সেকালে কলকাতার বাবুদের বাড়িতে বেশ ধুমধাম করে দুর্গাপুজো হত। আর তাতে থাকত হাজারো আলোর রোশনাই। ঢাকের আওয়াজে গমগম করত এলাকা কিন্তু সেই প্রতিমা দেখার সৌভাগ্য সবার ছিল না।
সেকেলে কলকাতার (Ancient Calcutta) জমিদার বাবুদের বাড়ির দুর্গাপুজোতে (Durga Puja) প্রবেশাধিকার ছিল কেবল উচ্চবিত্ত আর ইংরেজ রাজপুরুষদের। আর যদি সাধারণ মানুষ পুজো দেখতে প্রবেশ করত তো তার কপালে জুটত মার। একবার পুজো দেখতে গিয়ে কয়েকজন যুবক খেলেন মার। আর প্রতিজ্ঞা করলেন এর বদলা নেবেন দুর্গাপুজো করে। রাগ-দুঃখ-ক্ষোভ-অভিমান থেকেই জন্ম হল কলকাতার প্রথম বারোয়ারি দুর্গাপুজোর (Barowari Durga Puja)। লিখছেন অনিরুদ্ধ সরকার
সেকালে কলকাতার বাবুদের বাড়িতে বেশ ধুমধাম করে দুর্গাপুজো হত। আর তাতে থাকত হাজারো আলোর (Light) রোশনাই। ঢাকের আওয়াজে গমগম করত এলাকা কিন্তু সেই প্রতিমা দেখার সৌভাগ্য সবার ছিল না। সাধারণ মানুষ ছিলেন ব্রাত্য। বাবুদের দারোয়ান দাঁড়িয়ে থাকত বাড়ির মূল দরজায়, থাকত বাবুদের লেঠেল। যদি ভুলবশত কোনও স্থানীয় মানুষ ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করত তো তার পিঠে পড়ত লাঠির বাড়ি কিম্বা চাবুকের মার। ঠাকুর দেখতে গিয়ে তাই অনেকেই মার খেয়ে বাড়ি ফিরে আসতেন।
আরও পড়ুন- Durga Puja 2021: বেলুড় মঠে প্রথম দুর্গাপুজোর সূত্রপাত স্বামীজীর হাত ধরে
একবছর কলকাতার জমিদার বাবুদের বাড়ির দুর্গাপুজো দেখতে গেছে কয়েকজন যুবক। নিয়ম অনুযায়ী তাঁদের কপালেও জুটল মার। মার খেয়ে একরাশ ক্ষোভ নিয়ে তারা বাড়ি ফিরলেন। আর মনে মনে ঠিক করলেন এর বদলা তারা নেবেন। তারা বিপ্লবী কন্ঠে বললেন "বাবুরা পারলে আমরাও পারি"। দুর্গাপুজো করবেন বলে তারা বদ্ধপরিকর হলেন। সবাই মিলে সমবেত ভাবে উদ্যোগ নিলেন দুর্গাপুজোর। উদ্যোক্তারা শপথ নিলেন এই পুজোয় সবার থাকবে সমান অধিকার। রাগ-দুঃখ-ক্ষোভ-অভিমান থেকেই জন্ম হল কলকাতার প্রথম বারোয়ারি দুর্গাপুজোর। কেউ কেউ অবশ্য সিমলা ব্যায়াম সমিতির পুজোকেই আদি বারোয়ারি পুজো বলেন যদিও এবিষয়ে ভিন্ন-ভিন্ন মত রয়েছে। আদতে সিমলা ব্যায়াম সমিতির পুজো ছিল পুরোপুরিভাবে বিপ্লবীদের পুজো, সার্বজনীন পুজো। আর সে পুজোর সূত্রধর ছিলেন বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষ ঘনিষ্ঠ অতীন বসু।
ইতিহাস বলছে, ১৯১৯ সালে হুগলির গুপ্তিপাড়ায় ১২ জন ব্রাহ্মণ বন্ধু মিলে প্রথম একটি পুজো করার সিদ্ধান্ত নেন। আর এই বারোজন ইয়ার বা দোস্ত থেকেই নাকি "বারোয়ারি" কথাটি এসেছে! তবে সেপুজো নিয়ে দ্বিমত আছে। ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, কলকাতার বারোয়ারি পূজার প্রথম উদ্যোক্তাদের মধ্যে ছিলেন রামকালী মুখোপাধ্যায়, দীনেন চট্টোপাধ্যায়, নীলমণি ঘোষ, বটুকবিহারী চট্টোপাধ্যায়ের মত কিছু মানুষজন। কলকাতা গবেষকদের মতে এই পুজোই ছিল কলকাতা তথা তৎকালীন ভারতবর্ষের প্রথম বারোয়ারি দুর্গাপূজা।
