
নারায়ণ দেবনাথ একজন বিখ্যাত ভারতীয় বাঙালি কমিক্স শিল্পী। তিনি হাঁদা ভোঁদা, বাঁটুল দি গ্রেট, নন্টে ফন্টে, বাহাদুর বেড়াল, ডানপিটে খাঁদু আর তার কেমিক্যাল দাদু, কৌশিক রায় প্রভৃতি বিখ্যাত কার্টুন চরিত্রের স্রষ্টা।
পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে তার লেখা ও আঁকা কমিকস ছোট-বড় বাঙালিকে মাতিয়ে রেখেছে। কমিক-স্ট্রিপ ছাড়াও তিনি শিশু-কিশোরদের উপন্যাস অলঙ্করণ করেছেন। শুকতারা, কিশোর ভারতী প্রভৃতি কলকাতা ভিত্তিক শিশু-কিশোরদের পত্রিকায় কমিকস গুলিকে ছোট ছোট খণ্ডে নিয়মিত প্রকাশ করা হচ্ছে। ২০২১ সালে ভারত সরকার তাঁকে পদ্মশ্রী পুরস্কারে সম্মানিত করেছেন।
নারায়ন দেবনাথের জন্ম ও বেড়ে ওঠা শিবপুর, হাওড়া, ভারতে। পারিবারিক আদি বাসস্থান বাংলাদেশের বিক্রমপুর অঞ্চলে হলেও তার জন্মের আগেই পরিবার শিবপুরে এসে স্থায়ী ভাবে বসবাস করা শুরু করে। অল্প বয়স থেকেই শিল্পের প্রতি তার ঝোঁক ছিল।
পারিবারিক পেশা স্বর্ণকার হওয়ায় অলঙ্কার প্রভৃতির নক্সা করার সুযোগ ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি আর্ট কলেজে পাঁচ বছরের ডিগ্রীর জন্য লেখাপড়া শুরু করলেও শেষ পর্যন্ত তা চালিয়ে যাননি, শেষ বর্ষে এসে পড়া ছেড়ে দেন। এরপরে কিছু বছর বিভিন্ন বিজ্ঞাপন সংস্থার জন্য কাজ করেন।
বাংলা কমিকসের জগতে নারায়ন দেবনাথের আগমন ঘটে দেব সাহিত্য কুটিরের সম্পাদক মন্ডলীর উৎসাহে। তার প্রথম কমিকস হাঁদা ভোঁদা নামটিও তাদের প্রস্তাবিত। সে সময় বাংলা কমিকস বলতে ছিল একমাত্র প্রফুল্লচন্দ্র লাহিড়ি বা কাফি খাঁ'র আঁকা শেয়াল পণ্ডিত, যা তখন যুগান্তরে প্রকাশিত হত।
হাঁদা ভোঁদা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই পাঠকদের সমাদর পায় এবং শুকতারা থেকে নিয়মিত প্রকাশিত হতে থাকে। শুরুতে দেবনাথ নিজেই হাঁদা ভোঁদায় অঙ্কন ও কালি বসানোর কাজ করতেন। পরবর্তীতে তা গ্রেস্কেলে প্রকাশ করার ব্যবস্থা করা হয়।
নারায়ণ দেবনাথের প্রথম রঙীন কমিক স্ট্রিপ ছিল বাঁটুল দি গ্রেট। নারায়ণবাবুর কথায়, কলকাতার কলেজস্ট্রিট থেকে ফেরার পথে তিনি বাঁটুলের কল্পনা করেন ও তৎক্ষণাৎ তার প্রতিকৃতি এঁকে ফেলেন। যদিও তিনি শুরুতে বাঁটুলকে কোনও অলৌকিক শক্তি দেননি।
পরবর্তীকালে কিশোর ভারতী পত্রিকা দল নারায়ণবাবুর কাছে বিশেষ পুজোসংখ্যার ব্যাপারে এসে পৌঁছয়। তখন সম্পাদক ছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র। পরে দীনেশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পাদক হিসেবে নারায়নবাবুকে গোয়েন্দা-গল্প প্রস্তাব দেন যা পরে পরিণত হয় 'ব্ল্যাক ডায়মন্ড ইন্দ্রজিৎ রায়' চরিত্রে।
