রাজ্যে কালো টাকা টাকা নয়ছয় করতে ব্যবহৃত হচ্ছে সিএসআর প্রকল্প? এমন এক আশঙ্কাকে উসকে দিয়েছেন সমাজ ও আইন গবেষক এবং আরটিআই কর্মী বিশ্বনাথ গোস্বামী। চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়ে তিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় এমন এক দাবি করেছেন যা হইচই ফেলে দিয়েছে।
অনুব্রত মণ্ডলের গ্রেফতারির জেরে এক চাঞ্চল্যকর তথ্য সামনে নিয়ে এসেছেন সমাজ ও আইন গবেষক এবং আরটিআই কর্মী বিশ্বনাথ গোস্বামী। তিনি ২০ অগাস্ট একটি বিস্ফোরক ফেসবুক পোস্ট এবং টুইট করেছেন। আর তাতে স্বাধীন ট্রাস্ট এবং সতীর্থ ট্রাস্টের অন্যতম কর্ণধার মলয় পিটের একটি বয়ানের আংশিক অংশ তুলে দিয়েছেন। বিশ্বনাথের দাবি, এপ্রিল মাসে যে মহিন্দ্রা এক্সইউভি-র কালো গাড়িতে চড়ে অনুব্রত মণ্ডল এসএসকেএম-এ প্রবেশ করেছিলেন তার জট ছাড়াতে গিয়েই সামনে আসে এই মলয় পিটের এই বয়ান। বিশ্বনাথ তাঁর এই সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে দাবি করেছেন যে মলয় পিটের এই বয়ানটি একটি বাংলা টেলিভিশন নিউজ চ্যানেলের সাংবাদিকও রেকর্ড করেছিলেন। মলয় পিট এই বয়ানে এত ধরনের প্রভাবশালীর নাম নিয়েছিলেন যে টেলিভিশন নিউজ চ্যানেলটিও পরবর্তী সময়ে এই খবর প্রকাশ থেকে পিছিয়ে যায়। কিন্তু, সিবিআই-এর গ্রেফতারির জেরে এখন সামনে এসে পড়েছে স্বাধীন ট্রাস্ট ও সতীর্থ ট্রাস্টের কর্ণধার মলয় পিটের সঙ্গে অনুব্রত মণ্ডলের যোগাযোগ থাকার বিষয়টি। আর সেই কারণেই তিনি তাঁর কাছে থাকা এই বয়ানটি অনেকটা অংশ ফেসবুকে প্রকাশ করে দিয়েছেন। এর উদ্দেশ্য অবশ্য সাধারণ মানুষের সামনে আনা যে কীভাবে সিএসআর নামক সরকারি এক প্রকল্পকে হাতিয়ার করে রাজনৈতিক দূর্ব্যৃত্তায়ন চলছে। এশিয়ানেট নিউজ বাংলা এই প্রতিবেদন সম্পূর্ণভাবে তুলে ধরেছে বিশ্বনাথ গোস্বামী তাঁর সোশ্যাল পোস্টে কী বলেছেন তার উপরে। এখানে কোনও মতামত এশিয়ানেট নিউজ বাংলা দিচ্ছে না। গরু পাচারকাণ্ডে সিবিআই তদন্ত এবং অনুব্রত মণ্ডলের গ্রেফতারির জেরে রাজ্যে যে একটা দুর্নীতির পাকচক্রের ইঙ্গিত মিলছে-তারই সূত্র ধরে এই খবরকে তুলে ধরা হয়েছে। এশিয়ানেট নিউজ বাংলার পক্ষ থেকে মলয় পিটের সঙ্গেও বহুবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত তাঁর কাছ থেকে কোনও সাড়া পাওয়া যায়নি।
