পরিবেশকর্মী ও বন্য়প্রাণী অধিকার আন্দোলনের কর্মী হীরক নন্দীর মুখোমুখি সবুজ মুখোপাধ্য়ায়।
সবুজ-- কোন্ননগরে বাঘরোল দেখা দেওয়া নিয়ে তো সেদিন খুব হইচই হল। প্রথমে সবাই বাঘ-বাঘ বলে চিৎকার করল, তারপর পর শোনা গেল বাঘরোল। তারপর তো কত কাণ্ড। শুনেছি, বাঘরোল নাকি আমাদের স্টেট অ্য়ানিমাল ?
হীরক-- হ্য়াঁ। বাঘরোলকে আমাদের স্টেট অ্য়ানিম্য়াল বা রাজ্য় পশু বলা যেতেই পারে। যেমন জাতীয় পশু, তেমন রাজ্য় পশু।
সবুজ-- তা, বাঘরোল এত লোকালয়ে চলে আসছে কেন এখন?
হীরক-- দেখুন, সেদিন তো কোন্ননগরে বাঘরোল বেরিয়েছিল। হাওড়া বা হুগলিতে কিন্তু বাঘরোল চিরকালই খুব বেশি ছিল সংখ্য়ায়। ওখানে ওদের খুব প্রিয় বাসস্থান ছিল হোগলা বন বা খড়িবন। ওরা ওইসব জায়গাতেই থাকতে পছন্দ করত। বিশেষ করে জলাভূমির কাছের বনগুলোতে। এখন জলাভূমি কমে গিয়েছে। হোগলা বনও কেটে ফেলা হচ্ছে। আগে লোকালয়ের মধ্য়ে আসার সেভাবে দরকার পড়ত না। এখন সবই পাল্টে যাচ্ছে। প্রসঙ্গত বলি, আমি যেখানে থাকি, কলকাতার সেই গল্ফক্লাব অঞ্চলে চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগেও নাকি বাঘরোলের দেখা মিলত। এখনও সেখানে জাঙ্গল ক্য়াট দেখা দেয়। হাড়োয়ার দিকে, ভেড়িটেরিগুলো যেখানে আছে, পূর্ব কলকাতার জলাভূমি যেখানে আছে, সেখানেও বাঘরোল রয়েছে। গ্রামেগঞ্জে বাঘরোল মাঝেমধ্য়েই ঢুকে আসে ও হাস-মুরগি মারে। তবে এরা অত্য়ন্ত শক্তিশালী হলেও, কোণঠাসা হয়ে গেলে ভয়ানক জন্তু হয়ে গেলেও, মানুষের সাধারণত কোনও ক্ষতি করে না। অন্তত মানুষকে আক্রমণ করেছে বলে প্রায় শোনাই যায় না। যেহেতু রাতে ঢোকে তাই লোকজন সচরাচত টের পায় না। চোখের সামনে পড়ে না। এখন আশপাশে শহর বেড়ে যাওয়ায়, ওদের বাসস্থানে হাত পড়ছে। শুধু বাঘরোল নয়, অধিকাংশ জন্তুর ক্ষেত্রেই এটা মূল কারণ, ওদের বাসস্থানের সংকোচিত হচ্ছে। সেইসঙ্গে আমাদের অর্থনৈতিক কাজকর্মও বেড়ে যাচ্ছে। হাওড়া হুগলিতে যে হোগলা বনগুলো ওদের পছন্দ ছিল, সেগুলো কেটে নেওয়া হচ্ছে। জলাভূমিও কমে আসছে ক্রমশ।
সবুজ-- কিন্তু এখন এই যে এত হইচই, আগে তো তেমনটা হত না।
হীরক-- আগে ওদের দেখা গেলেও নাড়াচাড়া বেশি হচ্ছে এখন। লোকে মোবাইলে দেখে ছবি তুলে নিচ্ছে। তারপর ফরোয়ার্ড করছে, 'এখানে এই জন্তুটাকে দেখেছি'। আগে আমরা এগুলো জানতে পারতাম খুব কম। এখন মিডিয়া জেনে যাচ্ছে। অথচ গ্রামে কিন্তু ওরা বরাবরই ঢুকত।
সবুজ-- এই বাঘরোলের সঙ্গে বাঘকে গুলিয়ে ফেলা হচ্ছে কেন। এরা কি তাহলে বাঘের মতো শক্তিশালী?
