রাজ্যে বিচার প্রক্রিয়াতে বাড়ছে কি মোদী ভক্তদের সংখ্যা? এই প্রশ্ন এখন বড় করে উঠে এসেছে। কারণ এই আশঙ্কার জন্য নাকি আটকে গিয়েছে অন্তত ৮০ জন বিচারকের পদোন্নতি। যা অক্টোবরের মধ্যে কার্যকর করার কথা ছিল। গোটা বিষয়ে রাজ্য সরকারের উপরে কলকাতা হাইকোর্ট এতটাই ক্ষুব্ধ যে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করার তোড়জোড় শুরু হয়েছে। বলতে গেলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করতে চলেছে কলকাতা হাইকোর্ট। আর এই মামলার মূল ফোকাস বিচারকদের আটকে যাওয়া পদোন্নতি।
আরও পড়ুন- জেএনইউ-তে হামলা গণতন্ত্রের লজ্জা, টুইটারে তীব্র ক্ষোভ মমতার
অগাস্ট থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে মোট তিন দফায় তিনটি নোটিফিকেশন ইস্যু করেছিল কলকাতা হাইকোর্ট। এই তিনটি নোটিফিকেশনই ছিল বিচারকদের পদোন্নতি নিয়ে। এরমধ্যে প্রথম মোটিফিকেশনটা জারি করা হয় ছয় অগাস্ট ২০১৯ সালে। যেখানে মোট ৩২ জন বিচারকের নাম জুনিয়র থেকে সিনিয়র পজিশনের জন্য সুপারিশ করা হয়। এমন ভাবে আরও দুটি তালিকা রাজ্য সরকারের কাছে পাঠানো হয়। রাজ্য বিচার ব্যবস্থায় নিয়োগের বিষয়টি দেখে পাবলিক সার্ভিস কমিশন। কিন্তু, এই নিয়োগের মাধ্যমে একবার যিনি বিচার প্রক্রিয়ার কর্মী হিসাবে যোগ দেন তখন তার পদোন্নতি থেকে ট্রান্সফার সমস্তটাই দেখার দায়িত্ব কলকাতা হাইকোর্টের। সংবিধানের এর জন্য বিচার ব্যবস্থা-কে বিশেষ ক্ষমতাও অপর্ণ করা হয়েছে। ফলে ফি বছর রাজ্যে বিচার ব্যবস্থায় পদোন্নতি সংক্রান্ত সমস্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের হাইোকোর্ট। রাজ্য সরকারের কাজ হল সেই তালিকায় থাকা নামগুলিকে গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে প্রকাশ করা এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তা কার্যকর করে দেওয়া। হাইকোর্টের পাঠানো পদোন্নতির তালিকার উপরে খবরদারি করার কোনও এক্তিয়ার রাজ্য সরকারের নেই বলেই দাবি বিচারকদের একাংশের।
আরও পড়ুন- মুখ্যমন্ত্রীর জন্মদিন, রাস্তায় ঘুরে ঢালাও কেক-খাবার বিলি ভবঘুরেদের
এই মোতাবেক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারেরও কলকাতা হাইকোর্টের পাঠানো পদোন্নতির তালিকাকে অক্টোবরের মধ্যে কার্যকর করতে হত। কিন্তু তেমনটা না হওয়ায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের বিরুদ্ধেই সাংবিধানিক অধিকারকে খর্ব করার অভিযোগ উঠেছে। কলকাতা হাইকোর্ট সূত্রে খবর, এই তালিকা নিয়ে রাজ্য সরকারের জুডিশিয়াল সেক্রেটারির সঙ্গে বহুবার কথা বলা হয়েছে কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
সূত্রের খবর কলকাতা হাইকোর্টের পাঠানো তালিকায় এমন কিছু বিচারকের নাম রয়েছে যাদের দেওয়া রায় গত এক বছরের রাজ্য সরকারকে অস্বস্তিতে ফেলেছে। এই সব রায়ের বেশিরভাগটাই ছিল রাজনৈতিক ইস্যুকে নিয়ে। রাজ্য সরকারের আইনমন্ত্রী মলয় ঘটকের নাকি পদোন্নতির তালিকায় থাকা এই নামগুলি নিয়ে আপত্তি রয়েছে। যার জন্য ৮০ জন বিচারকেরই পদোন্নতি আটকে গিয়েছে।
আরও পড়ুন- নিজের জন্মদিনে মমতার শুভেচ্ছা আরও দুই খ্যাতনামাকে, দল করল দুই বড় ঘোষণা