বিশ্বনাথ গোস্বামী যে ফেসবুক পোস্ট করেছেন তাতে তিনি লিখেছেন, মলয় পিঠ নাকি অনুব্রত যে কালো মহিন্দ্রা এক্সইউভি গাড়ি-তে চাপতেন তা নিয়ে জানিয়েছেন, 'একটা ভুল তো হয়েইছে। চরম ভুল। আমাদের ট্রাস্টে প্রচুর গাড়ি আছে , যা অন্য লোকের নামে আছে। বিভিন্ন লোকে চাপে। এইটা যে ট্রাস্ট্রের নামে আছে তা মাথাতেই নেই।'
মলয় পিট এই মুহূর্তে বীরভূমের বুকে এক প্রভাবশালী ব্যবসায়ী। যিনি গত এক দশকে উল্কার গতিতে রাজ্যে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণে এবং ব্যবসায় এক অসামান্য সাফল্যের মুখ দেখেছেন। এই মুহূর্তে তাঁর অধীনে অন্তত শখানেক স্কুল-কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, বিএড কলেজ, পিটিটিআই প্রতিষ্ঠান, নার্সিং ইনস্টিটিউট, আইআইটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান,ইন্টারন্যাশনাল স্কুল রয়েছে। আর মলয় পিটের এই বিশাল ব্যবসার সাম্রাজ্য ছড়িয়ে রয়েছে বাংলা থেকে শুরু করে ত্রিপুরা, অসম, মেঘালয়, মিজোরম, বিহার, ঝাড়খণ্ড, হরিয়ানা, দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ-সহ আরও একাধিক রাজ্যে।
২০০৭ থেকে ২০০৮ সালে গুসকরায় শেফালি মেমোরিয়াল ট্রাস্ট্রের অধীনে একটি পিটিটিআই কলেজ খুলে যাত্রা শুরু করেছিলেন। জন্ম এবং বেড়ে ওঠা পূর্ব বর্ধমানের গুসকরা এলাকাতেই। পড়াশোনার যে বিশালরকমের কৃতি ছিলেন মলয় পিট এমন তথ্য এখনও এশিয়ানেট নিউজ বাংলার হাতে আসেনি। কিন্তু, শুরু থেকেই তিনি তৎকালীন সিপিএম জামানার বেশকিছু নেতাকে তাঁর এই ব্যবসা উদ্যোগে সামিল করেছিলেন। শেফালি মেমোরিয়াল ট্রাস্টেও নাকি নিয়ে এসেছিলেন এলাকার বহু ব্যবসায়ীর বিনিয়োগ শুধুমাত্র তাঁর রাজনৈতিক কানেকশনকে কাজে লাগিয়ে। বীরভূমের প্রভাবশালী সিপিএম নেতা দিলীপ গঙ্গোপাধ্যায়ের আশীর্বাদও একটা সময় পেয়েছিলেন মলয় পিট। দিলীপ গঙ্গোপাধ্যায়ের ছেলেকে তাঁর এই ব্যবসায়িক উদ্যোগে সামিল করেছিলেন মলয় পিট।
সবচেয়ে যেটা অবাক করেছে মলয় পিটের উত্থান। এ যেন এক রূপকথার গল্পের মতো। স্বাভাবিকভাবেই এই নিয়ে নানা সময়ে কৌতুহল তৈরি হলেও কেউ-ই মলয় পিটের প্রভাব-প্রতিপত্তি নিয়ে প্রকাশ্যে মুখ খুলতে সাহস করেননি। অনুব্রত-র গ্রেফতারির পরও তিনি তাঁর ঘনিষ্ট মহলে বলেছেন যে রাজনৈতিক চাপ তো ব্যবসায়ীদের উপরে থাকে, কিন্তু তিনি যে উদ্যোগপতি হিসাবে যে বিশাল সাম্রাজ্য খাড়া করেছেন তার সিংহভাগই নাকি ব্যবসায় লাভ করা অর্থ থেকে। কিন্তু, এখানেও একটা প্রশ্ন রয়েছে, যে বোলপুরে মেডিক্যাল কলেজ তৈরির উদ্যোগে জল পড়ে যখন তা রামপুরহাটকে দিয়ে দেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায় তখন। অথচ, এরপরও মাত্র ১ বছরের মধ্যে সরকারেরর সাহায্য নিয়েই বোলপুরে মেডিক্যাল কলেজ খাড়া করেছেন মলয় পিট।
