চিনের আস্কারাতেই ভারতের সঙ্গে দূরত্ব বাড়িয়েছিল ভুটান, বাধা পরছে নাগপাশে এবার বুঝেছে থিম্পুও

  • ২০১৮ সালে ভুটানের প্রধানমন্ত্রী হন লোটে শেরিং
  • তারপর থেকেই ভুটানের প্রতি অগ্রসর হচ্ছে চিন
  • ভুটানকে একের পর এক লোভনীয় প্রস্তাব চিনের
  • সম্প্রতি  ভারতীয় কৃষকদের জল দেওয়া বন্ধ করেছে ভুটান

Asianet News Bangla | Published : Jul 6, 2020 5:42 PM IST / Updated: Jul 06 2020, 11:16 PM IST

ডাক্তার থেকে পুরোদস্তুর রাজনীতিবিদে পরিণত হওয়া লোটে শেরিং ২০১৮ সালের  নভেম্বরে ভুটানের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। আর তার পরেই তিনি ভুটানে ভারতের একক কর্তৃত্ব কমাতে উদ্যমী হন। ভুটানের অর্থনীতিকে বহুমুখী করে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে তার নেতৃত্বাধীন দেশের সরকার। আর এই প্রক্রিয়ার গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে চিনের প্রতি অগ্রসর হয়েছে দেশটি। চিনও ভুটানের প্রতি ইতিবাচকভাবে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। এতে প্রতিবেশী দেশটিতে ভারতের তাৎপর্যপূর্ণ বিদেশ নীতি নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।

 

চিন ও ভুটানের মধ্যে ৪৭০ কিলোমিটার স্থল সীমান্ত থাকার পরেও দু’দেশের আনুষ্ঠানিক কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। ভারতে নিযুক্ত চিনের রাষ্ট্রদূতই বিভিন্ন সময়ে ভুটান সফর করেন।এর মধ্য দিয়েই প্রতিবেশী দু’দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক এগিয়ে চলেছে। কিন্তু সাম্প্রচিক সময়ে দেখা গেছে  দিল্লির চিনা রাষ্ট্রদূতকে দফায় দফায় থিম্পু সফর করতে। এমনতি  থিম্পুতে আয়োজন হচ্ছে চাইনিজ স্প্রিং ফেস্টিভ্যাল। এই স্প্রিং ফেস্টিভ্যাল আধুনিক চিনে নববর্ষ উৎসব হিসেবে পালিত হয়। থিম্পুতে চিনা নববর্ষের অনুষ্ঠান আয়োজন ও তাতে চিনা সাংস্কৃতিক কর্মীদের অংশগ্রহণ দু’দেশের মধ্যে সম্পর্ক জোরদারের ইঙ্গিতই দিচ্ছে।

ভুটানের অর্থনীতি বর্তমানে ব্যাপকভাবে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের ওপর নির্ভরশীল। এতে  প্রতিবেশী ভারতের বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ রয়েছে। তবে ভুটানের অভিযোগ,জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে ভারত চড়া সুদে অর্থ দিলেও  উৎপাদিত বিদ্যুৎ তুলনামূলক কম দামে কিনে নিচ্ছে। লোটে শেরিং প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি এই জলবিদ্যুতের ওপর ভুটানের ব্যাপক নির্ভরশীলতা কমানোর উদ্যোগ নিয়েছেন। নির্বাচনী ইশতেহারেও শেরিং ভুটানের অর্থনীতিতে ভারতের ব্যাপক কর্তৃত্বের বিষয়টি তুলে ধরেন। ভুটানের বৈদেশিক বাণিজ্যের ৮০ শতাংশই হয় ভারতের সঙ্গে। আর এই বাণিজ্যের সবচেয়ে বড় উপাদানই  হলো জলবিদ্যুৎ। লোটে শেরিংয়ের দল দ্রুক নিয়ামরুপ তাশোগপা সংক্ষেপে ডিএনটি’র নির্বাচনী ইশতেহারে বলা হয়, ভুটানের অর্থনীতিতে জলবিদ্যুতের মুখ্য ভূমিকার বিষয়টি আমরা স্বীকার করি। কিন্তু এটা জলবায়ু সংক্রান্ত স্পর্শকাতর একটি বিষয়। ভবিষ্যতে ভূ-জলবায়ু নিয়ে সংকট সৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। এই  বিবেচনায় অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে শুধুমাত্র জলবিদ্যুতের ওপর নির্ভর করে থাকা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। এছাড়া, এই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে ভুটানি তরুণরা খুবই সীমিত কর্মসংস্থানের সুযোগ পাচ্ছে।

আরও পড়ুন: ভারত বিরোধী ওলির ক্ষমতা বাঁচাতে মরিয়া চিন, গোপন বৈঠক হল নেপালের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে

ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের ইনস্টিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ভূ-গর্ভস্থ জলের  দিক দিয়ে বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ দেশ হওয়ার পরেও ২০৩০ সাল নাগাদ ভুটানে জল  সংকট সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। এর মূল কারণ হলো দেশটিতে মাত্রাতিরিক্ত জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের উপস্থিতি। ১৯৬১ সালে ভুটানে প্রথমবারের মতো ভারতের আর্থিক সহায়তায় জলবিদ্যুৎ প্রকল্প চালু হয়। এর পর থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভারতীয় কোম্পানি ভুটানে সক্রিয় রয়েছে। পাশাপাশি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে চড়া সুদে ভারতীয় অর্থ গ্রহণ করায়  ভুটানের ঋণ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ ছাড়া, ভারতীয় কোম্পানিগুলো জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বাইরেও বিভিন্ন কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ভুটানের ভূখণ্ডে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র অবস্থিত হওয়ার পরেও দেশটির তরুণরা এতে পর্যাপ্ত চাকরির সুযোগ পাচ্ছে না। বরং ভুটানের এই প্রকল্পে ভারতীয়রা অবাধ কর্মসংস্থানের সুবিধা ভোগ করছে। 

