পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক জগদীশচন্দ্র প্রেসিডেন্সি কলেজে সহকর্মী হিসেবে পেয়েছিলেন প্রফুল্ল চন্দ্র রায়কে। দুজনের আলাপ হয়েছিল ইংল্যান্ডে। প্রিয় স্যার লর্ড র্যালেকে নিজের কলেজের গবেষণাগার ঘুরে দেখানোর জন্য অপমানিত হন জগদীশ। আর সেই স্যারের প্রচেষ্টাতেই জগদীশ ইংল্যান্ড যান ও বাঙালির মুখ উজ্জ্বল করেন। এই কৃতী বাঙালি দেশে ফিরলে তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে কয়েকজন আত্মীয় ছাড়া আর কেউই রেল ষ্টেশনে উপস্থিত ছিলেন না। ছিলেন কেবল ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার। অধ্যাপক জগদীশচন্দ্রের জীবনের এক অজানা অধ্যায়ের সন্ধান দিচ্ছেন - অনিরুদ্ধ সরকার
বাংলা প্রেসিডেন্সির মুন্সীগঞ্জে ১৮৫৮ সালের ৩০ নভেম্বর জগদীশ চন্দ্র (Jagdish Chandra Bose) বসুর জন্ম। পিতা ভগবান চন্দ্র বসু (Bhagwan Chandra Bose) ছিলেন তৎকালীন ব্রাহ্ম সমাজের একজন বিশিষ্ট সদস্য। চাকরি করতেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের এবং একইসাথে ছিলেন ফরিদপুর, বর্ধমানসহ কয়েকটি এলাকার সহকারী কমিশনার। পিতা ভগবান চন্দ্র বসু (Bhagwan Chandra Bose) বিশ্বাস করতেন যে, শিক্ষাগ্রহণের জন্য সর্বপ্রথম চাই নিজের মাতৃভাষাকে ভালোভাবে রপ্ত করা এবং দেশপ্রেমকে অন্তরে ধারণ করা।
১৮৬৯ সালে জগদীশ চন্দ্র (Jagdish Chandra Bose) কলকাতার হেয়ার স্কুলে ভর্তি হন। তারপর সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুল ও কলেজে পড়া শেষে ভর্তি হন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় (Calcutta University) থেকে পাস করার পর জগদীশ চেয়েছিলেন ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে যোগ দিতে। কিন্তু পিতা চেয়েছিলেন ছেলে স্বাধীনভাবে কিছু করুক। আর সেকারণে পিতা পুত্রকে পাঠিয়ে দিলেন লণ্ডন। জগদীশ ভর্তি হলেন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে (London University) ডাক্তারি পড়তে। কিন্তু ডাক্তারি তাঁর বেশিদিন পড়া হল না। প্রায়শই অসুস্থ হয়ে পড়তে লাগলেন মর্গ ও ওষুধের তীব্র দুর্গন্ধে। অসুখ যখন বৃদ্ধি পেতে লাগলো তখন পড়া ছাড়লেন জগদীশ (Jagdish Chandra Bose)।
জগদীশচন্দ্রের (Jagdish Chandra Bose) বোনের স্বামী ছিলেন বিখ্যাত আইনজীবী ও ব্রাহ্মনেতা আনন্দমোহন বসু (Anandamohan Bose)। তাঁর সুপারিশে কেমব্রিজের ক্রাইস্টস কলেজে ভর্তি হন জগদীশ (Jagdish Chandra Bose)। তারপর কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় (Cambridge University) থেকে ন্যাচারাল সায়েন্সে বি.