সমাজ ও আইন গবেষক এবং আরটিআই কর্মী বিশ্বনাথ গোস্বামী ফেসবুক পোস্টে এই মেডিক্যাল কলেজ তৈরি নিয়ে মলয় পিট কী বলেছিলেন তাঁর বয়ানে তাও তুলে ধরেছেন। বিশ্বনাথ গোস্বামী লিখেছেন, '১১ মাসে একটি কলেজ নামানো মামুলি বিষয় নয়। একটা মেডিক্যাল কলেজ নামানো, তাও আবার এখান থেকে। সবাই বলে কেস্ট মণ্ডলের সাপোর্ট আছে। আরে কেস্ট মণ্ডল তো ছোট নেতা। ভাইপো থেকে ফিরহাদ পর্যন্ত সবারই শখ আছে এই মেডিক্যাল কলেজে। কোন বেটা করেছে। কার কি অভাব আছে? মলয় ঘটক থেকে ফিরহাদ! কার ইচ্ছে নেই যে একটা মেডিক্যাল কলেজ হোক!'
কিন্তু প্রশ্ন উঠছে মলয় পিটের একাধিক ট্রাস্টকে ঘিরে। বর্তমানে মলয় পিটের সবচেয়ে বড় ট্রাস্টের নাম স্বাধীন ট্রাস্ট। এই ট্রাস্টের অধীনে যেমন রয়েছে শান্তিনিকেতন ইনস্টিটিউট অফ পলিটেকনিক। এছাড়াও এই স্বাধীন গ্রুপের হাতে রয়েছে জেনারেল এডুকেশন সেক্টর বিভাগে অন্তত শান্তিনিকেতন বিএড কলেজ। শান্তিনিকেতন ডিএড কলেজ। এছাড়াও রয়েছে সিউড়ি ইন্টারন্য়াশনাল স্কুল, বীরভূম মডেল মাদ্রাসা। মেডিক্যাল সেক্টরে রয়েছে তিনটি প্রতিষ্ঠান। স্কিল ডেভলপমেন্টে রয়েছে আরও ২টি প্রতিষ্ঠান। শান্তিনিকেতন, ত্রিপুরা ও আন্দামানে নিজস্ব আইটিআই কলেজ। এছাড়াও রাজ্যের ১০টি সরকারি আইটিআই কলেজের সঙ্গে পিপিপি মডেলে পরিচালনার অংশিদারিত্ব। পিপিপি মডেলে নর্থ সিকিম ও মিজোরমেও মলয় পিটের এই স্বাধীন গ্রুপ আইটিআই কলেজ নিয়ে কাজ করছে। এর বাইরেও শেফালি মেমোরিয়াল-এর নামে গোবিন্দপুর ও গুসকরায় যে একাধিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তাও রয়েছে স্বাধীন ট্রাস্টের অধীনে। এই স্বাধীন ট্রাস্ট ছাড়াও রয়েছে সতীর্থ নামে একটি চ্যারিটেবল ট্রাস্ট। এই ট্রাস্ট একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা বলে নিজেকে পরিচয় দিয়ে থাকে। এর কাজ স্কিল ডেভলপমেন্ট। কোনও কর্পোরেট সংস্থা বা সরকারি কোনও প্রকল্পে এরা বিভিন্ন স্কিল ডেভলপমেন্ট ট্রেনিং-এর পরিষেবা দিয়ে নিজেদের সংযুক্ত করে থাকে। বিশ্বনাথ গোস্বামী তাঁর সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে দেখিয়েছেন যে, মলয় পিট দাবি করেছেন যে তাঁর প্রতিষ্ঠান তৈরির মূল বিনিয়োগটাই আসে সিএসআর-এর মাধ্যমে। এমনকী এই সিএসআর অর্থ তাঁরাই দানকারিদের দিয়ে থাকেন বলে মলয় পিট নাকি বয়ানে জানিয়েছেন বলে দাবি করেছেন বিশ্বনাথ গোস্বামী।
