জার্মানি থেকে আসত দেবী দুর্গার গয়না, বন্দুক তৈরির ব্যবসায় প্রভূত লাভের অর্থে শুরু হল দাঁ বাড়ির ঐতিহ্যশালী পুজো

অতীতের বারাণসী ঘোষ স্ট্রিট নাম বদলে এখন হয়েছে বিবেকানন্দ রোড। গণেশ টকিজের মোড়ের অদূরে যে বাড়িটি স্থাপত্য বৈচিত্রে সকলের নজর কাড়ে, কলকাতার বনেদি বাড়ির পুজোর তালিকায় এই বাড়ি দাঁ বাড়ি নামে পরিচিত। স্থানীয় লোকের মুখে মুখে এ বাড়ির নাম ‘বন্দুকওয়ালা’ বাড়ি। 

Web Desk - ANB | Published : Sep 29, 2022 12:53 PM IST

দাঁ বাড়িতে পুজো শুরু হয় ১৮৪০ সালে। শোনা যায়, সে কালে শিবকৃষ্ণ দাঁ প্যারিস এবং জার্মানি থেকে প্রতিমার জন্য বহুমূল্য ফরমায়েশি গয়না আনাতেন। রুপোর ছাতা ধরে নবপত্রিকার গঙ্গাস্নান হয়। বাড়ির ভিতরটি ইউরোপীয় অপেরা হাউসের ব্যালকনির মতো। ডাকের সাজের পাশাপাশি দেবীকে সোনা-রুপোর গয়না পরানো হয়।  লিখেছেন, সংবাদ প্রতিনিধি অনিরুদ্ধ সরকার।


ইতিহাস- 
বাঁকুড়ার কোতলপুর থেকে ভাগ্যান্বেষণে কলকাতায় এসেছিলেন এই পরিবারের আদি পুরুষ। তাঁরই উত্তরপুরুষ নরসিংহচন্দ্র দাঁ ১৮৩৫ সাল নাগাদ শুরু করেন বন্দুকের ব্যবসা। ওল্ড চিনেবাজার স্ট্রিটে ‘নরসিংহচন্দ্র দাঁ অ্যান্ড কোং গান অ্যান্ড রাইফেল মেকার্স’ নামে সেই দোকানেই ব্যবসায় সাফল্য অর্জন করে তিনি প্রভূত ধনশালী হয়ে ওঠেন। এর পরেই ১৮৫৯ সালে শুরু করেন দুর্গোৎসব। 


কবে থেকে পুজো শুরু- 
১৮৩৪ সাল নাগাদ বাঁকুড়ার কোতুলপুরের বাসিন্দা দয়ারাম দাঁয়ের উত্তরপুরুষ নরসিংহ দাঁ অন্যান্য ব্যবসার সঙ্গে সঙ্গে শুরু করলেন বন্দুকের ব্যবসা। ধর্মতলায় দু’টি দোকান খুললেন তিনি। একটি নিজের নামে, অন্যটি ছেলে আশুতোষ দাঁয়ের নামে। কোম্পানির আমলে শুরুটা খুব সহজ না হলেও দেশীয় রাজারাজড়া আর জমিদারদের কাছে এঁদের বন্দুকের চাহিদা ছিল খুব। সুদৃশ্য দেখনদার বন্দুকের জন্য রাজারাজড়াদের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলত রীতিমতো। পরবর্তীকালে ইংরেজরা হয়ে ওঠেন দোকানের নিয়মিত খরিদ্দার। ব্যবসায় প্রভূত অর্থলাভের পর নরসিংহ দাঁ সিপাহী বিদ্রোহের দু’বছর পর, অর্থাৎ ১৮৫৯-এ জোড়াসাঁকোর বাড়িতে ধুমধাম করে শুরু করলেন দুর্গাপুজো


পুজোর ইতিবৃত্ত - 
রথের দিন হয় কাঠামোপুজো। প্রতিপদের দিন থেকে পুজো শুরু। ষষ্ঠীর দিনে হয় বোধন। ডাকের সাজের প্রতিমাকে সাজানো হয় সোনার গয়নায়।সপ্তমীর সকালে রুপোর ছাতা মাথায় দিয়ে গঙ্গাস্নানে যায় নবপত্রিকা। সপ্তমীর দিন কলাবৌ স্নান করিয়ে নিয়ে আসার পর কুলদেবী লক্ষ্মীকে ঠাকুরঘর থেকে ঠাকুরদালানে নিয়ে আসা হয়। আগে নবপত্রিকা স্নানের সময় বন্দুক এবং তলোয়ারধারী প্রহরী যেত কলাবৌয়ের সঙ্গে। এখন অবশ্য আর তা হয় না।

