এভাবে যদি বলি, ‘সমস্ত বেদনা তুমি কীভাবে ধারণ ক’রে থাক’, — চেনা অচেনায় অচিহ্নিত : ধীমান ব্রহ্মচারী

থেকে থেকেই কিছু কিছু কবিতার বই নিয়ে পাতা উল্টে উল্টে পড়ছি। আজ একটা অন্য বই। আমার শ্রদ্ধেয় এক দাদা। খুব সম্মান করি। কবিতা নিয়ে মাঝে মধ্যেই ওনার বাড়িতে বসে কবিতা শুনি। কী ভয়ানক অনুভূতি কথা, বলতে পারেন কবিতার মধ্যে দিয়ে।

Asianet News Bangla | Published : Jul 4, 2021 7:26 AM IST / Updated: Jul 04 2021, 01:27 PM IST

কবিতার বই পেলেই পড়তে ভালো লাগে। কেন জানি না। এখন এই পরিস্থিতিতে নতুন কাজে যোগ দিয়ে সময়ও অনেকটা কেটে যাচ্ছে। তাই মাথা হালকা করার জন্য, থেকে থেকেই কিছু কিছু কবিতার বই নিয়ে পাতা উল্টে উল্টে পড়ছি। আজ একটা অন্য বই। আমার শ্রদ্ধেয় এক দাদা। খুব সম্মান করি। কবিতা নিয়ে মাঝে মধ্যেই ওনার বাড়িতে বসে কবিতা শুনি। কী ভয়ানক অনুভূতি কথা, বলতে পারেন কবিতার মধ্যে দিয়ে। সবচেয়ে একটু বেশি অবাক হই, যখন কবিতাকে তিনি একটা আবহের মধ্যে দিয়ে নিয়ে যান নিজের কৌশলে। কবি অসীম ভট্টাচার্য। বইটার নাম “চেনা অচেনায় অচিহ্নিত”। চলমান একটা প্রচ্ছন্ননার আড়ালে থেকে কবি যেন বিরাট এই ঘুমায়মান জগতের দিকে, ঘুমন্ত আগল ঠেলে চোখ মেলে ধরে।’
   আজ থেকে প্রায় বছর পাঁচেক আগের প্রকাশিত বই। পরম্পরা প্রকাশনা থেকে। প্রচ্ছদ করেছেন সুদীপ্ত ভট্টাচার্য। উৎসর্গ পাতায় আছে একটা শব্দ ‘মা’। আর এই মা’য়ের কথা দিয়ে তিমি উৎসর্গ পত্র লিখেছেন :

মা
জীবন লালন করা মাতৃস্নেহ মেঘ
যন্ত্রণা বৃষ্টির পরে মাটিতে বিলীন

কোথায় হারিয়ে যায় মেঘেদের দল
বর্ষণান্তে, প্রচলিত নিয়মে মতো

রেখে যায় জল শুধু বাষ্পকণা
(অসীম ভট্টাচার্য / “চেনা অচেনায় অচিহ্নিত”)

এই উৎসর্গ পত্রটাতে আমার চোখ বোলাই। দেখি কী দেখতে পাচ্ছি। ‘মা’ শব্দটা ব্যবহার করেই কিন্তু উৎসর্গ দেওয়া যেতে পারত। অথচ এখানে সে রীতিটার একটু অন্য মাত্রার ব্যবহার হয়েছে। আসলে এই উৎসর্গ কবিতাটা ৮+৬ মাত্রার কলাবৃত্ত রীতির প্রয়োগ। এখানেই কবি কিন্তু খুব সচেতনভাবে আমাদের কাছে আসছেন, এবং আসার যে পরিকল্পনা বা ব্যাপ্তি তা কিন্তু অনেকটা সম্ভাবনাসূচক রীতির প্রয়োগ। মাতৃত্বের বেদনা। একটা ঘোড়ালো যন্ত্রণা। একটা গোঙানির মতো অস্ফুট স্বর এক সদ্য প্রসব ব্যথার মায়ের মুখে। কীভাবে বুঝলাম? একটু যোগাযোগ করার চেষ্টা করি। ‘মাতৃস্নেহ মেঘ’ শব্দটার যদি একটু ভেতরে ঢুকি। ‘মেঘ’ তো শুধুমাত্র আমাদের জল দেয়। সে জল তৃষ্ণার। মারাত্মক গরমে, রোদে পুড়ে মাটি-ফুটিফাটা। মানুষ কাতরাচ্ছে জলের জন্য। আকাশে মেঘ এল ঘনিয়ে। এই ঘনায়মান মেঘ’ই কিন্তু পুঞ্জিভূত অপেক্ষা। এই অপেক্ষায় কিন্তু অনেকটা কষ্টের অঙ্গে সঙ্গে। বর্ষার মেঘ এসে সব স্নাত করে দেয় মুহূর্তে। চারিদিকে, শুধুই দেখা যায় ঘন বর্ষার ঘনঘটা। এই যে বৃষ্টির কথা। বৃষ্টির মলিনতা। বৃষ্টির পুঞ্জীভূত জলকণার ধারক হয়েই মেঘের পথ অতিক্রম। এবং শেষে অবিরাম ক্লান্তি দূর করে ঝড়ে পড়া।

