'খিদে একটা জ্যান্ত জিনের মতো', ছোটগল্প-- 'ইঁদারা', গল্পকার-- সোনালী চক্রবর্তী

বেলা এগারোটার কিছু আগে মালিকের গুদামের কাছে এসে পৌঁছায় রাম৷ গুদামের কাছেই গুমটি ঘরের সামনে লম্বা লাইন৷ মাথা তুলে আরও একবার আকাশটাকে জরিপ করে সে, অভিজ্ঞ চোখ বুঝে যায় হিসেব নিকেশ করে তার নম্বর লাগতে বেলা গড়িয়ে দুপুর হবে, তারই ভিতর বেশ কয়েকবার গদি ছেড়ে উঠবে মালিক৷ 
 

Asianet News Bangla | Published : Jun 27, 2021 5:00 AM IST

কপালের ওপর হাতটা দিয়ে চোখটা আড়াল করে আরেকবার আকাশের দিকে তাকিয়ে আন্দোরাম ৷ চোখ বুজে আসে ঝাঁঝালো রোদের ধারে… আজও জল ঢালবে না বেইমান দেবতা৷ গত কদিন ধরে কম পুজো তো হল না— আচার, আয়োজন, ফুল, মালা, বেল, নারকেল দিয়ে সাজানো নৈবেদ্য সবই বৃথা, এমনকি মেয়ে-বউদের কাপালপান্ডাম মানে ব্যাঙের বিয়ে তা-ও প্রায় মোড়ল কাটিহারের বাড়িতে এই মাসে নয় নয় করে তিনবার হয়ে গেল৷ মাথা ঝাঁকায় আন্দোরাম, এমন রুখাশুখা পানির দেবতা শুধু কি তাদের দেশেই! ভাবতে ভাবতেই পা চালাতে থাকে সে, থামলে তো চলবে না, আজ তাকে যে করেই হোক কিছু পাওনা টাকা নিতে হবে মালিকের থেকে৷ সুকুদাই বলেছে লক্ষণ ভালো নয়, হয়তো আজ রাতের মধ্যেই গঙ্গামা সন্তানের জন্ম দেবে৷ বার বার তিনবার— এই তৃতীয়বারও যদি জন্মের পর তার গর্ভস্থ শিশুটি নষ্ট হয় গলায় দড়ি দেবার হুমকি দিয়ে রেখেছে গঙ্গাম্মা৷ বুড়ি সুকুমতি পই পই করে বলেছে— বউয়ের রক্ত কম, নাড়িও দুর্বল, তাই বাড়িতে এবার কতটা সামলানো যাবে তা বলা মুশকিল৷ হাতে যেন টাকা রাখে রাম, সদর যেতে হতে পারে, গাড়ি লাগবে, বেশ দূরের রাস্তা৷ চিন্তার জট যত শক্ত হয়, পা-ও যেন আটকে আটকে আসে আন্দোরামের৷ আজ হতচ্ছাড়া আকাশ একটুকরো মেঘের আড়ালও দেয়নি, এমনকি গাছগুলো কেমন একটা খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ যেন সমস্ত পাতাগুলো তার কোমলতা হারিয়ে শক্ত আর সিঁটিয়ে আছে কোনও এক অজানা ভয়ে৷ ছায়া আন্দোরাম কোনোদিন খোঁজেনি, ছায়া কি জিনিস সে বোঝার সুযোগও দেয়নি জীবন তাকে৷ শৈশবে পিতৃ-মাতৃহারা আন্দোরাম, কখনও জনমজুর, কখনও ক্ষেতমজুর কখনো-বা লোকের বাড়িতে নোংরা পরিষ্কারের কাজে লেগে যেত৷ যত দিন গেছে বিজপুরের কাজের সুযোগ কমেছে৷ সেই সাথে কমেছে ক্ষেতমজুরের কাজ৷ এখন তেন্দুপাতার ওপরই ভরসা, সারাদিনের পাতা জুটিয়ে যে যৎসামান্য দাম জোটে তা দিয়ে একটা লোকেরও পেটের আগুন নিভতে চায় না৷ আন্দোরাম তো এখন দু’ থেকে তিন হতে চলেছে৷ তার ওপর আবার এখন পাতা জমা দেবার সময়৷ পুলিশে ছুঁলে কত ঘা যে পড়ে তার কোনো হিসেব নেই৷