হীরক-- না, বাঘের মতো শক্তিশালী নয় এরা। তবে ফিশিং ক্য়াট নাম হলেও বেড়ালের থেকে অনেক তাগড়াই চেহারার, গাট্টাগোট্টা। এরা গ্রামে ঢুকে হাস-মুরগি মেরে খায়। গরু মারতে না-পারলেও বাছুর মারার রেকর্ড আছে বাঘরোলের। পুরুষ বাঘরোলের শরীরটাই তো তিনফুটের বেশি চওড়া হয়। অনেকে যেমন ভুল করে এদের বাঘ মনে করে, অনেকে তেমন জেনেশুনেও এদের বাঘরোল বলে চালাতে চায়।
সবুজ-- সে আবার কেমন ব্য়াপার?
হীরক-- তাহলে বলি। মনে আছে ১৯৮৬ কি ১৯৮৭ সাল হবে বোধহয়। আমি আর দীপকদা (সর্পবিদ দীপক মিত্র) খবর পেলাম হাওড়াতে এক জায়গায় দুটো বাঘ মারা হয়েছে। সম্ভবত পাঁচলা থানায়। এদিকে আমরা গিয়ে দেখলাম, দুটো বাঘরোল মেরে তাদের চামড়া ঝুলিয়ে দিয়েছেন স্থানীয় মানুষজন। স্থানীয়রা আসলে বাঘ মেরেছেন বলে তার পুরস্কার দাবি করছেন। তা, বিডিও ওঁদের বলেছিলেন, আপনারা থানায় যান, ওখান থেকেই পুরস্কার পাওয়া যাবে। সেইসময়ে মনে আছে, থানার ওসি বন্য়প্রাণী আইনের কথা জানতেন। যা অত বছর আগে অতটা প্রত্য়াশিত ছিল না। ওসি ওঁদের বললেন, তোমরা বাঘ মেরেছো তো পুরস্কার নেবে কি, তোমাদের লকআপে পুরে দেওয়ার কথা।
সবুজ-- বাহ। বেশ ইন্টারেস্টিং ঘটনা তো। আচ্ছা একটা কথা, বাঘের মতো তো আর মানুষের ওপর হালুম-হুলুম করে লাফিয়ে পড়ে না বাঘরোল। তা-ও সত্ত্বেও এত বাঘরোল পিটিয়ে মারার ঘটনা বাড়ছে কেন এখন?
হীরক-- আসলে আমার মনে হয়, লোকজনের পিটিয়ে মারার প্রবণতা বেড়েছে। বাঘরোল মারার জন্য় যদি কাউকে শাস্তি দেওয়া হত, তাহলে হয়তো লোকে বুঝত কাজটা ঠিক নয়। বড়জোর একটু ধমট-টমক দিয়ে ছেডে় দেওয়া হয় কি তা-ও হয় না। বাঘরোলের মতো একটা শিডিউল ওয়ান প্রাণীকে মারার যে শাস্তি, বাঘমারার যে শাস্তি তার সমান। মানে তিন থেকে সাতবছর পর্যন্ত জেল। মনে রাখতে হবে বাঘরোলও কিন্তু বিপন্ন। তাই বন্য়প্রাণী আইনের শিডিউল ওয়ানে রাখা হয়েছে একে। আসলে মানুষকে আক্রমণ না করলেও ওরা যেহেতু হাসমুরগি তুলে নিয়ে যায়, তাই ওদের ওপর একটা আক্রোশ তো থাকেই। তাছাড়া মানুষের মনস্তত্ত্বই এখন এমন হয়েছে, একজন পকেটমার পাওয়া গেল তো তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হল। অসহায় অথচ পরাক্রান্ত জন্তুকে পিটিয়ে মারার মধ্য়েও নিজের অপ্রাপ্তিগুলো বেরিয়ে আসে। এইসব মিলে বোধহয় পিটিয়ে মারার ঘটনা বাড়ছে। আগে কিন্তু বাঘরোলদের এত পিটিয়ে মারা হত না। বরং হাওড়া হুগলি অঞ্চলে বাঘরোল গাড়ি চাপা পড়ে মারা যায় হাইওয়েতে।