আর বিষয়টি বুঝতে পেরে চিন ক্রমেই ভুটানের প্রতি অগ্রসর হয়েছে। তারপর থেকেই চিনা কূটনীতিকদের আগমন বেড়েছে ভুটানে। এমনকি  চিনের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় থিম্পুকে অংশীদার হওয়ার প্রস্তাবও দিয়েছে বেজিং। তবে এর পরেও কিন্তু চিন নিয়ে দ্বিধাগ্রস্থ ছিল ভুটান। তাই চিন বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে (বিআরআই) সক্রিয় অংশগ্রহণের জন্য ভুটানকে আমন্ত্রণ জানালেও তা উপেক্ষা করেছে দেশটি। ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে শুধুমাত্র ভুটানই বিআরআই প্রকল্পে যোগ দেয়ার লোভনীয় প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছে।

আরও পড়ুন: গালওয়ান থেকে সেনা সরালেও বদলালো না বেজিং, উত্তেজনা বাড়াতে পাকিস্তানকে হামলাকারী ড্রোন উপহার

তবে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর শেরিং দিল্লি সফর করেন। এটি ছিল প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার প্রথম বিদেশ সফর। এসময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ভুটানের দ্বাদশ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় ৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা সহায়তা দেয়ারর  ঘোষণা করেন । একই সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করতে ৪০০ কোটি টাকা  সহায়তা দেওয়ার অঙ্গীকার করেন। সফরে নরেন্দ্র মোদিকে ভুটান সফরের আমন্ত্রণ জানান লোটে শেরিং। সেই ডাকে সারা দিয়ে গত বছরই ভুটান সফর করেন মোদীও। কিন্তু লাদাখ ঘিরে যখন ভারত ও চিনের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ছে তখন নিজের রূপ দেখাতে শুরু করেছিল ভুটানও। সম্প্রতি ভারতের কৃষকদের চাষের জল দেওয়া বন্ধ করে দেয় ভুটান।

ভারতের বাসিন্দা চাষিদের জল অবশ্য আজ থেকে দিচ্ছে না ভুটান। সেই ১৯৫৩ সাল থেকে অসমের বাকসা জেলায় একটি সেচ চ্যানেল দিয়ে এ দেশের কৃষকদের জল দিত ভুটান। আর সেই জল দিয়ে চাষ করেই পেট চলত প্রায় ২৬ গ্রামের চাষিদের। হঠাতই সেই জল দেওয়া বন্ধ করে দিল ভুটান। তাতেই মাথায় হাত পড়েছে  চাষিদের। কীভাবে মিটবে এই সমস্যা, তা নিয়ে কিছুই ভেবে পাচ্ছেন না তাঁরা। প্রতিবেশী দেশগুলিকে নিয়ে ভারতকে চাপে রাখতে এটা চিনা কৌশল বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। 

তবে চিবনের সঙ্গে নৈকট্য যে খুব একটা সুখকর নয় তা এবার টের পাচ্ছে ভুটান। লাল ফৌজের নিশানায় এবার  ভুটান সীমান্তের পূর্ব সেক্টর। ভুটানের সেতাং ওয়াইল্ড লাইফ  স্যাঞ্চুয়ার দখলের অভিযোগ উঠেছে চিনের বিরুদ্ধে। এই নিয়ে দিল্লিতে ভুটান দূতাবাসের সামনে প্রতিবাদ বিক্ষোভও হয়েছে। তারপরেই ভুটান দূতাবাসের পক্ষ থেকে চিনা দূতাবাদে কড়া নোটিস পাঠানো হয়েছে।

সেতাং অভয়ারণ্যে চিনের দখলদারি বরদাস্ত করা হবে না বলে বেজিংকে কড়া ভাষায় চিঠি পাঠিয়েছে ভুটান সরকার।বিষয়টি ভারতের কাছে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, ওই অঞ্চলের সীমান্তে রয়েছে অরুণাচল প্রদেশ। বেজিং ধারাবাহিক ভাবে যার দাবি করে যাচ্ছে।

চিন-ভুটান সীমান্তের পূর্ব সেক্টরের দখল চেয়ে বেজিং প্রকৃতপক্ষে অরুণাচল প্রদেশের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলার কৌশল নিয়েছে কি না, সেটাও খতিয়ে দেখছে সাউথ ব্লক। ১৯৮৪ সাল থেকে সীমান্ত নিয়ে জট ছাড়াতে ভুটান ও চিনের মধ্যে ২৪ রাউন্ড আলোচনা হয়েছে। কিন্তু ভুটানের সংসদ এবং ওই আলোচনার অন্যান্য রেকর্ড বলছে, মধ্য এবং পশ্চিম সেক্টর নিয়ে দু’দেশের মধ্যে মতবিরোধ থাকলেও, পূর্ব সেক্টর নিয়ে কখনও কোনও বিতর্ক ছিল না। অর্থাৎ নতুন করে এটি আমদানি করেছে চিন। আর পূর্ব ভুটানে চিনের এই দখলদারী নিয়েই প্রতিবাদে সরব হয়েছেন ভুটানিরা। 

Share this article
click me!