বেলা এগারোটার কিছু আগে মালিকের গুদামের কাছে এসে পৌঁছায় রাম৷ গুদামের কাছেই গুমটি ঘরের সামনে লম্বা লাইন৷ মাথা তুলে আরও একবার আকাশটাকে জরিপ করে সে, অভিজ্ঞ চোখ বুঝে যায় হিসেব নিকেশ করে তার নম্বর লাগতে বেলা গড়িয়ে দুপুর হবে, তারই ভিতর বেশ কয়েকবার গদি ছেড়ে উঠবে মালিক৷ মুখে তার সারাক্ষণই নিমফলের মতো বিষ অথচ রক্তে না-কি মধু, কেমন করে হয় বোঝে না আন্দোরাম৷ সে বসে গুনতি করে মাথা, আর মালিকের শৌচে যাওয়া৷
মাটি ঘিরে কত উৎসব আমাদের৷ মাটি ঘিরে কত আয়োজন। মাটির দেবতার পায়ে উৎসর্গিত হয় গোটা জীবন৷ এই মাটি যখন সুফলা-সুজলা তখন অন্নদাত্রী মায়ের মতো, আবার রুখাশুখা বায়ুতে মাটি আন্দোরামের মালিকের মতো কর্কশ, কঠিন, বেদরদি৷ গঙ্গাম্মার প্রসব বেদনা উঠেছিল গভীর রাতে, সন্ধে থেকেই ঘন ঘন বৌটাকে পরীক্ষা করছিল সুকুমতি৷ বাইরে অস্থির হয়ে উঠছিল আন্দোরাম৷ মনে মনে ভীমাদেবের পায়ে মাথা ঠুকছিল সে, কাতরভাবে প্রার্থনা করেছিল এবার একটা জ্যান্ত বেটা হোক তোর৷ বেটা যদি নাই-বা হয়, হোক না একটা বেটি, তবুও বউটা তো বেঁচে যাবে, জেদি বউ আর গলায় দড়ি দেবে না! একটা তীক্ষ্ণ চিৎকারে ঘোর কাটে রামের৷ ভুল শোনেনি রাম, একটা সদ্যোজাত জীবিত শিশুর তীক্ষ্ণ আর্ত চিৎকার কানে এসেছে তার এই প্রথম৷ দ্রুত পায়ে ঘরের দিকে এগিয়ে যায় সে, ঘরে ঢোকার মুখেই একটা সাদা পোটলা নিয়ে বেরিয়ে আাসে সুকুমতি, চওড়া হাসি হেসে বুড়ি বলে, ‘সীতা-মাইয়া এসেছে আন্দো তোর ঘরে, এবার তোর নিজের ক্ষেতি হবে, ফসল উঠবে, জমি হবে নিজের৷ তুই আবাদ হবি আন্দো৷’ আন্দো দাওয়ায় দাঁড়িয়ে বুকে তুলে নেয় কন্যা সন্তানটিকে; চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে জলের ধারা; আকাশের দিকে ফের একবার মাথা তুলে তাকআয়— সেই আকাশ যেন তার আজন্ম সহচর, এক চিলতে বিদ্যুত চমকে কি ওঠে মেঘের আড়ালে! মেয়েকে বুকে জড়িয়ে অস্ফুটে বলে ওঠে, ‘বেটি আম্মো৷’

।। দুই ।।
খিদে একটা জ্যান্ত জিনের মতো মানুষের পেটের মধ্যে ঘাপটি মেরে বসে থাকে৷ গরিবের পেটের মধ্যে সে বাড়তে থাকে যেন একটু অন্যরকমভাবে— লিকলিকে সরু হাত-পা, অথচ স্ফীত একখানা পেট, আর সেই পেটে গনগনে একটা উনুন বসানো থাকে সারাক্ষণ৷ কখনো সেই উনুনের আগুন নিভু নিভু আচেও শরীরকে ধিকি ধিকি করে জ্বলে জানান দেয় সেই জিনের অস্তিত্ব৷ ছোট্টো শরীর কিন্তু তার ভিতর যে অনন্ত প্রাণ ও তার সাথে যে অভুক্ত জিন লড়াই করে চলে প্রতিনিয়ত এই বারো বছরের জীবনে তাকে নিয়ে বুঝতে বুঝতে এটা বুঝে গেছে আম্মো— সে