এ এবং লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি ডিগ্রী লাভ করেন। তারপর ১৮৯৬ সালে ডিএসসি ডিগ্রী লাভ করেন জগদীশচন্দ্র (Jagdish Chandra Bose)। জগদীশচন্দ্র যখন কেমব্রিজের ছাত্র, ঠিক সেই সময়ে বাংলার আরেক তরুণ প্রফুল্ল চন্দ্র রায় (Prafulla Chandra Roy) এডিনবার্গের ছাত্র। তিনি সেখানে তখন রসায়নবিদ্যার পাঠ নিচ্ছেন। লন্ডনে থাকাকালীন তাদের দুজনের বন্ধুত্ব হয়। ১৮৮৫ সালে পড়াশোনা শেষে ভারতে ফিরে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন বিশিষ্ট নারী আন্দোলনের প্রবক্তা ও সমাজকর্মী অবলা বসুর (Abala Bose) সঙ্গে। পরবর্তীকালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তারা।
দেশে ফিরে লর্ড রিপনের অনুরোধে জগদীশ (Jagdish Chandra Bose) প্রেসিডেন্সি কলেজে (Presidency College) পদার্থবিজ্ঞানের ভারপ্রাপ্ত অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। চাকরিতে ঢুকেই তিনি দেখলেন এক অদ্ভুত বেতন বৈষম্য। কলেজের ব্রিটিশ অধ্যাপকেরা দেশীয় অধ্যাপকদের তুলনায় কম বেতন পাচ্ছেন। জগদীশ (Jagdish Chandra Bose) এই বৈষম্য ব্যবস্থা মেনে নিতে পারলেন না। এই বৈষম্যমূলক আচরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানালেন আর প্রায় তিন বছর কলেজ থেকে কোনও বেতন গ্রহণ করলেন না।
প্রেসিডেন্সি কলেজে (Presidency College) তখন সেভাবে গবেষণার কোনও সুযোগ নেই। একদিন তিনি স্থানীয় একজন ঝালাই মিস্ত্রিকে ডেকে নিয়ে এলেন কলেজে আর তাকে দিয়ে কিছু প্রয়োজনীয় যন্ত্র তৈরি করিয়ে গড়ে তুললেন নিজের খরচে গবেষণাগার। আর ক্লাস শেষে সেখানেই নিভৃতে ‘বিজ্ঞানচর্চা’ করতে শুরু করলেন। জগদীশ (Jagdish Chandra Bose) একমনে নিজের মত করে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। একদিন হঠাৎ করে প্রেসিডেন্সি কলেজে জগদীশের সহকর্মী হিসেবে হাজির হলেন প্রফুল্ল চন্দ্র রায় (Prafulla Chandra Roy)। দেশে ফিরে প্রেসিডেন্সি কলেজে জগদীশচন্দ্রের পর 'দ্বিতীয় ভারতীয় বিজ্ঞানের অধ্যাপক' হিসেবে যোগ দিলেন প্রফুল্ল চন্দ্র রায়।
প্রফুল্লচন্দ্র (Prafulla Chandra Roy) জগদীশচন্দ্রের (Jagdish Chandra Bose) কাজে উৎসাহ ও পরামর্শ দিতেন। একদিন জগদীশচন্দ্র কলেজের ল্যাবরেটরিতে তাঁর কয়েকজন সহকর্মীকে ডেকে একটি আবিষ্কার দেখালেন। অধ্যাপক প্রফুল্লচন্দ্রের ঘরে রাখা হল একটি ‘প্রেরক যন্ত্র’। আর ‘আলেকজান্ডার পেডলার’ নামে কলেজের আর একজন অধ্যাপকের ঘরে রাখা হল ‘গ্রাহক যন্ত্র’। দুটি ঘরের মধ্যে ব্যবধান প্রায় ৭০ ফুট আর তার মাঝখানে মোটা দেওয়াল বিদ্যমান। 'প্রেরক যন্ত্র’ থেকে অদৃশ্য বিদ্যুৎ তরঙ্গ গিয়ে অন্য ঘরের 'গ্রাহক যন্ত্রে'র মাধ্যমে একটি পিস্তলে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দিল। আর তা দেখে সবাই অবাক হয়ে গেল।প্রফুল্লচন্দ্র জড়িয়ে ধরলেন জগদীশকে (Jagdish Chandra Bose)।