অষ্টমীর আরতি চলাকালীনও বেশ কয়েক বার শূন্যে গুলি চালানো হয়। সন্ধিপুজোয় গর্জে ওঠে কামান। সন্ধিক্ষণে দাগা হয় বন্দুক। মাত্র ১৭ ইঞ্চি লম্বা এই কামানটি সে কালে তৈরি করেছিল ‘উইনচেস্টার রিপিটিং আর্মস’ কোম্পানি। নবমীর দিন হয় কুমারী পুজো। তবে পরিবারের রীতি অনুসারে বাড়ির অন্য কুমারীদেরও মণ্ডপে সাজিয়ে বসানো হয়। পরিবারের সদস্যরা তাদের হাতে তুলে দেন নানা ধরনের উপহার। সপ্তমীর সকালে রুপোর ছাতা মাথায় দিয়ে গঙ্গাস্নানে যায় নবপত্রিকা।


 


দশমীর কনকাঞ্জলি- 
দশমীর দিন এই বাড়ির পুরুষেরা মহিলাদের কনকাঞ্জলি দেন। পুজো শেষে বাড়ির মহিলারা আঁচল পেতে দাঁড়ান। বাড়ির পুরুষেরা পিছন দিকে চাল কড়ি পান সুপুরি, আরও অন্যান্য জিনিস ছুড়ে দেন। মহিলারা কনকাঞ্জলি গ্রহণ করে কোঁচড়ে করে ঠাকুরঘরে নিয়ে গিয়ে সেই জিনিস এক বছর যত্ন করে রাখেন


দশমীর রেওয়াজ ও বিসর্জন- 
দশমীর দিন বাড়ি থেকে যখন প্রতিমা রাস্তায় বার হয়, তখনও বন্দুক দাগা হয়। আগে ওড়িশা থেকে আসা বাহকেরা কাঁধে করে ঠাকুর নিয়ে যেতেন। ঠাকুরের সঙ্গে দু’দিকে তিন জন করে মশাল বাহক থাকতেন। সেই সঙ্গে থাকতেন সশস্ত্র রক্ষীরা। সব মিলিয়ে অদ্ভুত আর মায়াময় এক পরিবেশের সৃষ্টি হত। ঘাটে প্রস্তুত থাকত বিশমনি নৌকো।

আগে দশমীর দিন নীলকণ্ঠ পাখি ওড়ানোর রীতি থাকলেও বর্তমানে তা বন্ধ। তেমনই আগে বাহকের কাঁধে চেপে দু্র্গা প্রতিমা বিসর্জনে যেত। দু’টি নৌকার মাঝখানে রেখে প্রতিমাটি মাঝগঙ্গায় নিয়ে গিয়ে বিসর্জন হত। এখন অবশ্য তা আর হয় না।


ভোগবৃত্তান্ত-
 পঞ্চমীর দিন ভিয়েন বসে বাড়িতে। সে দিন থেকেই নানা রকম মিষ্টি তৈরি হওয়া শুরু হয়। ভোগে পাঁচ রকম মিষ্টি, নোনতা, দই দেওয়া হয়। এ ছাড়াও দেওয়া হয় পান্তুয়া, গজা, মিহিদানা।সন্ধিপুজোয় নৈবেদ্য হয় এক মণ চালের, যা সাজান বাড়ির ছেলেরা। ভোগের মিষ্টি- পান্তুয়া, গজা, মিহিদানা ইত্যাদি বাড়িতেই তৈরি হয়। এ ছাড়াও ভোগে থাকে লুচি।

আরও পড়ুন-
রাসমণির বাড়ি হয়ে বিশ্বাস পরিবার, রানির মেয়েদের পরম্পরায় দুর্গাপুজোর নাম এখন ‘তিন বাড়ি’-র পুজো
শাড়ি পরে দুর্গাপুজো করেছিলেন শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, রানি রাসমণির বাড়ির পুজোতে এসেছিলেন রবি ঠাকুরও
দত্তক পুত্র আর নিজের পুত্রের মধ্যে ভাগ হল  শোভাবাজার রাজবাড়ির সম্পত্তি, কীভাবে শুরু হল ছোট তরফের দুর্গাপুজো?

Read more Articles on
Share this article
click me!