যতদিন বাঁচবে এই শয়তান জিনের দাসত্ব থেকে তার মুক্তি নেই! ছোটো ছোটো কচি হাতে সে যখন প্রথম টুকটুকে লাল লাল লঙ্কাগুলো তুলতে শিখছিল, কখনো একটানে উঠে আসত পাতাশুদ্ধু লঙ্কা, কখনো-বা ভেঙে যেতো লঙ্কার বোঁটা, অসাবধানে যেন হাত লাগত চোখে, ঝাঁঝে জ্বলে উঠত চোখ, জ্বালা করত, চোখে হাত দিলে সেই জ্বালা বেড়ে যেতো দ্বিগুণ, যন্ত্রণায় কঁকিয়ে প্রথম প্রথম কেঁদে উঠত আম্মো, ছুটে যেত ‘তানি তানি’ বলে, জ্বালা কমলে একটু ধাতস্ত হয়ে যখন সে বসতো, তখন নতুন করে জলের ধারা নেমে আসত চোখ বেয়ে, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে চলত আম্মো— কত কথা, কত ছবি ভেসে উঠত তার কৈশরের মানসপটে তার ইয়ত্তা নেই! মাকে জন্ম ইস্তক দেখেনি আম্মো৷ বাপ বলে— তার জন্মের রাতেই অসুস্থ হয়ে পড়ে মা, একেতেই না-খাওয়া শরীর, তার ওপর সন্তানের জন্মের ধকল আর রক্তের অভাবে ধুকতে থাকা মাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার টাকা ছিল না বাপের কাছে৷ গ্রামে জোটেনি কোনো গাড়ি, রক্তে ভেসে যাওয়া মায়ের শীর্ণ শরীরটাকে নিয়ে আরেক হাতে লণ্ঠন নিয়ে হাঁটতে শুরু করেছিল বাপ আন্দোরাম। তারা অচ্ছুৎ, দলিত, গ্রামের শেষ প্রান্তে বাস, কেউই যে তাদের জন্য এগিয়ে আসবে না সে জানা ছিল আন্দোরামের; তাই সে বউকে নিয়ে একাই এগিয়েছিল, বুড়ি দাইয়ের হাতে তুলে দিয়েছিল আম্মোকে৷ বেশ কিছুটা হাঁটার পর হালকা দেহটা যে আস্তে আস্তে শক্ত আর ভারী হয়ে উঠেছিল টের পেয়েছিল সে, মাঝ রাস্তায় প্রাণপাখি উড়ে গিয়েছিল গঙ্গাম্মার, ওইটুকু দুধের শিশু মাতৃহারা হল সেই রাতে৷ আন্দোরামের বাড়িতে সেই শিশু কিন্তু চিৎকার করে জানান দিয়েছিল তার উপস্থিতি৷ নিরেট কঠিন অন্ধকার বুক চিরে সেই কান্নার আওয়াজ বিদীর্ণ করেনি কারও বুক৷ স্বাভাবিক, নিঃস্পৃহ হয়েই ঘুমিয়েছিল গোটা গ্রাম ফের ভোরে উঠবে বলে স্বাভাবিক নিঃস্পৃহতায়৷
এই কানোগুজ্জ নামের গ্রামটিতে প্রথম যখন এসেছিল আম্মো— নয় বছরের বালিকা সে, শৌশবের নিটোল সরলতা তখনও তার দু’চোখে ভরপুর৷ জন্মের রাতে মাতৃহীন মেয়েটিকে বুকে আগলে রেখেছিল সুকুমতি দাই৷ সদ্যোজাত শিশুটির মা তখন জীবন-মৃত্যুর দোলাচালে ঝড়ে একটুকরো পাখির বাসার মতো আটকে আছে যেন সরু ডালের ডগায়, শুধু অপেক্ষা ছিল এক দমকা হাওয়ার৷ তখন সুকুমতির ছোটো ছেলের বউয়েরও সদ্য সন্তান হয়েছে, তাই এই মাতৃহারা শিশুকন্যাটি মাতৃস্নেহে বঞ্চিত হলেও মাতৃদুগ্ধে বঞ্চিত হয়নি বরাত জোরে৷