জানা গিয়েছে, যে সব বিচারকের দেওয়া রায় রাজ্য সরকার এবং রাজ্যের শাসক দলের বিরুদ্ধে গিয়েছে এমন ৫ বিচারপতির নাম রয়েছে এই তালিকায়। বিচার ব্যবস্থার একটা অংশের দাবি রাজনৈতিক হিংসা চরিতার্থ করতেই সাংবিধানিক অধিকারকে লঙ্ঘন করার সাহস দেখিয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। আর এর জন্য রাজ্যের আইনমন্ত্রী মলয় ঘটকের দিকেই অভিযোগের আঙুল উঠেছে।
এশিয়ানেট নিউজ বাংলার পক্ষ থেকে আইনমন্ত্রী মলয় ঘটকের সঙ্গে বহুবার কথা বলার চেষ্টা হয়। কিন্তু, প্রতিবারই মলয় ঘটকের সঙ্গীরা মন্ত্রী ব্যস্ত আছেন বলে ফোন কেটে দিয়েছিলেন। শেষমেশ ৪ জানুয়ারি এশিয়ানেট নিউজ বাংলার সিনিয়র এডিটর দেবজ্যোতি চক্রবর্তীর সঙ্গে ফোনে কথা বলেন মলয় ঘটক। কলকাতা হাইকোর্টের বিচারকদের পদোন্নতির কোনও ফাইল তাঁর দপ্তরে আটকে রয়েছে এমন কথা তিনি অস্বীকার করেন। তিনি পরিষ্কার জানিয়ে দেন পদোন্নতি সংক্রান্ত যা যা ফাইল এসেছে তা সমস্তকিছুই তাঁর দপ্তর থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি আরও জানান, বিচারকদের পদোন্নতির যাবতীয় সিদ্ধান্ত সুপ্রিম কোর্টের কলেজিয়াম ঠিক করেন। কিন্তু, তাঁকে যখন বোঝানো হয় এটা জেলা আদালতগুলির পদোন্নতির বিষয় তখন তিনি জানান সোমবার বিষয়টি খোঁজখবর নিয়ে কিছু তথ্য জানাতে পারবেন। নচেৎ রাজ্য জুডিশিয়াল সেক্রেটারির সঙ্গে কথা বলতে হবে।
এশিয়ানেট নিউজ বাংলার পক্ষ থেকে ওয়েস্ট বেঙ্গল জুডিশিয়াল অফিসার্স ডেমোক্র্যাটিক অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গেও যোগাযোগ করা হয়েছিল। এই সভাপতি অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি সিদ্ধার্থ চট্টোপাধ্যায় কোনওভাবেই মলয় ঘটকের বয়ানের সঙ্গে সহমত পোষণ করেননি। তিনি দাবি করেন, সপ্তাহ কয়েক আগেই পদোন্নতি ইস্যুতে একটি সংবাদপত্রে বয়ান দিয়েছিলেন আইনমন্ত্রী। তিনি যদি বিচারকদের পদোন্নতির বিষয়টি না জানেন তাহলে সেই বয়ান দিলেন কী করে? এমনকী, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি সিদ্ধার্থ চট্টোপাধ্যায় এও জানান যে বিষয়টি নিয়ে রাজ্য জুডিশিয়াল সেক্রেটারিকেও একাধিকবার হাইকোর্টের পক্ষ থেকে অবগত করা হয়েছিল। কিন্তু এরপরও রাজ্য সরকার চুপ থেকেছে। তাঁর মতে একটা গেজেট নোটিফিকেশন দিয়ে পদোন্নতির বিষয়টি কার্যকর করার কথা রাজ্য সরকারে। কিন্তু সে সব কিছুই করা হয়নি এখনও পর্যন্ত।
জানা গিয়েছে ৮০ জন বিচারকের পদোন্নতি আটকে যাওয়ায় সবচেয়ে অসুবিধায় পড়বে জেলা আদালতগুলি। কারণ সেখানে বিচারকদের প্রয়োজন রয়েছে। পদোন্নতি পাওয়া বিচারকরা কাজে যোগ দিতে না পারলে কোর্টগুলি বিচারক শূন্য হয়ে থাকবে। এমনিতে প্রতিনিয়ত পাহাড়প্রমাণ মামলার ফাইল জমছে। সুপ্রিম কোর্টের উদ্যোগে রাজ্যে রাজ্যে মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির কথা বলা হচ্ছে এবং এর জন্য বিচারক থেকে শুরু করে আইনজীবীদের নিয়ে কর্মশালাও হচ্ছে। কিন্তু রাজ্য সরকারের প্রতিহিংসা পরায়ণ মনোভাবে রাজ্যে বিচারপ্রক্রিয়া অচলাবস্থা আরও বাড়তে পারে বলেই আশঙ্কা করা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে তাই সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপ ছাড়া বিষয়টি নিস্পত্তি হওয়া কঠিন বলেই মনে করা হচ্ছে। আর সেই কারণে-ই সুপ্রিম কোর্টে মামলার তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছে কলকাতা হাইকোর্টে। এই মাসেই মামলা দায়ের হওয়ার সম্ভাবনা।