ভোটের আগে নয়া বিতর্কে ঝাড়খণ্ডের রঘুবীর দাসের সরকার। তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে ঝাড়খণ্ডে বাঙালিদের কোণঠাসা করার অভিযোগ উঠল। একটা সময় ঝাড়খণ্ডের অন্যতম সরকারি ভাষাও ছিল বাংলা। কিন্তু, ক্রমাগত বাঙালি পীড়ন করে বাংলা ভাষার সেই অধিকার কেড়ে নিয়েছে ঝাড়খণ্ড সরকার। এবার ঝাড়খণ্ড সরকারের বিরুদ্ধে উঠল আরও গুরুতর অভিযোগ। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সবচেয়ে কম বয়সে শহিদ হওয়া ক্ষুদিরাম বসুর মূর্তি উপড়ে ফেলে দিল ঝাড়খণ্ড সরকার। যার বিরুদ্ধে এবার গর্জে উঠেছে সেখানকার বাঙালি সমাজ। পরিস্থিতি এতটাই জটিল আকার নিয়েছে যে ঝাড়খণ্ড বাঙালি সমিতি-সহ অন্যান্য বাঙালি সংগঠন এর তীব্র বিরোধিতা করছে এবং বিধানসভা নির্বাচন বয়কটেরও ডাক দিয়েছে।
ভারতবর্ষজুড়েই ছেয়ে আছে বাঙালিদের বাস। এদের মধ্যে অনেকেই ভিনরাজ্যে সংস্কৃতি এবং আবহের সঙ্গে নিজেদের মিশিয়ে নিয়েছেন। কেউ আবার দশকের পর দশক বাঙালি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য, দর্শনকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে চলেছেন। ঝাড়খণ্ডের মূল জনসংখ্যার একটা বিশাল অংশই বাঙালি। ব্রিটিশ আমলে সরকারি শাসনব্যবস্থা সচল রাখতে শিক্ষিত বাঙালিরাই ছিল ভরসা। ফলে. ইংরাজদের হাত ধরে বহু বাঙালি দেশের বিভিন্ন রাজ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল। এমনকী দেশভাগের সময় একটা বিশাল সংখ্যক বাঙালি বাস গড়ে উঠেছিল বাংলা-বিহার লাগোয়া সীমানায়। যার জন্য বহু বছর ধরে মধুপুর, দেওঘর, রাঁচি, জামশেদপুর, চাইবাসা, ঘাটশিলা-র মতো প্রসিদ্ধ জায়গাগুলি বাঙালি অধ্যুষিত। আসলে আধুনা ঝাড়খণ্ড একটা সময় ছিল সাঁওতাল পরগনার অন্তর্গত। আর সাঁওতাল পরগনায় আদিবাসীদের পর বাঙালিরা ছিল দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ জনজাতি। যার ফলে একটা সময়ে সিংভূম জেলা জুড়ে অসংখ্য স্কুল-কলেজ ছিল, যেখানে পঠন-পাঠনের মূল মাধ্যম ছিল বাংলা। সে সব আজ অতিত। ঝাড়খণ্ড রাজ্যের পত্তন হওয়ার পর থেকেই বাঙালির গরিমা কেড়ে নেওয়ারও একটা চক্রান্ত শুরু হয়েছিল। প্রশাসনের সহায়তায় ক্ষুদিরাম বসুর মূর্তি উপড়ে ফেলাটাও তারই অঙ্গ বলেই মনে করছে সেখানকার বাঙালি সমাজ।
১১ অগাস্ট ছিল শহিদ ক্ষুদিরাম বসুর মৃত্যুদিন। এই দিনে দেশকে ইংরাজ শাসনের করাল গ্রাস থেকে মুক্তি করার লড়াইয়ে ফাঁসি-র কাঠে ঝুলেছিলেন এবং হয়েছিলেন ইংরাজদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার আন্দোলনে সবচেয়ে কণিষ্ঠ শহিদ। মাত্র ১৮ বছর বয়সে দেশের জন্য হাসতে হাসতে ফাঁসি বরণ করেছিলেন তিনি। এহেন দেশের এক কৃতি সন্তানের মূর্তি উপড়ে ফেলাটা কোনওভাবেই মেনে নিতে রাজি নয় বাঙালি সমাজ। দেশজুড়ে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হোক বলেও আর্জি রেখেছেন ঝাড়খণ্ডের বাঙালিরা। এমনকী অন্যান্য ভাষাভাষি মানুষদের এমন সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা উচিত বলেও তাঁরা মনে করছেন।
