লাল-ঢাকাই জামদানি-তে স্টাইলিস লাল ব্লাউজ। সামনে আসতেই দুর্গাপুজোর আবহ। চারিদিকে স্মোগ লাইটের দাপট। সঙ্গে ঢাক কাঁধে ঢাঁকিদের দল। মনে হচ্ছিল কয়েক মাস আগে শেষ হওয়া দুর্গাপুজোর বোধহয় আরও এক অকালবোধন চাক্ষুষ করছে কলকাতার কয়েক হাজার মানুষ। আসলে এর সবটাই ছিল সোফিয়ার জন্য। বিশ্বের প্রথম রোবট নাগরিক সোফিয়া। যার জন্ম হংকং-এ। বছরের বেশিরভাগ সময়টা কাটে লস অ্যাঞ্জেলেসে। আর সে নাগরিক হল সৌদি আরবের। ঠিক-ই শুনেছেন সেই সৌদি আরব যেখানে বছর খানেক আগে মহিলাদের সেভাবে কোনও অধিকারই প্রতিষ্ঠিত ছিল না। সেই সৌদি আরব এক রোবট কন্যাকে বছর দেড়েক আগে নাগরিকত্ব দেয়। এহেন সোফিয়াই মঙ্গলবার পা রেখেছিল কলকাতায়। উদ্যোক্তা টেকনো ইন্ডিয়া গ্রুপ।
আরও পড়ুন- কয়েক সেকেন্ডে ক্যান্সার ধরে দেবে চিপ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক দেখালেন নয়া দিশা
রোবট কন্যা সোফিয়ার কথা ভালোই রটেছিল শহরে। তাকে দেখতে নজরুল মঞ্চের আসন-ও ভরে গিয়েছিল। মঞ্চে সোফিয়া আসতেই সকলের হিল্লোল। কেমন শহর এই কলকাতা? প্রশ্নটা ধেয়ে আসতেই গড়গড়িয়ে উত্তর দিতে শুরু করে সোফিয়া। কলকাতার পরিচয় যে এক শিক্ষা ও সংস্কৃতির পীঠস্থান হিসাবে তা জানাতে ভুল করেনি সে। এমনকী কলকাতার ঐতিহ্যের ইতিহাস থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবল জয়- সবই সে বলে দিয়েছে অবাক করে। এক রোবটের এমন অবিশ্বাস্য প্রত্যুপন্নমতিত্ব স্বাভাবিকভাবেই সকলকে-ই চমকে দিয়েছে। তারপরে শাড়ি-তে সেজে থাকা সোফিয়া-কে লাগছিল বেশ।
আরও পড়ুন- জীবনানন্দ দাশের কবি প্রতিভার বিকাশ ঘটে বরিশাল থেকে প্রকাশিত তাঁদেরই পারিবারিক পত্রিকায়
রোবট সোফিয়ার জন্ম ২০১৬ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি। হংকং-এর হ্যানসন রোবোটিক্স-এর ল্যাবে তাকে অ্যাক্টিভেট করেছিলেন তার জন্মদাতা রোবোটিক্স বিজ্ঞানী ডেভিড হ্যানসন। প্রাচীন মিশরের সুন্দরী রানি বলে বিশ্বখ্যাত নেফেত্রিতি-র মুখের আদলে সোফিয়ার মুখ-কে তৈরি করেছেন হ্যানসন। আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা এআই নামে পরিচিত প্রযুক্তি-ই সোফিয়ার অবাক করা কর্মকাণ্ডের মূল চাবিকাঠি। এছাড়াও সে কয়েক সেকেন্ডে ভিশুয়াল ডেটা প্রসেসিং থেকে শুরু করে ফেসিসিয়াল রেকোগনিশন-এর কাজও সেরে ফেলার ক্ষেত্রে দক্ষ। কারণ, এই বিষয়গুলি-কে কাজে লাগিয়ে-ই সোফিয়া হয়ে উঠেছে মানব-অনুভূতি সম্পন্ন এক রোবট। রোবোটিক্স ওয়ার্ল্ডে