আমি বই পড়তে ভালোবাসি জেনে, এবং পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি পড়া বইটি সম্পর্কে আমার লেখার মাধ্যমে অন্য মানুষকে জানিয়ে দিই বলে আমার অনেক সদাশয় বন্ধু দেশ-বিদেশ থেকে অনেক মূল্যবান বই আমার জন্য নিয়ে আসে।
কয়েকদিন আগে একটি বই পড়ে শেষ করলাম। বইটির নাম “50 Philosophy Ideas: You really need to know”। বইটি ইংল্যান্ড থেকে আমাকে এনে দিয়েছিল ডক্টর জয়ন্ত বিশ্ব শর্মা। তিনি ইংল্যান্ডের নিউক্যাসেল শহরের একটি সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার। বছরে একবার, কখনও দু’বারও তিনি গুয়াহাটিতে আসেন। প্রতিবারই তিনি আমার জন্য এই ধরনের কিছু নির্বাচিত বই নিয়ে আসেন যে-সমস্ত বই আমাদের দেশে দুষ্প্রাপ্য। ভারতের বড়ো বড়ো শহরের বইয়ের দোকানে এই ধরনের কিছু বই থাকতেও পারে, কিন্তু আমার পক্ষে সেই সমস্ত সংগ্রহ করা অসম্ভব। ডক্টর জয়ন্ত বিশ্ব শর্মা এ-ধরনের কয়েকটি অমূল্য বই এনে আমাকে উপহার দিয়েছেন। তার এই ভালোবাসার ঋণ আমি কখনও পরিশোধ করতে পারব না।
অন্য বিষয়ে যাবার আগে আমি গত মাত্র এক বছরের উপহার হিসেবে পাওয়া আরও কয়েকটি বইয়ের কথা উল্লেখ করতে চাই। তা না-করলে আমাকে অকৃতজ্ঞতার পাপ স্পর্শ করবে। আমি এই বিভাগে অনেকবার এ-কথা উল্লেখ করেছি যে আমার বন্ধু ভাগ্য অন্য অনেক মানুষের ঈর্ষার যোগ্য। আমি বই পড়তে ভালোবাসি জেনে, এবং পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি পড়া বইটি সম্পর্কে আমার লেখার মাধ্যমে অন্য মানুষকে জানিয়ে দিই বলে আমার অনেক সদাশয় বন্ধু দেশ-বিদেশ থেকে অনেক মূল্যবান বই আমার জন্য নিয়ে আসে। এই ধরনের অনেক সদাশয় বন্ধুর কথা এবং তারা আমাকে উপহার হিসেবে দেওয়া বইগুলির নাম এই বিভাগে আমি অনেকবার লিখেছি। এখন আর সেই একই কথার পুনরাবৃত্তি করতে চাই না, কিন্তু গত একটি বছর আমি উপহার হিসেবে পাওয়া কয়েকটি মূল্যবান বই এবং সে-সবের দাতাদের নাম উল্লেখ করে রাখতে চাই। তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা নিবেদন করার জন্য আমি এর বাইরে অন্য কোনও উপায় খুঁজে পাইনি।
গতবছর শোণিত বিজয় দাস আমাকে উপহার দেওয়া বই গুলির নাম হল “The museum of innocence” (Orhan Pamuk), “Snow” (Orhan Pamuk), “Other Colours” (Orhan Pamuk), “The Total Library” (Jorge Luis Borges)।
“How to read and why” (HaroLd Bloom) নামের বইটি আমাকে উপহার দিয়েছিল ডঃ বিভাস চৌধুরী। প্রদ্যুৎ বরদলৈ দিল্লি থেকে আমার জন্য কিনে এনেছিল “The Rediscovery of India” (Meghnad Desai)। কুন্তল শর্মা বরদলৈয়ের কাছ থেকে উপহার হিসেবে পেয়েছিলাম “Sophie’s World” (Jostein Gaarder )। আমি এক বছরের উপহার হিসেবে পাওয়া বইয়ের তালিকা এতেই শেষ হয়নি। বিশ্বদীপ বরুয়া যে কয়েকটি লোভনীয় বই আমাকে উপহার দিয়েছে সেগুলি হ্ল— “How Proust can change your life” (Alain De Botton), “The Consolations of Philosophy” (Alain De Botton), “A New Earth Awakening to Your Life’s Purpose” (Eckhart Tolle)। দেবেশ্বর বরা গোলাঘাট থেকে আমার কাছে ডাকযোগে পাঠিয়েছে যশোবন্ত সিং-এর বহু বিতর্কিত গ্রন্থ “Jinnah”। ব্রেইনের অস্ত্রপচার করার জন্য দিল্লির হাসপাতালে এক মাস থেকে গুয়াহাটিতে ফিরে আসার সময় শারদী শারদীয়া আমার জন্য নিয়ে এসেছিল বারাক অবামা-র আত্মজীবনী “Dreams from My Father”।