বাবা তাকে শিখিয়েছিল কিভাবে পেটমোটা পিঁপড়েগুলো চিনে নিয়ে আলাদা করে নিয়ে বানাতে হয় ছাপড়া চাটনি; মুখে সেই টক টক সোঁদা স্বাদটা এখনও লেগে আছে আম্মো৷ এখানে এসে সেই স্বাদ প্রায় ভুলতে বসেছে সে৷ ভুলতে বসেছে শৈশবের পুতুল খেলা, ঘরকন্নে, রান্নাবাটি এমনকি পালাপরবের গান৷ জ্ঞান ইস্তক মনে আছে তার— ঘরে ছিল খুব জলের কষ্ট, তাই একটু বড়ো হয়েই বাবা তাকে দিয়েছিল একটা মাটির কলসি, সেই ছোটো ছোটো পায়ে কাঁধে কলসি নিয়ে বেরিয়ে পড়ত আম্মো গ্রামের নীচু জাতের জন্য নির্দিষ্ট কুয়োটা ছিল তার ঘরের থেকে বেশ খানিকটা দূরে৷ হাঁটতে কষ্ট হতো ছোট্টো আম্মোর, তবু জল না-পেলে বাবার মার জুটবে কপালে৷ বাপকেও ছেড়ে দেওয়া যায় না৷ সারাদিন বনে-বাদাড়ে পাতার খোঁজ চালায় মানুষটা— ফিরে আসে, খাবার পায় না ঠিকমতো, কিন্তু তা বলে তেষ্টার জলও পাবে না! জলের জন্য বাবার মার খেয়েছে আম্মো, গাল খেয়েছে প্রতিবেশীদের, আর, তত তার চোয়াল আর মন শক্ত হয়ে উঠেছে জেদে; সেই ছোট্ট থেকেই এক কঠিন শপথ নিয়েছে আম্মো যে-করেই হোক নিজের ভিটের চৌহদ্দিতেই একটা ইঁদারা বানাবে সে৷ তার জন্য চাই টাকা অনেক টাকা, তাই যখনই সে জানতে পারল যে লঙ্কা ক্ষেতে কাজের জন্য আড়তদার এসেছে— এক মুহূর্ত দেরি করেনি সে, তারই মতো আরও কিছু হতভাগ্য বালক-বালিকা জুটে গিয়েছিল দলে৷ আন্দোরাম নিমরাজি হলেও তাকে বুঝিয়েছিল ছোট্টো আম্মো, “বাপু আমি ফিরে আসব অনেক টাকা নিয়ে, পরিষ্কার জল খাব আমরা, নিজের ইঁদারার টাটকা জল যত খুশি!”  মেয়ের কথা শুনে ফের একবার আকাশের দিকে তাকিয়েছিল আন্দো, ঝকমকে নীল আকাশের মুখ ভার ছিল না, মনে মনে সেটাকেই আকাশের দাবি ভেবে ছোট্ট মেয়ের মাথায় শেষবারের মতো হাত রেখেছিল আন্দো; আর ছোট্টো ছোট্টো বিন্দুর মতো মিলিয়ে যেতে দেখা তার আত্মজাকে শেষ অবধি প্রাণপণ হাত নেড়ে বিদায় জানিয়েছিল এক চিরন্তন আদ্র আর্ত পিতৃহৃদয়৷

।। তিন।।
সবার মুখে ঘুরে ফিরে আসছে একই কথা এক অতিকায় দানবের মতো এক রোগ এসেছে শহর থেকে গ্রামে গ্রামে, মানুষ মরছে মানুষের নিঃশ্বাসে, একেই না-কি মহামারী বলে৷ ছোট্টো আম্মোদের অত কথা কেউ বলে না, সবাই নিজেদের মধ্যে গুজগুজ ফিসফিস করে, সবার চোখে-মুখে ভয়, আতঙ্ক, আশঙ্কা আর সর্বক্ষণ একটা চাপা ত্রাস৷ আম্মো অত কিছু বোঝে না৷ সে রোজ রাতে তার টাকার পুঁটলিটা খুলে গোনে, জানে রোজ টাকা বাড়ে না, তবু গোনে৷ সে শুনেছে মোটামুটি বিশ হাজার টাকা হলে হয়ে যেতে পারে একটা ইঁদারা৷ আম্মো ঘুমের মধ্যে শীতল জলের স্বপ্ন দ্যাখে— টাটকা টলটলে জল, গভীর জলে সে সাঁতার কাটে, মাছেদের সাথে, তার মাথায় গোঁজা থাকে পদ্মফুল, তার সারা শরীরে ঠান্ডা হাওয়া খেলা করে, সে আরও গভীরে নামতে থাকে, ডুবতে থাকে চোখ, নাক, চুল, হঠাৎ ইঁদারায় পাঁক খেয়ে ভেসে আসে আন্দোরামের গলা, “বেটী আম্মো, বেটী আম্মো…’ 