কিশোর ভারতীতে তার আঁকা প্রথম ধারাবাহিক কমিক স্ট্রিপ হলো 'ম্যাজিশিয়ান পটলচাঁদ', যার একটি সংখ্যা বেরোয়। ২০১১ সালে লালমাটি প্রকাশন তার বিরল কাজগুলি পুনরায় প্রকাশ করে নারায়ণ দেবনাথ সমগ্র প্রথম ও দ্বিতীয় খন্ড হিসেবে। ২০১২ সালে বাঁটুল প্রথমবার ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয়।
লেখক নারায়ণ দেবনাথকে ২০২১ সালে পদ্মশ্রী সম্মানে সম্মানিত করে ভারত সরকার। দিল্লি থেকে তাঁর বাড়িতে ফোন আসে। প্রায় ৯৯ বছর বয়সী নারায়ন দেবনাথ বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন অসুখে ভুগছিলেন। সেই কারণে এখন তিনি আর বিশেষ আঁকেন না। তবে গত বছর এই পুরস্কার পাওয়ায় খুশি ছিলেন তিনি ও তাঁর পরিবার।
দেরিতে এই সম্মান পাওয়ায় শিল্পীর কোনও দুঃখ নেই। তিনি জানিয়েছেন যখন যেটা পাবার তখন পাবেন। গত সাত দশক ধরে বাঙালি পাঠক জগতে পরিচিত নাম নারায়ন দেবনাথ। তাঁর সৃষ্টি কমিকস বাটুল দি গ্রেট, হাঁদা ভোঁদা নন্টে-ফন্টে আজও আট থেকে আশি বাঙালি পাঠকদের সমান আনন্দ দেয়। এর আগে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকে বঙ্গবিভূষণ পুরস্কারে সম্মানিত করেন।
বার্ধক্যজনিত অসুস্থতার জেরে গত ২৪ ডিসেম্বর ২০২১-এ কলকাতার একটি নার্সিংহোমে ভর্তি হন তিনি। নার্সিংহোমে শয্যাশায়ী অবস্থাতেই দিনকয়েক আগে তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হয় ‘পদ্মশ্রী’(Padma Shri Medal) সম্মান।
রাজ্যের মন্ত্রী অরূপ রায় এবং স্বরাষ্ট্রসচিব বিপি গোপালিকা হাসপাতালে দেখতে যান তাঁকে। সেখানেই পরিবার-পরিজনদের উপস্থিতিতে প্রবীণ শিল্পীকে সম্মানিত করা হয়। ওইদিন চিকিৎসকের কাছে প্রবীণ শিল্পীর স্বাস্থ্যের খোঁজ নেন তাঁরা। তারপরই শয্যাশায়ী অবস্থায় তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হয় ‘পদ্মশ্রী’ সম্মান এবং মানপত্র।
দীর্ঘ ২৫ দিন ধরে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন তিনি। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৮ বছর। মঙ্গলবার সকালেই চলে গেলেন বিখ্যাত কার্টুনিস্ট। এদিন কলকাতার এক বেসরকারি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন সকাল ১০.১৬ মিনিটে। ডাক্তার সূত্রে জানা যায়, এই টিমই তাঁকে বারে বারে সুস্থ করে তুলেছিলেন। গতকাল রাতে অবস্থা স্বাভাবিক থাকার সত্ত্বেও মঙ্গলবার সকালেই হঠাৎ ব্লাডপ্রেশার নেমে যায়। এরপর শেষ রক্ষা হয়নি।
বেশ কিছু সময় ধরেই বার্ধ্যক্যজনতি সমস্যায় ভুগছিলেন নারায়ণ দেবনাথ। ৯৮ বছর বয়স হওয়ায় শারীরিক ক্ষমতাও অনেকটাই কমে গিয়েছিল। এই পরিস্থিতিতে গত ২৪ ডিসেম্বর ফের গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন নারায়ণ দেবনাথ। তারপরই ডাক্তারের বিশেষ টিম তারি করে শুরু হয়েছিল চিকিৎসা। কিন্তু শেষরক্ষা হল না। কমিকস বাটুল দি গ্রেট, হাঁদা ভোঁদা নন্টে-ফন্টে-কে অনাথ করে চলে গেলেন তাদের স্রষ্ঠা।