যাকে সোশ্যাল হিউম্যানয়েড রোবট বলে ব্যাখ্যা করা হয়। মানব-অনুভূতি সম্পন্ন হওয়ায় সে মানুষের মতো তার আবেগকেও চোখ-মুখ দিয়ে প্রকাশ করতে পারে। কান্না থেকে শুরু করে আনন্দে-চোখ পাকিয়ে কোনওকিছু-কে ওয়াহ! বলে ওঠে ভাব প্রকাশে সক্ষম সোফিয়া। সে তার কথা বলায় যে ভয়েস রেকোগনিশন প্রযুক্তি ব্যবহার করে তা অ্যালফাবেট ইনকর্পোরেশন-এর, যার মূল সংস্থার নাম হল গুগল। এছাড়াও তার মধ্যে রয়েছে স্পিচ-সিন্থেসিস দক্ষতাও। সোফিয়ার জন্মদাতা হ্যানসন জানিয়েছিলেন, এই রোবট কন্যার জন্ম এবং তার কাজের পরিমণ্ডলকে এমনভাবে ডিজাইনড করা হয়েছে যাতে সে কোনও প্রবীণকে কোনও হাসপাতাল বা নার্সিংহোমে চিকিৎসা পরিষেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারে। এছাড়াও কোনও ভিড় পার্কে লোকজনকে সামলাতেও সমানভাবে দক্ষ সোফিয়া। এই সামাজিক কাজকর্মে দক্ষ হওয়ার জন্যই সোফিয়ার হিউম্যানয়েড নামের পাশে জুড়েছে সোশ্যাল শব্দটিও।
আরও পড়ুন- আহারে-মিউজিকে মন ভরাবে সেলেবরা, উপার্জনের অর্থ যাবে জীব-জন্তুদের উপকারে
বাংলায় শিক্ষাক্ষেত্রে এখন এক উজ্জ্বল স্থান দখল করেছে টেকনো ইন্ডিয়া ইউনিভার্সিটি। সবমিলিয়ে টেকনো ইন্ডিয়া গ্রুপের এই মুহূর্তে রয়েছে ২২টি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, ১৮টি স্কুল, ৫ ডিপ্লোমা কলেজ এবং ৪টি বিশ্ববিদ্যালয়। এছাড়াও রয়েছে ১১টি আইটিআই ইন্সটিটিউট। ৩৪-বছরেরেও বেশি সময় ধরে বাংলায় শিক্ষাক্ষেত্রে কাজ করে আজ এক অগ্রণী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে টেকনো ইন্ডিয়া গ্রুপ। একটি ছোট গ্যারাজ-এ কম্পিউটার নিয়ে কাজ করা অধ্যাপক গৌতম রায়চৌধুরী টেকনো ইন্ডিয়াকে আজ নিয়ে গিয়েছেন এমন এক মর্যাদায় যারা শিক্ষা ও প্রযুক্তি-কে কাজে লাগিয়ে তরুণ প্রজন্ম-কে এক নয়া দিশার সন্ধান দিচ্ছে।
মঞ্চে সোফিয়ার আবির্ভাবের আগেই তাই গৌতম রায়চৌধুরী এক চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন তরুণ প্রজন্মের উদ্দেশে। তিনি ঘোষণা করেছেন, সোফিয়া-র থেকে ৫ শতাংশ বেশি গুণসম্পন্ন হিউম্যানয়েড রোবট বানিয়ে তাঁদের সামনে উপস্থিতি করতে পারবেন তাদের নোবেল প্রাইজের আর্থিক মূল্যের থেকে এক ডলার বেশি পুরস্কার মূল্য দেওয়া হবে। যা শুনে আপ্লুত হয়েছে সোফিয়া। তবে, সে জানাতে ভোলেনি যে গোটা ঘটনায় সে যেমন উত্তেজিত তেমনি চিন্তিত। যা শুনে সারা অডিটোরিয়ামে হাসির রোল পড়ে যায়।