আমার একজন অত্যন্ত প্রিয় বন্ধু ইতিমধ্যে আমাকে কয়েকটি মূল্যবান বই উপহার দিয়েছেন এবং একটি অত্যন্ত বিখ্যাত বই আমার জন্য তিনি কিনে রেখেছেন বলে আমাকে জানিয়েছেন। কিন্তু তার অনুমতি না-পাওয়ার জন্য আমি তার নামটা এবং বইটির নাম প্রকাশ করা থেকে বিরত রইলাম।
উপরের “50 Philosophy Ideas” নামে একটি বইয়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সেই বইটিতে লেখক ‘Ends and Means’ নামের অধ্যায়ে কয়েকটি প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। প্রশ্নগুলি নীচে দেওয়া হল। আপনারা সেই প্রশ্নগুলির উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করে দেখুন তো। আপনারা কি উত্তর পান সে-কথা লিখিতভাবে আমাকে জানালে আমি “আমার অসম”-এ প্রকাশ করব। আমার অসমের পাঠকরা প্রচুর চিন্তার খোরাক পাবে।
১) একশো কুড়িজন যাত্রী বহন করে নেওয়া একটি বিমান দুর্ঘটনায় পতিত হওয়ার উপক্রম হয়েছে। ইঞ্জিনের বিচ্যুতি ঘটার ফলে বিমান দ্রুতগতিতে আকাশ থেকে পৃথিবীর দিকে খসে পড়ছে। যে জায়গায় বিমান ভূপাতিত হবে সেই জায়গা একটি জনাকীর্ণ শহর। হাজার-হাজার মানুষ সেখানে বসবাস করে। ঠিক সেই জায়গায় বিমানটা পতিত হলে শত-শত বা হাজার-হাজার মানুষ প্রাণ হারানোর আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। হাজার-হাজার মানুষের প্রাণ রক্ষা করার একটি মাত্র উপায় আছে বিমান আকাশে থাকতেই গুলি করে তাকে ধ্বংস করে দেওয়া। কিন্তু তা করতে গেলে একশো কুড়িজন যাত্রী অগ্নিদগ্ধ হয়ে জায়গাতেই মারা পড়বে।
এখন আপনি কি করবেন? একশো কুড়িজন যাত্রীর প্রাণ রক্ষা করবেন, না-কি হাজার মানুষের প্রাণ রক্ষা করবেন?
২) তিনজন রোগীর কথা ধরা যেতে পারে।একজন রোগী নিশ্চিতভাবে এক সপ্তাহের ভিতরে মারা যাবে। কিন্তু তার হার্ট এবং কিডনি সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থায় রয়েছে। অন্য একজন রোগীর জন্য দরকার হার্ট, সেখানে অপর একজনের দরকার একটি কিডনির। সেই দু’টি না-পেলে দুইজন রোগী তিন-চার দিনের ভেতরে মারা যাবেন। তাদের হার্ট এবং কিডনি দান করার কেউ নেই। এখন যে-মানুষটির এক সপ্তাহের ভিতরে মারা যাওয়াটা ১০০ শতাংশ নিশ্চিত তার হার্ট এবং কিডনি কেটে এনে দু’জন রোগীর গায়ে জোড়া লাগিয়ে দিলে তাদের প্রাণরক্ষা হওয়াটাও ১০০% নিশ্চিত। অবশ্য প্রথম রোগীটিকে প্রথমে মেরে ফেলতে হবে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত যদি আপনাকে নিতে হয় আপনি কি সিদ্ধান্ত নেবেন?
৩) একজন জার্মান গেস্টাপো অফিসার দশটি শিশুকে বন্দি করে এনে অন্য একজন মানুষকে বলছে— ‘আমরা খুঁজে বেড়ানো গুপ্তচরের নামটি এবং সে কোথায় লুকিয়ে আছে, সে কথা তুমি জান। তুমি যদি তার নামটা না-বল আর তার খবর না-দাও তাহলে আমি এই দশটি শিশুকে গুলি করে হত্যা করব।’
মানুষটা কিন্তু সত্যি সত্যি গুপ্তচরের নাম বা তার সম্পর্কে কিছুই জানত না। কিন্তু জানি না বললে গেস্টাপো অফিসারটি তাকে বিশ্বাস করবে না, এবং দশটি নিষ্পাপ শিশুকে গুলি করে হত্যা করবে। এই রকম পরিস্থিতিতে শিশুটিকে বাঁচানোর জন্য মানুষটা তার পরিচিত যে-কোনো একজন মানুষের নাম বলে দেওয়াটা উচিত হবে কি? নামটা বললে একজন নিরপরাধ মানুষ মরবে, নামটা না-বললে দশটা নিষ্পাপ শিশু মরবে। তার কী করা উচিত আপনি নিজে কি করবেন?
