সিপিেম, বিজেপি-র পক্ষ থেকে সাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহর প্রয়াণে শোকবার্তা প্রকাশ করা হয়েছে টুইট করে। কেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষ থেকে শেষ শ্রদ্ধা জানিয়ে কোনও টুইট নেই?
যেন একে একে নিভিছে দেউটি। গত এক বছরে করোনাভাইরাস মহামারি বহু বিশিষ্ট বাঙালিকেই কেড়ে নিয়েছে। আমাদের ছেড়ে গিয়েছেন সাহিত্যিক শঙ্খ ঘোষ থেকে শুরু করে অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, স্বাতিলেখা হালদার - এমন আরও অনেকেই। এবার চলে গেলেন বুদ্ধদেব গুহও। তবে পার্থক্য হল, অন্যান্য সকল বিশিষ্টজনের মৃত্যুতেই শোকবার্তা প্রকাশ করে টুইট করতে দেখা গিয়েছিল মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। ব্যতিক্রম ঘটল শুধুমাত্র বুদ্ধদেব গুহর ক্ষেত্রেই। এখনও পর্যন্ত প্রয়াত সাহিত্যিককে শেষ শ্রদ্ধা জানিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কোনও টুইট নেই।
কলকাতার এক বেসরকারি হাসপাতালে রবিবার রাত ১১টা ২৫ মিনিট নাগাদ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন, 'মাধুকরী', 'বাবলি', 'চাপরাশ', 'কোয়েলের কাছে', বা 'একটু উষ্ণতার জন্য'র মতো কালজয়ী উপন্যাসের স্রষ্টা। এখনও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে খবর পৌছায়নি এটা হতে পারে না। তার উপর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের টুইটার হ্যান্ডেলও এই সময়ে যথেষ্ট সক্রিয় রয়েছে। জন্মাষ্টমীর শুভেচ্ছা জানানো থেকে শুরু করে এদিন প্যারাঅলিম্পিক্সে পদকজয়ী সকলকে অভিনন্দন জানিয়েছেন তিনি। শুধু, উল্লেখযোগ্যভাবে বাদ পড়েছেন প্রয়াত বুদ্ধদেব গুহই।
বাংলা সাহিত্য জগতে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পর, বুদ্ধদেব গুহর উপন্যাসেই আলাদা এক চরিত্রের ভূমিকা পালন করত প্রকৃতি-অরণ্য। ১৯৭৬ সালে আনন্দ পুরস্কার পেয়েছিলেন তিনি। এতবড় একজন সাহিত্য-প্রতিভাকে কেন ব্রাত্য করে রাখলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়?
আরও পড়ুন - 'মুহূর্তরা মুহুর্তের কাছে ঋণী', সাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহ-র মৃত্যুতে স্মৃতির শহরে ঋত্বিক
আরও পড়ুন - পারলেন না ঋজুদা, মাধুকরীর মোহ-মায়া কাটিয়ে অমৃতলোকে কিংবদন্তি সাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহ
বরাবরই বাম মনোভাবাসম্পন্ন বলে পরিচিত ছিলেন বুদ্ধদেব গুহ। তবে খোলাখুলি কখনও নিজেকে বামপন্থী বা সিপিএম বলে ঘোষণা করেননি প্রয়াত সাহিত্যিক। তবে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা সিপিএম নেতা, সাহিত্যপ্রেমী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গে দারুণ বন্ধুত্ব ছিল তার। সেইসঙ্গে বহু বাম নেতার সঙ্গেই ঘনিষ্ঠতা ছিল। তবে কোনওদিন সিপিএম-এর হয়ে কোনও প্রচারে যাওয়া দূরে থাক, নন্দীগ্রাম পরবর্তী সময়ে যখন বুদ্ধিজীবী মহল দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেল, তখনও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়দের মতো খোলাখুলি বামেদের পক্ষে মুখ খোলেননি তিনি। বরং, অনেকসময় সমালোচনাও করেছেন। সিপিেম-এর পক্ষ থেকে কিন্তু, তাঁর মৃত্যুর পর শোকবার্তা দিয়ে টুইট করা হয়েছে।
এরপর ২০১৮ সালে সাড়া পড়ে গিয়েছিল বঙ্গের বুদ্ধিজীবী মহলে। তার আগে পর্যন্ত এই রাজ্যে একটা ধারণা প্রচলিত ছিল, যে, দীর্ঘদিন বাম শাসনে থাকা বঙ্গীয় বুদ্ধিজীবী সমাজে বিজেপি একেবারে অচ্ছুত। সেই ধারণা ভেঙে দিয়েছিলেন বুদ্ধদেব গুহ। কলকাতায় বঙ্কিমচন্দ্র জাতীয় স্মারক বক্তৃতা দিতে এসেছিলেন বিজেপির তৎকালীন জাতীয় সভাপতি অমিত শাহ। আর সেই ভাষণ শুনতে অমিত্রসুদন ভট্টাচার্য, অচিন্ত্য বিশ্বাস, পূরবী রায়দের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন বুদ্ধদেব গুহও। তার সেখানে উপস্থিতি নিয়ে বহু ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল, লেখক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবী মহল। তবে ওই একবারই, আর কখনও বিজেপির হয়ে কথা বলা তো দূর, বিজেপির কোনও অনুষ্ঠানেও দেখা যায়নি ঋজুদা, ঋভুদার স্রষ্টাকে। বিজেপিও এদিন, টুইট করে তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানিয়েছে।
তাহলে কী প্রথমে বাম এবং পরে রাম ঘনিষ্ঠতার কারণেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে ব্রাত্যই থেকে গেলেন বুদ্ধদেব গুহ? এটা কিছুটা কারণ হলেও, এটাই হয়তো সবটা নয়। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, আমৃত্যু নিজের বাম পরিচয় বহন করেছেন। নন্দীগ্রামের সময় থেকে বারবার মমমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায়ের দলের সমালোচনায় মুখর হয়েছেন। তবে তারপরও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের দেওয়া সম্মান, সুযোগ সুবিধাগুলো গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু, বুদ্ধদেব গুহ-কে কোনও দিনই বাগে আনতে পারেননি তৃণমূল সুপ্রিমো। মমতা সরকারের দেওয়া সম্মান, সুযোগ সুবিধা কিছুই তিনি কখনও নেননি। কোনওদিনই বশ্যতা স্বীকার করেননি।
আসলে, তার প্রয়োজনও ছিল না। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের উজ্জ্বল ছাত্র বুদ্ধদেব গুহ, পেশায় ছিলেন চার্টাড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। ডালহৌসি পাড়ায় তার নিজের চার্টাড অ্যাকাউন্টেন্সি ফার্ম ছিল। কাজেই শিল্পী-সাহিত্যিকদের যে অর্থাভাবে ভুগতে হয়, সেই চিন্তা তাকে কখনই করতে হয়নি। আর ক্ষমতায় অলিন্দে থাকার ইচ্ছা থাকলে, বুদ্ধ ভট্টাচার্ষের সঙ্গে বন্ধুত্বকেই ভাঙাতে পারতেন। সম্ভবত এই কারণেই বাংলা সাহিত্যের অন্যতম উজ্জ্বল ই জ্যোতিষ্কের মৃত্যুর পর ১২ ঘন্টা পেরিয়ে গেলেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তরফ থেকে টুইট করে কোনও শোকবার্তা প্রকাশ করা হল না।