জানা গিয়েছে, চাইবাসার কাছে সরাইকেলা খরসওয়া জেলার চাণ্ডিলের কান্ডরা মোড়ে ক্ষুদিরাম বসুর মূর্তি স্থাপন করা হয়েছিল। দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে এই মূর্তিটি সেখানে রয়েছে। বছরের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলিতে ক্ষুদিরামের এই মূর্তিতে মাল্যদান করা হয়। অভিযোগ, ১১ অগাস্ট যখন স্থানীয় মহিলারা ক্ষুদিরামের মূর্তিটিতে মাল্যদান করতে যান তখন পুলিশ তাদের আটকে দেয়। বলা হয় প্রশাসনের নির্দেশ রয়েছে তাই মাল্যদান করা যাবে না। এর খানিকক্ষণ পরেই ক্ষুদিরাম বসুর মূর্তিটি ত্রিপল দিয়ে ঢেকে দেয় পুলিশ। অভিযোগ, ১১ অগাস্ট বিকেলে মূর্তিটি উপড়ে ফেলে নিয়ে চলে যায় পুলিশবাহিনী এবং জেলা প্রশাসনের কর্তারা।
এই ঘটনার পর থেকেই শুরু হয় প্রতিবাদ। স্থানীয় জেলা প্রশাসন থেকে শুরু করে মুখ্যমন্ত্রী রঘুবীর দাস-এর দফতরে চিঠি পাঠানো- কোনও কিছুই বাদ রাখা হয়নি। কিন্তু এখনও পর্যন্ত কোনও কোনও সদর্থক পদক্ষেপ ঝাড়খণ্ড সরকার নেয়নি বা বাঙালি সমাজ-কে কোনও বার্তাও দেয়নি। ঝাড়খণ্ড বাঙালি সমিতি-সহ অন্যান্য বাঙালি গণসংগঠন এবং বাঙালি নাগরিক সমাজেরও একাধিক জন প্রধানমন্ত্রীর দফতরে এই নিয়ে চিঠি লিখেছেন। তবু কোনও সুরাহা মেলেনি। সূত্রে খবর ক্ষুদিরামের মূর্তি উপড়ে ফেলে কুর্মি জাতির এক জননায়ক সুধীর মাহাতো-র মূর্তি সেখানে বসানোর তোড়জোড় চলছে। ঝাড়খণ্ডের বাঙালি সমাাজের দাবি, সুধীর মাহাতো-র মূর্তি অন্যত্রও বসানো যেত, তাহলে ক্ষুদিরামের মূর্তি কেন তুলে ফেলল প্রশাসন? এই পুরো বিষয়টি ভোট রাজনীতি বলেই তাঁদের অভিযোগ। সাম্প্রদায়িক এই রাজনৈতিক নোংরামোর বিরুদ্ধে বাঙালিরা গর্জে উঠবে বলেই তাঁরা শপথ নিয়েছেন।
প্রতি সপ্তাহেই বাঙালি সমাজ থেকে বিভিন্ন প্রশাসনিক ভবনে বিক্ষোভ প্রদর্শন ও প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে। ইতিমধ্যেই ঝাড়খণ্ডের রাজধানী রাঁচি-তেও মশাল মিছিল করা হয়েছে। রবিবার মধুপুর প্রশাসনিক ভবনেও একটি বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ জমায়েত করা হয়। সমস্ত বাঙালি গণ সংগঠনগুলির পক্ষ থেকে এক মাস পিটিশনও ঝাড়খণ্ড সরকারের কাছে পাঠানো হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে ঝাড়খণ্ড সরকার বা নরেন্দ্র মোদী সরকার কোনও পদক্ষেপ না নিলে বিধানসভা নির্বাচনও বয়কট করার পথে হাঁটা হবে বলে জানিয়ে দিয়েছেন ঝাড়খণ্ড বাঙালি সমিতির কর্তা বিদ্রোহ মিত্র।