ইংল্যান্ডে অধ্যয়ন করাকালীন সময়ে জগদীশের (Jagdish Chandra Bose) গুরু ছিলেন অধ্যাপক ‘লর্ড র্যালে’। একদিন লর্ড র্যালে কলকাতা এলে প্রিয় স্যারকে নিজের কলেজে নিয়ে এলেন এবং তার তৈরি গবেষণাগারটি ঘুরে দেখালেন জগদীশ চন্দ্র বসু (Jagdish Chandra Bose)। এদিকে জগদীশের গবেষণাগার আর আবিষ্কারগুলি দেখে অবাক হয়ে গেলেন র্যালে। আর সঙ্গে সঙ্গে বললেন, " জগদীশ তুমি এখানে পড়ে থেকো না, এক্ষুনি ইংল্যান্ডে চলে এসো। তোমার এই পদ্ধতিগুলির কথা সবাইকে জানাও! শেষ পর্যন্ত নিজের উদ্ভাবিত যন্ত্রপাতিগুলি নিয়ে জগদীশচন্দ্র (Jagdish Chandra Bose) অবলা বসুকে (Abala Bose) নিয়ে পাড়ি দিলেন ইংল্যান্ড।
লন্ডনে গিয়ে জগদীশের (Jagdish Chandra Bose) সঙ্গে পরিচয় হয় বিজ্ঞানী মার্কোনির। মার্কোনি অনেকদিন থেকেই বেতার, টেলিগ্রাফি এসব নিয়ে কাজ করছিলেন। এই টেলিগ্রাফ তিনি ব্রিটিশ পোস্ট সার্ভিসের জন্য উন্নত করতে চেয়েছিলেন মূলত ব্যবসার কারণে। যেখানে জগদীশচন্দ্র (Jagdish Chandra Bose) চেয়েছিলেন এর প্রয়োগের দিককে যুগোপযোগী করতে। তাই আবিষ্কারক হিসেবে ইতিহাসের পাতায় থেকে যায় ব্যবসায়ী মার্কোনির নাম। ইংল্যান্ডের 'রয়্যাল সোসাইটি’তে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ ছিল জগদীশচন্দ্রের (Jagdish Chandra Bose) জীবনের সবচেয়ে সম্মানজনক বক্তৃতা। জগদীশ (Jagdish Chandra Bose) এক জায়গায় লিখেছেন, " যেখানে স্যার হামফ্রে ডেভি বা মাইকেল ফ্যারাডের মত বিজ্ঞানীরা বক্তৃতা দিয়ে গিয়েছিলেন, সেখানে সেই প্রথম বক্তৃতা দিতে উঠেছিলাম আমি। এক অনামী ভারতীয়।" সেদিনের সেই সভায় সভাপতির পাশে বসেছিলেন জগদীশের স্ত্রী অবলা। স্বামীর বক্তৃতায় সেদিন অবলার বুক গর্বে ভরে গেছিল।
উদ্ভিদও যে তাপ, শীত, আলো, শব্দ ও অন্যান্য অনেক বাহ্যিক উদ্দীপনায় সাড়া প্রদান করতে পারে সেই কথা জগদীশ চন্দ্র বসুই (Jagdish Chandra Bose) প্রমাণ করে দেখালেন। আর এই প্রমাণের জন্য নিজেই তৈরি করলেন 'ক্রিস্কোগ্রাফ' নামক একটি যন্ত্র। আমেরিকা, ফ্রান্স, জার্মানি সহ ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে বক্তৃতা দিয়ে সস্ত্রীক জগদীশ (Jagdish Chandra Bose) দেশে ফিরলেন, স্বামী বিবেকানন্দ কলকাতায় ফেরার ঠিক দু’মাস পরে। আশ্চর্যের বিষয় বসু দম্পতিকে অভ্যর্থনা জানাতে কয়েকজন আত্মীয় ছাড়া আর কেউ রেল ষ্টেশনে উপস্থিত ছিল না। তবে হ্যাঁ পরিবারের লোকজনবাদে একজন এসেছিলেন, ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার (Mahendralal Sarkar)।ষ্টেশনেই মহেন্দ্রলাল জড়িয়ে ধরলেন জগদীশকে। তাঁর দুচোখে জল। এগিয়ে গিয়ে অবলাকে বললেন, "তুই ডাক্তারি পড়া ছেড়ে দিয়েছিলি বলে তোকে আমি একদিন বকুনি দিয়েছিলুম, মনে আছে?’’ অবলা’ বললেন, "হ্যাঁ মনে আছে।" মহেন্দ্রলাল বলেলেন, "তুই ঠিক করেছিলি সেদিন মা, ডাক্তারনী হলে কি আর এমন স্বামী পেতিস! তুই ওকে থামতে দিস না। এই তো সবে শুরু, জগদীশ আমাদের নিউটন, গ্যালিলিও হবে।"
আরও পড়ুন- Deshbandhu Chittaranjan : এক চিরদাতা, নিজেকে নিঃস্ব করে দিতে ভালোবাসতেন দেশবন্ধু