ইংরেজ কৃপাধন্য দেশীয় জমিদারদের অপ মানের প্রতিবাদে যখন বারোয়ারি পুজোর সিদ্ধান্ত নিলেন সাধারণ মানুষ তখন তাতে প্রথম বাধা দিতে এলেন এদেশীয় পণ্ডিতকূল। পুজোয় বাধা সৃষ্টি করতে এলেন রক্ষণশীল পণ্ডিতের দল। শেষ পর্যন্ত তারা সরে দাঁড়াতে বাধ্য হন পণ্ডিত দীননাথ ভট্টাচার্যের হস্তক্ষেপে। আর হাজারো বাধা বিপত্তিকে দূরে সরিয়ে সেই প্রথম শুরু হয় বারোয়ারি দুর্গোৎসব। বাগবাজারের সেই পুজো আজও চলছে। নেবুবাগান লেন ও বাগবাজার স্ট্রিটের মোড়ে ৫৫ নম্বর বাগবাজার স্ট্রিটে প্রথম এই বারোয়ারি পুজো শুরু হয়েছিল। সূচনালগ্নে নাম ছিল 'নেবুবাগান বারোয়ারি দুর্গাপুজো'। সেখানে কয়েক বছর পুজো হয়। তারপর ১৯২৪ সালে পুজোটি সরে যায় বাগবাজার স্ট্রিট ও পশুপতি বোস লেনের মোড়ে। পরের বছর আবার স্থান বদল। পুজো হয় কাঁটাপুকুরে। ১৯২৭ সালেও পুজো স্থানান্তরিত হয়। সেবছর দুর্গাপুজো হয় বাগবাজার কালীমন্দিরে।
১৯৩০ সাল।সলিসিটর দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে হয় পুজোর রেজিস্ট্রেশন। তাঁর চেষ্টায় পুজোটি নতুন চেহারা পায়। নাম হয় 'বাগবাজার সার্বজনীন দুর্গোৎসব ও প্রদর্শনী'। তাঁরই উদ্যোগে পুজো উঠে যায় কর্পোরেশনের মাঠে। শিল্পে স্বদেশি জোয়ার, দেশজ শিল্পের উন্নতিকল্পে বিবিধ প্রচেষ্টার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এই দুর্গাচরণ। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ তাঁকে 'মুকুটহীন সম্রাট' বলতেন।
দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে এই পুজোর সভাপতি ছিলেন বিশিষ্ট সাংবাদিক ও সম্পাদক কুমার বিশ্বনাথ রায়। শিক্ষা ও খেলাধুলোর উন্নতিতে তিনি সব সময় সজাগ থাকতেন ও সাহায্য করতেন। সেযুগে তিনি ছিলেন একজন প্রবাদপ্রতিম ব্যতিত্ব। রসগোল্লার দুই প্রাণপুরুষ, নবীনচন্দ্র ও কৃষ্ণচন্দ্র দাশের সুযোগ্য উত্তরসূরি সারদাচরণ দাশও এই পুজোর সভাপতি ছিলেন। পুজোর ‘উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সভাপতির’ তালিকাও চোখে পড়ার মত। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় থেকে আশাপূর্ণা দেবী, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় কে নেই সেই তালিকায়। পুজোর সমাপ্তি অনুষ্ঠানেও বিভিন্ন সময়ে সভাপতিত্ব করেছেন সুভাষচন্দ্র বসু, ড. ত্রিগুণা সেন থেকে সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় কিম্বা অভিনেতা বিকাশ রায়।
বাগবাজারের বারোয়ারি পুজো বাঙালিকে শিখিয়েছিল জমিদারি অহংকারকে কিকরে ভাঙতে হয়। বাঙালি দেখিয়েছিল যদি সে একত্রিত হয় ও প্রতিবাদ করে তো সে বিশ্বজয় করতে পারে।
তথ্যসূত্র:
১| কলকাতা ও দুর্গাপুজো - অঞ্জন মিত্র
২| কলিকাতার ইতিবৃত্ত - প্রাণকৃষ্ণ দত্ত
৩| কলকাতা বিচিত্রা- রাধারমণ রায়
৪| সুভাষ স্মৃতি
৫| সুভাষ রচনাবলী
৬| বাংলার লোকসংস্কৃতির সমাজতত্ত্ব - বিনয় ঘোষ।
৭| বাংলার সামাজিক ইতিহাসের ধারা- বিনয় ঘোষ।
৮ | রাধারমণ রায় ও বিমল ভট্টাচার্যের কিছু প্রবন্ধ