ধড়মড় করে চড়কির ডাকে উঠে পড়ে আম্মো৷ বাবাকে দেখতে না-পেয়ে চোখ ভরে আসে জলে৷ তার চেয়েও বেশি কান্না পায় চড়কি’র কথা শুনে যে, এখুন্নি বেরোতে হবে তাদের, গ্রামে ফিরে যেতে হবে সব্বাইকে ৷ সেই দানো মহামারী না-কি ঢুকে গেছে তাদের এলাকায়৷ সবাই পালাচ্ছে, সব না-কি বন্ধ হয়ে গেছে৷ দোকানপাট, ট্রেন, বাস, রাস্তা৷ সব৷ তবে ফিরবে কি করে তারা? চড়কি বলল পায়ে হেঁটে ফিরতে হবে তাদের, আম্মো অবাক হয়ে ভাবে সে যখন এসেছিল প্রথমে অনেকক্ষণ ভটভটি চেপে যেতে হয়েছিল বাস ধরতে; বাস থেকে সেই প্রথম রেলগাড়ি দেখা তার, তারপর সারা রাস্তা ট্রেনের দুলনিতে আধো ঘুমে আধো জাগরণে কিছু মনে নেই৷ ফের বাস চড়ে ও তারপর লম্বা হেঁটে পৌঁছেছিল কাজের জায়গায়৷ আম্মো ফোঁপাতে শুরু করল দেওয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে৷ তখনই চলে গেলে যে-জমানো টাকা আছে তা দিয়ে কিছুতেই ইঁদারা বানাতে পারবে না সে৷ চড়কির তাড়ায় চোখ মুছে উঠে বসে আম্মো৷ তার যেটুকুনি নেওয়ার মতো আছে সাথে সব মিলিয়ে একটা বোঁচকা মতো বাঁধে সে৷ ঘরে কিছু শুকনো চিড়ে আর গুড় ছিল সেটাও বেঁধে নিতে বলে চড়কি৷ চোখ মুছে মাথায় টুকিটাকি জিনিসের বোঁচকা আর ফ্রকের নীচের প্যান্টের দড়ির সাথে বেঁধে নেয় তার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ— তার এতোদিনের তিল তিল করে জামানো টাকা, ঠান্ডা জলের স্বপ্ন!

আন্দোরামের কাজ চলে গিয়েছে সর্বনাশা এই মহামারীর প্রকোপে৷ মালিকের পাতার কারখানা বন্ধ, তাই পাতা কুড়িয়ে দেবে কাকে সে? গ্রামে অনেকে বলাবলি করছিল যারা যারা গিয়েছিল বাইরে কাজ করতে সবাই না-কি ফিরে আসছে যে-যার গ্রামে, মালিকের হাতে-পায়ে ধরে আড়তদারকে ফোন লাগিয়েছিল আন্দো, জেনেছিল ফিরে আসছে আম্মোও গ্রামের আর সবার সাথে৷ সেই থেকে ভিটের নিমগাছের কোনাকুনি ইঁদারার জন্য মাটি খুঁড়তে শুরু করল আন্দো দিন রাত এক করে৷ বেটি আসলে তাকে চমকে দেবে সে, অনেকটা কাজ এগিয়ে যাবে আম্মো আসার আগে৷ নাওয়া-খাওয়া প্রায় ভুলতে বসেছিল আন্দো৷ তারা দলিত বলে এই জল নিয়ে ছেলেবেলায় কম অপমান জোটেনি তার কপালে৷ অনেক ছোটোবেলার কথা আবছা মনে পড়ে তার— একবার তো শুখার সময় তেষ্টায় পাগল হয়ে গ্রামের মন্দিরের ইঁদারার জল খেতে গিয়েছিল চুরি করে; ধরা পড়ায় গাছে বেঁধে সে কী মার! কত কেঁদেছিলো আন্দো, কত অনুনয় বিনয়, মারতে