভায় মেতে উঠলেন বাগবাজার সার্বজনীনের মহিলারা
বিজয়া দশমীতে বাঙালির মিষ্টিমুখে রদবদল, মোয়া সন্দেশ নিমকির জায়গায় আজকাল বাঙালির পাতে পড়ছে পিৎজা-বার্গার