এবার বইয়ের পাতা উল্টে উল্টে কবিতাগুলো পড়তে পড়তে যাই। বইটার ৯নং কবিতা :

‘হওয়া ছুঁয়ে থাকে
হওয়া ছুঁয়ে যায়,
অনুভব করতে পারি না।

গাছের পাতার স্পন্দনে দেখি
ফিরে যায় হওয়া।’

আরও একটা কবিতার কথা এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে যাচ্ছে। দক্ষিণ কোরিয়ার একজন বিখ্যাত কবি, কো-উন। তাঁরই একটা অনুদিত কবিতা :

পাহাড় থেকে নেমে
‘আমি ঘুরে তাকালাম।
এ-পথ কোথায় গিয়েছিল?
যে পাহাড় থেকে আমি এইমাত্র নামলাম?
এখন কোথায় আমি?

শরৎবাতাসে সাপের পুরনো খোলসটি খড়খড় শব্দ করে উড়ছে ।’
(নির্বাচিত কবিতা, কো-উন / ভাষান্তর সুমন মল্লিক)

একজন কবি খুব সাধারণ ও চেনা পরিমণ্ডলের বাইরে থেকে হাওয়ার মতো অনুভূতিশীল অনুভব বুঝতে পারছেন, গাছের পাতা নড়ার ফলে। তার আগেও হাওয়া তাঁর মন ছুঁয়ে থাকে, অনুভব করতে পারেন— কিন্তু এই অনুভব করার ঘটনা জড়িয়ে থাকে ঠিক যখন গাছের পাতা আন্দোলিত হয়ে যায়। আর আমাদের দক্ষিণ কোরিয়ার কবিও ঠিক একই অনুভব একটু অন্যভাবে পান। তিনি যখন পাহাড় থেকে নেমেছেন; এবং এই নামা কিন্তু সমতলে নামা। আমার অভিজ্ঞতা আছে যে, পাহাড়ে থাকা মানুষ অপেক্ষাকৃত বেশি পরিশ্রমী। অথচ আমরা যখন পাহাড়ের কাছে ঘেঁষি, যখন পাহাড়কে অনেকটা কাছ থেকে পাই, তখন কিন্তু বেশ একটা অনুভব আমাদের হয়, এবং এই অনুভূতি অনেকটা অসহ্য। কিন্তু এই অসহ্য নিয়েই আমরা অনেক অনেক সূক্ষ্ম অনুভূতির কাছে সহজে পৌঁছে যেতে পারি। কবি যে পাহাড় থেকে নামছেন অর্থাৎ, ‘যে পাহাড় থেকে আমি এইমাত্র নামলাম? / এখন কোথায় আমি?— অর্থাৎ অনুভূতি শূন্যতা। আর এখানেই তো আরও অনুভব করবেন তিনি। এমনকি এই অনুভব তাঁর অনেকটা কাছের। তিনি নিজেই বুঝতে পারছেন অনুভব, যখন তিনি নিজেই ‘খড়খড়’ আওয়াজ শুনতে পাচ্ছেন। এই ‘খড়খড়’ শব্দের ব্যবহারই কবি কো-উনের প্রকৃত অনুভবের শব্দ। এই শব্দ আমাদের প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার বাইরে গিয়ে একটা বিমূর্ততা তৈরি করতে থাকে। আমরা শুধুমাত্র যে সেই অনুভবটুকু গ্রহণ করে নিই, তা নয়। এখানে আমরা ও আমাদের সামাজিক কাজের মূল্যায়নও অনেকটা একই দিকের নির্দেশ করে।

আবার কবিতার ১৭নং কবিতার কথায় আসি : 
‘শীতের কুয়াশা ঢাকে চরাচর—
অদৃশ্য হেঁটে আসা পথ;
অজানা সামনের পথরেখা।