মারতে চোখ-মুখ ফুলিয়ে দিয়েছিল৷ বাপটা এসে মাটিতে কপাল ঠুকে কী কান্না পুরোহিতের কাছে৷ তারপর কে জানে ভোররাতে একসময় নেতিয়ে পড়া আন্দোকে দেখে হাতের বাঁধনটা খুলে দিয়েছিল কেউ, আন্দোর মনে নেই জ্বরে বেঁহুশ ছিল সে সাতদিন৷ এমন কতই করুণ রাগের ব্যাথার ঘটনা তার শরীরে, মাথায় আগুন জ্বালায়, তার ইয়ত্তা নেই৷ আর তখনই আরও জোরে মাটির বুকে আঘাত হানে আন্দো, যেন মাটির গভীরে খোদাই করতে থাকে তার শত প্রজন্মের বঞ্চনার ইতিহাস৷ ঘা মারতেই থাকে মারতেই থাকে৷

ওদিকে চলতেই থাকে চলতেই থাকে আম্মো, তার ছোট্টো কোমল পা কখনো-বা রোদে তেতে উঠে পুড়ে যায়, পিচ রাস্তায় কখনো-বা মাঠের কাদায় ডুবে যায়, কখনো-বা জঙ্গলের জংলি গাছের কাঁটার খোঁচায় রক্তাক্ত হয়ে ওঠে৷ সঙ্গের খাবার ফুরিয়েছে একদিন হল, জলও নিঃশেষ৷ তবু হাঁটছে আম্মোর দল, না-থেমে না-বিশ্রাম করে৷ শুধু জানে পৌঁছতে হবে কোন এই দীর্ঘ পথচলা, কী আছে পথের শেষে— সব তাদের অজানা৷ কত মানুষ দ্যাখে আম্মো৷ হাঁটছে তাদের মতো, কোলে, কাঁধে দুধের শিশু, কত পোয়াতি, বুড়ো বাপ-মা, আর তার নিজের মতো এমন অসংখ্য আশ্রয়হীন বালক-বালিকা৷ আম্মো ভেবেছিল রাস্তায় খাবার পাবে, নিদেনপক্ষে জল, কিন্তু কোথায় কী? সব শুনশান, শুধু ধূ ধূ রাস্তা আর ঠিকরানো তীব্র রোদ; পথের মানুষরা মুখ ফিরিয়েছে, জন্ম থেকেই মানুষের উপেক্ষায় অভ্যস্ত সে— তারা অচ্ছুৎ; কিন্তু এখন শুধু একে অপরের প্রতি শুধু ঘেন্না দেখছে না!— আম্মো দেখছে কী এক ভীষণ ভয় প্রত্যেকের চোখে! সে শুনেছে মানুষ থেকে মানুষে ছড়াচ্ছে অসুখ, মানুষ মানুষকে ছুঁলে ছড়াচ্ছে অসুখ৷ আম্মোর মনে হয় এতোদিন তো শুধু আম্মোরাই অচ্ছুৎ ছিল, তাদের ছুঁলেই না-কি সব অশুদ্ধ হতো, এখন কী তাহলে সবাই অচ্ছুৎ! তবে কী আম্মোদের চোখের জল এতোদিন ধরে হিসেব রেখেছে ভীমদেব? আজ সেই কান্নাই বাতাসে মিশে ছড়িয়ে যাচ্ছে মানুষের মধ্যে, একা হয়ে যাচ্ছে সবাই৷ আম্মোদের মতোই একঘরে অস্পৃশ্য! পা আর চলে না আম্মোর৷ রাস্তার কারা সব খাবার দিচ্ছিল প্যাকেট করে৷ কাড়াকাড়ি পড়ে গেল সবার মধ্যে৷ অবসন্ন ক্লান্ত শরীর নিয়ে আম্মো নিজের ভাগটা ছিনিয়ে নিতে পারেনি ভিড়ের মধ্যে৷ চড়কিকেও আজ চোখ খুলে দেখতে পায়নি আম্মো, হয়তো আগে হেঁটে চলে গিয়েছে সে৷ আজ রোদের তেজ আরও প্রখর, আরও তীব্র, এতোটুকু ছায়া নেই কোথাও৷ এমন নিষ্ঠুর, রুক্ষ, কেবলমাত্র তার লঙ্কাক্ষেতের মালিককেই দেখেছে সে৷ শরীরটাকে কোনওরকমে টানতে থাকে আম্মো, পায়ের চটিটা পাতলা হতে হতে আর বোধহয় অবশিষ্ট নেই, পায়ের চেটো উল্টে