সমাজ ও আইন গবেষক এবং আরটিআই কর্মী বিশ্বনাথ গোস্বামী ফেসবুক পোস্টে লিখছেন, মলয় পিট-কে কোট আনকোট করে- 'মেডিক্যাল কলেজে সিবিআই ঢুকে দেখুক না। ওখানে ৪০০ কোটি টাকার সিএসআর ফান্ড দেখানো আছে। লোকের থেকে সিএসআর ফান্ড নিয়েছি। কিন্তু তার কাছে তো বেশি টাকা নেই। তাকে ক্যাশ টাকা দিয়েছি। তার থেকে ফান্ড নিয়েছি। তারই প্রফিট। আমি আপনাকে ৫ কোটি টাকা দিলাম। আপনি আমাকে সিএসআর ফান্ড দিলেন। আমাদেরকে ধরা যাবে না। রেকর্ড তো কিছু নেই।'
দীর্ঘদিন ধরেই বাংলায় সিএসআর ফান্ড দিয়ে বিভিন্ন উন্নয়নের কাজ নিয়ে অভিযোগ সামনে আসছে। বিশ্বনাথ গোস্বামীর সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে মলয় পিট-এর বয়ানে সত্য যদি সত্যতা প্রমাণ হয় তাহলে বুঝতে হবে যে কীভাবে অসাধু চক্র সমাজের মধ্যে ক্যানসারের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। রাজনীতিতে প্রবেশের আগে অনুব্রত মণ্ডলের যে বিশাল কোনও সমপত্তি রয়েছে এমন কোনও প্রমাণ পাওয়া যায় না। উল্টে রাজনীতিতে প্রবেশের আগে অনুব্রত মণ্ডলের পেশা নিয়ে যে একের পর এক তথ্য সামনে আসছে তাতে সাধারণ মানুষের চোখ কপালে উঠেছে। রাজনৈতিক প্রতিপত্তিতে আজ অর্থনৈতিকভাবে অনুব্রত মণ্ডলরা ফুলে ফেঁপে উঠছেন তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু, এই অনৈতিক উপায়ে সম্পদ তৈরি এবং তার পিছনে যে সব কুশীলবরা রয়েছে তাদের সন্ধান কি আদৌ পাওয়া যাবে! কারণ এই নিয়ে একাধিক রাজনৈতিক নেতারা নানা সময়ে দুর্নীতি-র কেষ্টবিষ্টুদের পর্দা ফাঁস করার প্রতিশ্রুতি দিলেও, আদপে হাতের বাইরে থেকে গিয়েছেন ঘটনার মূল চরিত্ররা। গত ১০ বছরে যদি রাজ্যে ওঠা একাধিক দুর্নীতির তদন্তের দিকে তাকানো যায়, তাহলে দেখা যাচ্ছে আসলে শ্রীঘরে বাস হচ্ছে মদন মিত্র, কুণাল ঘোষ, পার্থ চট্টোপাধ্য়ায়, অনুব্রত মণ্ডলদের। কিন্তু দুর্নীতির শিখরের চরিত্রগুলো টেনে সমাজের সামনে বেআব্রু করা যাচ্ছে না। সন্দেহ নেই সমাজ ও আইন গবেষক এবং আরটিআই কর্মী বিশ্বনাথ গোস্বামীর পোস্ট গরু পাচারকাণ্ডে আরও এক দুর্নীতির আশঙ্কাকে উসকে দিয়েছে।