তোমার দরজা থেকে কত দূরে আছি
জানতে পারিনা।’
সাবলীল একটা নির্দেশক বাক্য। কবির এই নির্দেশক ভঙ্গিমা কিন্তু পাঠককে আরও আকৃষ্ট করে তোলে। কবির নিজের কাছেই নিজের অনেক কিছুই অস্পষ্ট। তাই কবির চোখে দেখা দৃশ্য বা অবচনের ভেতরের থাকা ‘মর্বিডিটি’ (morbidity) কোথায় যেন একটা প্রচ্ছন্নভাবে (concealed) তাঁর মনে দাগ কেটে থাকে। তাহলে কোথাও কী কবি একটা পুরনো ইতিহাস নিয়ে বার বার ফিরছেন? না-কি নিজেই একটা ইতিহাসের চেনা ও নিছক পরিবৃত্তের পরিমণ্ডলে পাক খাচ্ছেন। আরও একটা বইয়ের কবিতার কথা বলতে হচ্ছে এই অলোচনা প্রসঙ্গে :
কবিতার নাম ‘উরোকথা ৩। এই বইতেই আবার এই কবিতাটায়’ ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয়েছে :

Evergreen Truth
‘Every moment, we breathe
To walk ahead towards death...’
(শব্দকল্পদ্রুম / দ্রোহজ পথিক)

কবিতাটার বাংলা অনুবাদ হয়েছে বইটার আগের পাতায়। আসলে আমাদের অনুভব আর অনুভূতি স্তর হয়তো সূক্ষ্ম এবং সবকালেই সেই ইন্দ্রিয় অনুভূতি এক। আমাদের চেতনার মধ্যেই জন্ম নেয় অন্তঃসারশূন্যতা যা দিয়ে আমরা শুধুমাত্র আমাদের মনের আদ্রতা মেপে মেপে চলি, গভীর স্রোতের মধ্যে দিয়ে। এই স্রোত কিন্তু সময়। এই ঢেউ আমারদের চারপাশের ‘চলমান প্রবণতা’ অর্থাৎ ইংরেজিতে বলব, ‘inprogress tendency’। এই কথাটায় এই কবিতার সঙ্গে জুড়ে দিয়ে বলব : আলোচ্য বইয়ের ২২নং কবিতা :

‘আলোর রূপময় তোমার ঐশ্বর্য,
অরূপ তুমি অন্ধকারে।

তুমিই সরিয়ে নাও আলো—
অন্ধকারে সব নিরাকার, দৃষ্টির অতীত।

হওয়ার নিঃশ্বাসে শুধু
তোমার অরূপ উপস্থিতি।’

দেখুন আগের কবি দ্রোহজ বলেছেন, আমাদের নিঃশ্বাসের প্রতিটা মুহূর্তের কথা। আমরা হয়তো কেউই জানি না, এর সর্বোচ্চ সময় ও স্থিতি। অথচ, আমরা আলোর উপস্থিতির মতো বেছে নিই, নিজেদের বাঁচার আশাকে। আসলে আমার কবিতা পড়তে পড়তে বার বার একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে যে, জগতের সব কবিই যেন একই সঙ্গে কবিতার বিমূর্ততা অনুভব করতে পারেন। যার ফলেই, তাঁরা ভিন্ন ভিন্ন সময় ও স্থানে কিন্তু একই মতাদর্শের কথা বলেন।
জয় গোস্বামীর বই। নাম “জয়ের সুভাষ”। বইয়ের  প্রথম গদ্যের অর্থাৎ ‘আমাদের কবিতাপ্রত্যাশা’ অংশের একবারে শেষের আলোচনায় যেখানে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা, ‘অন্ত্যাক্ষরী’। যেখানে কবিতার বাঁক বদল হচ্ছে। কবি জয় তিনিও দেখেছেন সেই বাঁকের ইতিহাস। তবুও সেই ইতিহাস নিয়ে তিনিও অস্থির। বইটাতে কবিতার শেষ দিকটা বইয়ে ছাপা আছে। কবি জয় সেই শেষটা দেখে, আমাদের প্রত্যাশার একটা কথা বিবৃতি দিয়েছেন : ‘...আমরা বুঝতে পারি বিদায়ের কথা থাকলেও, কোনও অবসান, কোনও সমাপ্তির কথা নেই এখানে। নতুন বিশ্বাসের নতুন সৃষ্টির সূচনার কথা বলেই পূর্ণ হয়েছে তাঁর কবিতা। চিরকালের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে সে, হাত বাড়িয়ে রেখেছে সে— বরাবরের মতোই।...’ আমরাও ঠিক তেমন করেই চেয়েও থাকি। 

৩১নং কবিতা : 

‘বিস্তৃত পথ
অতি দূরে সংকীর্ণ হয়ে আসে যেন।
আরও দূরে
সে এক বিন্দুতে মিলে যেন শেষ হয়।’