দ্যাখে আম্মো— বড়ো বড়ো জল ভরা ফোস্কা, আর অসংখ্য কাটা দাগে শুকনো রক্ত৷ হাঁটতে থাক আম্মো— সে শুনেছে, আর একটু এগোলেই তার রাজ্যের সীমানা, তাকে যে-করেই হোক এগোতেই হবে, গত সাতদিন একনাগাড়ে হেঁটে চলেছে সে, হয়তো আরও বেশি৷ ককিয়ে কেঁদে ওঠে আম্মো, পা’টা তুলে দ্যাখে একটা ফোস্কা ফেটে রক্ত পুঁজ বেরোচ্ছে সমানে, সেখানে আটকে আছে একটা ছোট্টো ছুঁচোলো পাথর৷ রক্তাক্ত, ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত আম্মো হাঁটতে থাকে, মাথার পুঁটলিটা কখন যে খসে পড়ে টের পায় না সে, তবু চলে, চলতেই থাকে… সীমানায় তাদের আটকায় পুলিশ, জলের মতো পাইপ দিয়ে কী একটা বেরোয়, একটা ঝাঁঝালো গন্ধ, চোখ-মুখ-নাক জ্বলতে থাকে— আম্মোর শ্বাস আটকে যায়; সেখানে বসে থাকে তারা বেশ কিছুক্ষণ৷ সেখানে খাবারও দেওয়া হয় তাদের, আম্মোর খাবার দেখে বমি পায়, সে খায় না, গলা শুকিয়ে আসে তেষ্টায়, চারিদিকে তাকায় সে, অনেক অনেক লোকের মুখ দেখতে পায়, চোখ বুজে আসে তার, তবু সে উঠে দাড়াঁয়, অনেক দূরে যেন শুনতে পায় চড়কির গলা— এ আম্মো ওঠ, চলতে হবে তো, আর কিছুটা গেলেই গাঁ আমাদের৷ বিদ্যুতের মতো কী একটা ঝিলিক দেয় তার মাথায়, প্রাণপণে হাঁটতে থাকে আম্মো, অন্ধকার রাস্তায় সামনের দিকে৷ ফিকে অন্ধকার গাঢ় হতে থাকে ধীরে ধীরে, আম্মো হাঁটে প্রাণ দিয়ে হাঁটে, সব শক্তি জড়ো করে ছোট্ট দু’টো পায়ে ডানার মতো ভর করে হাঁটতে থাকে আম্মো৷ তবু চোখে এতো ঘুম কোথা থেকে আসে সে বোঝে না, ঘুমের ঘোরেও সে চলে, জঙ্গলের ভেতর দিয়ে, মাঠের ভেতর দিয়ে, ভয়াল শ্বাপদের ধারালো চোখোর ওপর দিয়ে, হিংস্র কুমির, তীক্ষ্ণ তক্ষক তার পিছু নেয়, তবু সে হাঁটে, মেঘের ভিতর দিয়ে হাঁটে, ঘোর বর্ষার ভিতর দিয়ে হাঁটে৷ ইঁদারার পর ইঁদারা পেরোয় সে, তার চোখ-ঠোঁট স্পর্শ করে উঠে গভীর শীতল জল, ফণিমনসার মতো তাঁর চুল এলো হয়ে ছড়িয়ে থাকে, ঘুমিয়ে পড়ে আম্মো একসময়৷

পুরো একটা গোটা দিন আন্দোরামকে তার ভিটেতে মাটি কুপোতে দ্যাখেনি কাউকে৷ গ্রামের উপহাসের পাত্র, চর্চার পাত্র আন্দোকে কেউ না কেউ রোজই দেখত ইঁদারা খোঁড়ার কাজে৷ বেটির জন্য ইঁদারার কাজ এগিয়ে রাখছিল আন্দো৷ সবাই খেপাচ্ছিল বেটির বিয়ের যৌতুক খুঁড়ে রাখছ আন্দো? দলিতের ভিটেতে খুব প্রয়োজন না-পড়লে কেউ উঁকি দেয় না৷ সেদিন অনেক বেলার দিকে আন্দোরামের মালিক এসেছিল সঙ্গে একদল লোক, পুলিশেরই বটে৷ আম্মোর নিথর দেহটা পড়েছিল গ্রামের প্রান্তে থাকা ছোটো জাতের ইঁদারার মুখে, পরনে ছিল বেগুনি ফ্রক৷ ফ্রকের নীচের প্যান্টে বাঁধা