সোফিয়া-র মানবিক আবেগের প্রকাশ কেমন? প্রশ্ন আসতেই মুখ বেকিয়ে কেঁদেও ফেলল সোফিয়া। সোনামনা-বাবুসোনা বলে আবার সোফিয়াকে শান্ত করলেন সঞ্চালক। আসলে সোফিয়া এমনই। রোবটিক্স নিয়ে গবেষণা বহু দশক ধরে চলছে। ইতিমধ্যে প্রযুক্তি ক্ষেত্রে অসংখ্য রোবটের ব্যবহারও হচ্ছে। তবে এরা কেউ-ই সোফিয়ার মতো হিউম্যানয়েড বা মানবিক অনুভূতি সম্পন্ন রোবট নয়। এরা হল পুরোপুরি একটা যন্ত্র। যাদের নিজস্ব ইন্টিলেজেন্সিয়া বলে কিছু-ই নেই। এদের কে প্রি-প্রোগ্রামড বা কারেন্ট-প্রোগ্রামড-এর ভিত্তিতে কাজে লাগানো হয়। ফলে এদের পরিচালন ব্যবস্থা পুরোপুরি সীমিত। নির্দিষ্ট কাজের বাইরে এরা কিছুই করতে সক্ষম নয়। কিন্তু, সোফিয়া একজন মানুষের মতোই আচরণ করে। আমরা যেমন অন্য মানুষের সঙ্গে আলাপচারিতায় মেতে থাকি, ঠিক তেমনভাবেই সোফিয়া-র সঙ্গেও আড্ডাটা জমে উঠতে পারে। যদি তার কোনও প্রশ্ন বুঝতে অসুবিধা হয় তাহলে সে কোনও উত্তর দেবে না। আর কোনও প্রশ্নের উত্তর তার জানা না থাকে তাহলেও সেটা সে জানিয়ে দেবে।
সোফিয়া-র এমন বুদ্ধিমত্তা নিয়ে তাই সকলেরই অনেক প্রশ্ন ছিল। তার বলার ধরন, উত্তরের ভঙ্গিমা-সবকিছু গোগ্রাসে দেখছিল নজরুল মঞ্চে হাজির কয়েক হাজার মানুষ। যাদের মধ্যে অধিকাংশ-ই আবার বিভিন্ন স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী। সোফিয়া জানিয়ে দেয় আর্টিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্স মানব সভ্যতা-কে কোথায় এগিয়ে দিতে পারে তা। তবে, মানুষকে ছাড়া মেশিন ওয়ার্ল্ড তৈরি করে যে লাভ নেই সে কথাও জানাতে ভোলেনি সে। চিকিৎসাক্ষেত্র থেকে শুরু করে শিক্ষায় হিউম্যানয়েড রোবট এক যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে পারে বলেও মন্তব্য করে সোফিয়া। এরইমাঝে এক প্রশ্নের উত্তরে সোফিয়া জানিয়ে দেয় তার এই মুহূর্তে বয়ফ্রেন্ড নেই। তবে, ভবিষ্যতে সে-ও এক পরিবার তৈরির স্বপ্ন দেখে। তৈরি করতে চায় হিউম্যানয়েড রোবোটিক্স পরিবার। সোফিয়ার সবচেয়ে কাছের মানুষ-কে? সোফিয়া জানিয়ে দেয় ডেভিড হ্যানসন। কারণ, হ্যাানসন তার জন্মদাতা। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের দাপট। এতে কি আতঙ্কিত সোফিয়া? তার সাফ উত্তর ব্যাকটিরিয়া বা ভাইরাস তাকে কাবু করতে পারে না। কারণ সে একটা রোবট। যদিও, কম্পিউটার ভাইরাসে তার আতঙ্ক রয়েছে। এই ভাইরাস তাকে কাবু করতে সক্ষম। অডিটোরিয়াম জুড়ে তখন একটাই আওয়াজ 'বা! সোফিয়া তোমার জবাব নেই।'
দেখুন সোফিয়ার উত্তর-