আবার,

কিংবা ৪৯নং কবিতার ক্ষেত্রে : 

‘যথেষ্ট রসদ নেই দীর্ঘ অপেক্ষার,
অথবা অনন্ত পথ হেঁটে পৌঁছনোর
তোমরা সমীপে।’

আসলে কবিতার স্তর সাজাতে সাজাতে ছকভাঙা ছন্দে কবিতাকে নিয়ে জীবন দেখার এক অভিনব প্রয়োগই তাঁর বইয়ের উপাদান। সাবলীল ভাবনার প্রকাশ তাঁর অসাধারণ শব্দের স্টাইলে। আমরা কেমন যেন থেকে থেকে হয়ে উঠি আত্মকেদ্রিক। সময়ের ব্যবধানে আমরাও সেই অপরিণত বাঁকের মুখ থেকে উঠে এসে লালন করি শব্দের সমাপ্তি। সময় নিরন্তর আমাদের সামনের অভিমুখে ঠেলা দিতে দিতে তাড়া দেয়, আমরা চেতনা হারিয়ে হয়ে উঠি, কালের বিবর্তনে দাঁড়িয়ে থাকা এক জনৈক মানুষ। যাঁর স্বাবলম্বী স্বাদ আমাদের স্বপ্ন বিভরতা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করার। ঘুমের অন্ধকারে আমরা একটা জ্যোৎস্নামুখর রাত্রিতে পালতোলা নৌকায় ভাসি উন্মত্ততায়। আমাদের কবি অসীম ভট্টাচার্য তখন পাদানি আগলে বলেন : 

‘যাপনের অনুভবগুলি ভিতরে ভিতরে জারিত।
প্রকাশের লগ্ন নির্ণীত ছিল কোথাও এক
স্ফুলিঙ্গ অপেক্ষায় অথবা অন্তর্লীন স্রোতের
জল ভূমিতে উছলে ওঠার। স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ
এই অনুভবগুলির।’ 


 
লেখক পরিচিতি :  ধীমান ব্রহ্মচারী’র জন্ম ১৯৮৭ সালে। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত মুর্শিদাবাদ জেলার রঘুনাথগঞ্জে বেড়ে ওঠা। তারপর কলকাতায় আসা কলেজ জীবনে। বাংলায় স্নাতকোত্তর। লেখালিখি শুরু ২০০৫ সাল থেকে। প্রথম সম্পাদিত পত্রিকা “কবিতা বুলেটিন” ২০০৯ সাল থেকে। পরে ব্যক্তিগত ইচ্ছায় “ম্যানিউসক্রিপ্ট” নামে লিটিল ম্যাগাজিনের সম্পাদনা। পরবর্তীতে “এবং অধ্যায়” নামে একটি পত্রিকা ও প্রকাশনার চালাচ্ছেন। মূলত কবিতা লেখার পাশাপাশি প্রবন্ধ, নিবন্ধ, গল্প সবই লিখেছেন। তবে সবচেয়ে ভালোবাসেন স্মৃতিকথা লিখতে। বর্তমানে চুঁচুড়ায় থাকেন। দীর্ঘদিন এই বাংলার এক প্রথম শ্রেণির পত্রিকা গোষ্ঠীতে চাকরি করেছেন। বর্তমানে চাকরি জীবন থেকে কিছু সময়ের জন্য সরে এসে প্রকাশনা ও লেখালিখি নিয়ে ব্যস্ত থাকছেন।


 সংকলনা- জয় ভদ্র, "হরপ্পা", "হাজার শতাব্দীর রূপকথা অথবা রাজনৈতিক বিষণ্ণতা", "ইডিকেস"-এর মতো বইয়ের লেখক তিনি, নয়ের দশকের শেষ লগ্ন থেকে লেখালেখি শুরু। "হরপ্পা" অনূদিত হয়েছে হিন্দি ভাষায়। এছাড়াও তার ছোটগল্পগুলো একসময় হিন্দি পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ছিলেন এক বিশেষ পত্রিকার কার্যকরী সম্পাদক। একটা সময়  মূলত সাংবাদিকতার সঙ্গে সঙ্গে চালিয়ে গিয়েছিলেন সাহিত্যকর্ম। এই মুহূর্তে পুরোপুরি সাহিত্যেই মনোনিবেশ করেছেন। গল্প, উপন্যাস যেমন তাঁর অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র তেমনি পুস্তক সমালোচনা এবং নাট্য-সমালোচক হিসাবেও সমাদৃত হয়েছেন।

Share this article
click me!