ছিল একটা ভেজা পুটলি, আর তার ভিতরে ভেজা স্যাঁতস্যাঁতে কিছু বাতিল পুরনো টাকা৷ নোট বাতিলের সময়ই মেয়াদ ফুরিয়েছে এই টাকাগুলোর৷ শিশুমন সেটা বোঝেনি, আঁকড়ে ধরে রেখেছিল তার শেষ সম্বল, তার তিল তিল করে জমানো স্বপ্ন৷ বাড়িতে ঢুকে আন্দোর নাম ধরে অনেক হাঁকডাক করেছিল মালিক, তারপর কৌতুহলবশত এগিয়েছিল নিম গাছের কোনাকুনি, যেখানে গত পনেরো দিন ধরে একনাগাড়ে গর্ত খুঁড়ছিল আন্দোরাম রোদ-ঝড়-জল-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে৷ মনে সন্দেহ নিয়ে উঁকি মারে মালিক৷ বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে তার৷ আকাশের দিকে স্থির চোখ মেলে তাকিয়ে আছে আন্দোরাম, টানটান হয়ে শুয়ে আসমানি দোস্তের সাথে যেন তখন কথা বলছে সে৷ গর্তে খানিকটা নেমে মালিক বিড়বিড় করে মুখে রামনাম জপ করে সে আন্দোর চোখটা বুজিয়ে দ্যায়৷

অনেক দূরে অনেক ওপরে মেঘের সিঁড়িতে পা ঝুলিয়ে তখন গল্প করছে বাপ-বেটি৷ আরও উপর থেকে মেঘের পাকদন্ডী বেয়ে নেমে আসতে দেখা যায় গঙ্গাম্মাকে৷ মাটির কলসি কাঁখে নিয়ে মেঘের বেড়ি ভেঙে ভেঙে তাদের কাছে এসে দাঁড়ায় গঙ্গাম্মা৷ মেয়ের মাথায় হাত বুলায়৷ তারপর পাশে বসে শুরু করে দুঃখ-সুখের অফুরান গল্প৷ আন্দো ও গঙ্গাম্মার গুনগুনানি কথার মাঝে ঘুমিয়ে পড়ে আম্মো, মায়ের কোলে মাথা রেখে, আর তার বাপের কোলে মেলে দেয় ফুটিফাটা রক্তাক্ত শ্রান্ত ফুটিফাটা দু’খানা পা৷ যেন এক দুর্ভাগা দেশের খোদাই করা মানচিত্র৷ 

লেখক পরিচিতি-- সোনালী চক্রবর্তী ভারতীয় লোকশিল্পীদের নিয়ে কাজের সাথে দীর্ঘ আঠারো বছর ধরে যুক্ত | প্রান্তিক ও লোকশিল্পীদের উন্নতিকল্পে তৈরি  করেছেন একটি সেচ্ছাসেবী সংস্থা যা কাজ করে চলেছে বেশ কিছু রাজ্যে | মূলত কবিতা ও ছোটগল্পে স্বচ্ছন্দ |

 

সংকলনা- জয় ভদ্র, "হরপ্পা", "হাজার শতাব্দীর রূপকথা অথবা রাজনৈতিক বিষণ্ণতা", "ইডিকেস"-এর মতো বইয়ের লেখক তিনি, নয়ের দশকের শেষ লগ্ন থেকে লেখালেখি শুরু। "হরপ্পা" অনূদিত হয়েছে হিন্দি ভাষায়। এছাড়াও তার ছোটগল্পগুলো একসময় হিন্দি পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ছিলেন এক বিশেষ পত্রিকার কার্যকরী সম্পাদক। একটা সময়  মূলত সাংবাদিকতার সঙ্গে সঙ্গে চালিয়ে গিয়েছিলেন সাহিত্যকর্ম। এই মুহূর্তে পুরোপুরি সাহিত্যেই মনোনিবেশ করেছেন। গল্প, উপন্যাস যেমন তাঁর অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র তেমনি পুস্তক সমালোচনা এবং নাট্য-সমালোচক হিসাবেও সমাদৃত হয়েছেন।

Share this article
click me!