আপনার কাছ থেকে এই কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর পেলে একই বই থেকে আমি আপনাদের আরও কয়েকটি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করব। প্রশ্নগুলির তাৎপর্য হল এই যে অনেক মানুষ জীবনে এই ধরনের উভয় সংকটের সম্মুখীন হয়। মহাভারতের ভাষায় ধর্ম সংকট। এই ধরনের নৈতিক উভয় সঙ্কট এক-একটি মানুষের হৃদয় বিদীর্ণ করে তাকে দিশাহারা করে তুলতে পারে। কয়েক বছর আগে এই বিভাগে প্রকাশিত উভয়সঙ্কট নামের একটি রচনায় আমি একটি সত্য কাহিনি লিখেছিলাম। আমি সরকারি চাকরি করতে থাকার সময় আমার পিয়ন হিসেবে কাজ করা একজন মানুষ এরকম একটি ধর্মসংকটের সম্মুখীন হয়েছিলেন। প্রসব যন্ত্রণায় মৃতপ্রায় হওয়া তার পত্নীকে অপারেশন করতে গিয়ে ডাক্তার তাকে জিজ্ঞেস করেছিল— ‘মা এবং সন্তানের ভিতরে যে-কোনো একজনকে আমি বাঁচাতে পারব; কাকে বাঁচাতে হবে আপনি ঠিক করুন।’
কী মর্মন্তুদ প্রশ্ন! মানুষটিকে তো একটি সিদ্ধান্ত নিতেই হবে। কিন্তু তিনি যে-সিদ্ধান্তই নেন না-কেন, তা তাঁর অন্তরাত্মাকে ক্ষত-বিক্ষত করে ফেলবে না কি?
জীবন কখনও ক্ষমাহীনভাবে নিষ্ঠুর হয়, আর তা মানুষকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে এভাবে নিষ্ঠুর পরীক্ষার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়।
লেখক পরিচিত : ১৯৩২ সালে লক্ষ্মীমপুর জেলার ঢকুয়াখনায় হোমেন বরগোহাঞির জন্ম হয়। ১৯৫৪ সালে কটন কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যের স্নাতক। সাময়িকভাবে সরকারি চাকরি করে সাহিত্যচর্চা এবং পরবর্তীকালে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। “নীলাচল”, “জনক্রান্তি”, “নাগরিক”, “অসম বাণী” ইত্যাদি কাগজের সম্পাদনা করেন। “পিতাপুত্র” উপন্যাসের জন্য ১৯৭৭ সালে “সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার” লাভ করেন। “আত্মানুসন্ধান”, “বিভিন্ন নরক”, “সুবালা”, “মৎস্য গন্ধা”, “সাউদর পুতেকে নাও মেলি যায়” লেখকের অন্যতম গ্রন্থ। লেখকের ছোটো গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধ এবং আত্মজীবনীমূলক রচনা অসমিয়া সাহিত্যকে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করে তুলেছে।
অনুবাদক পরিচিতি : ১৯৫৮ সালে অসমের নওগাঁ জেলার যমুনায় বাসুদেব দাস-এর জন্ম হয়। ১৯৮২ সালের গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে ও ভাষাতত্ত্বের এমএ করেন। আজ পর্যন্ত অসমীয়া অনূদিত গল্পের সংখ্যা ৫০টিরও বেশি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়, নেতাজি সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমন্ত্রণ পেয়ে সাহিত্য এবং অনুবাদ সম্পর্কে গবেষণাপত্র পাঠ করেছেন। গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপরিচিত সংস্থা NEINAD-এর পক্ষ থেকে অসমীয়া ভাষা সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসারের জন্য “Distinguished Life Membership”-এর দ্বারা সম্মানিত করা হয়। অনূদিত গ্রন্থ “সওদাগরের পুত্র নৌকা বেয়ে যায়”, “নির্বাচিত অসমীয়া গল্প সংকলন”, “মহারাষ্ট্রীয় নবজাগরণ”, “কটন কলেজ”, “দুর্দিনের দস্তাবেজ”, “অশ্বগন্ধা” ইত্যাদি। মৌলিক গ্রন্থ : “চিন্তাভাবনা, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে নারী”।
সংকলনা- জয় ভদ্র, "হরপ্পা", "হাজার শতাব্দীর রূপকথা অথবা রাজনৈতিক বিষণ্ণতা", "ইডিকেস"-এর মতো বইয়ের লেখক তিনি, নয়ের দশকের শেষ লগ্ন থেকে লেখালেখি শুরু। "হরপ্পা" অনূদিত হয়েছে হিন্দি ভাষায়। এছাড়াও তার ছোটগল্পগুলো একসময় হিন্দি পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ছিলেন এক বিশেষ পত্রিকার কার্যকরী সম্পাদক। একটা সময় মূলত সাংবাদিকতার সঙ্গে সঙ্গে চালিয়ে গিয়েছিলেন সাহিত্যকর্ম। এই মুহূর্তে পুরোপুরি সাহিত্যেই মনোনিবেশ করেছেন। গল্প, উপন্যাস যেমন তাঁর অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র তেমনি পুস্তক সমালোচনা এবং নাট্য-সমালোচক হিসাবেও সমাদৃত হয়েছেন।