আমফানের পর কেমন আছে সুন্দরবন। এই উদ্দেশ্যেই বেরিয়ে পড়া। ভোরের আলো ফোটার আগেই কলকাতা থেকে শুরু সফর। মোটরবাইকে কাকদ্বীপের লট-এইট ঘাটের দিকে রওনা হতেই আরও একবার সামনে এল আমফানের ধ্বংসের ছবি। শহরতলি-র যত্র-তত্র উপড়ে পড়ে থাকা বিশাল-বিশাল গাছ, বিদ্যুতের খুঁটি জানান দিচ্ছিল কতটা ভয়ঙ্কর ছিল ২০ মে-র দুপুর থেকে রাতটা। ৩০ মে সকাল ৭টা। লট এইট ঘাটে পৌঁছানো গেলো বটে, কিন্তু জানা গেল বহিরাগতদের নিয়ে যাওয়ার জন্য কোনও ট্রলার বা ভেসেল নেই। একমাত্র পরিযায়ী শ্রমিক হলে তবেই পুলিশের উদ্যোগে মিলবে ভেসেল। সুযোগ বুঝে এগিয়ে এল লট এইট ঘাটের কয়েকজন মাতব্বর। সাফ জানিয়ে দিল দুই থেকে তিন হাজার টাকা দিলে তবেই মিলবে ট্রলার। তবে দ্বীপে ভিড়তে না দিলে ফিরে আসতে হবে লট এইট-এ। বহু চেষ্টার পর অবশেষে মিলল ট্রলার। ভাড়া ১০০০ টাকা। সাগরমুখী কিছু তরুণীও ট্রলারের অভাবে ঘাটে বসেছিল। ৫০০ টাকার চুক্তিতে তাদেরও তুলে নেওয়া হল। শুরু হল যাত্রা। গন্তব্য ঘোড়ামারা দ্বীপ। তবে, ট্রলার প্রথমে যাবে গঙ্গাসাগর। তারপর সে আমাদের নিয়ে যাবে ঘোড়ামারার দিকে। ঘূর্ণিঝড় আমফানের ল্যান্ডফলের প্রথম নিশানায় যে জায়গাগুলি ছিল তার মধ্যে অন্যতম নাম গঙ্গাসাগর ও ঘোড়ামারা দ্বীপ। ১৯৫ কিলোমিটার বেগে ছুটে আসা ঝড়কে কীভাবে সামলানো হবে তা নিয়ে ঘুম ছুটে গিয়েছিল গঙ্গাসাগর ও ঘোড়ামারা দ্বীপের বাসিন্দাদের। আগেভাগেই সাইক্লোন সেন্টারে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বয়স্ক, মহিলা ও শিশুদের।
গঙ্গাসাগার পার করতেই আমাদের সঙ্গে ঘোড়ামারা দ্বীপের দূরত্ব অনেকটাই কমে এসেছিল। খেয়া পারাপার করা মাঝিদের দাবি গঙ্গাসাগর ও ঘোড়ামারা দ্বীপের মধ্যে ব্যবধান জলপথে ৩০ থেকে ৪০ মিনিটের। একটা সময় সুন্দরবন অঞ্চলে সবচেয়ে বড় দ্বীপ ছিল ঘোড়ামারা। এই দ্বীপের অস্তিত্ব অন্তত ২০০ বছরের পুরনো। ইতিহাস ঘেঁটে যেটুকু জানা যায় তাতে এই দ্বীপ প্রথমে ছিল ঘনজঙ্গলে ঢাকা। সে সময় মোট তিনটি দ্বীপ নিয়ে তৈরিহয়েছিল ঘোড়ামারা। মূল দ্বীপের নাম ছিল ঘোড়ামারা। এর পশ্চিমদিক ঘেঁষে ছিল লোহাচূড়া নামে একটি দ্বীপ এবং পূর্বদিকে ছিল খাসিমারা নামে আরও একটি দ্বীপ। স্থানীয় লোককথাতেও দাবি করা হয় যে ম্যাকিনটোস সাহেব সরকারিভাবে প্রথম ঘোড়ামারা দ্বীপে পা রেখেছিলেন। সঙ্গী হিসাবে এনেছিলেন তাঁর ভাইকে। শিকারের উদ্দেশে দুই-ভাই ঘোড়ামারা দ্বীপে পা রেখেছিলেন বলেও দাবি। আর সে সময় এই দ্বীপের কোনও নামও ছিল না। পরে কাজের জন্য ম্যাকিনটোস সাহেব কিছুদিন ঘোড়ামারা দ্বীপ ত্যাগ করেছিলেন। ফিরে এসে দেখেন তাঁর ভাই এবং ঘোড়াগুলি বাঘের হামলায় মারা পড়েছে। সেই থেকেই নাকি দ্বীপের নাম হয়ে যায় ঘোড়ামারা দ্বীপ। এই কাহিনি মোটামুটি বিশ্বাস করেন ঘোড়ামারা বর্তমান বাসিন্দারাও। তবে, ঘোড়ামারার অস্তিত্ব এখন সঙ্কটে। কারণ, লোহাচূড়া ও খাসিমারা দ্বীপদুটি বহু বছর আগেই জলে তলিয়ে গিয়েছে। এমনকি ঘোড়ামারা দ্বীপের ৬০ শতাংশও চলে গিয়েছে নদী গহ্বরে। ভাঙনের তেজ এতটাই তীব্র যে খড়কুটোর মতো উড়ে যাচ্ছে ঘোড়ামারাকে বাঁচানোর সব প্রক্রিয়া। স্বভাবতই বারবার নদী ভাঙনে জীবন-জীবিকা সঙ্কটে পড়ছে এখানকার বাসিন্দাদের। এরমধ্যে ঘূর্ণিঝড় আমফান যেন কফিনে শেষ পেরেকটা পুঁতে দিয়ে গিয়েছে ভাঙনে এই আধ-খাওয়া দ্বীপের অস্তিত্বে।
ঘোড়ামারা দ্বীপের কাছে ট্রলার আসতেই যেন আরও বেশি করে সামনে বেরিয়ে এল প্রাকৃতিক রোষের তীব্র কষাঘাতের চিহ্ন। নদী বাঁধ জানান দিচ্ছিল ধ্বংসের ছবিটা। জায়গায় বাঁধের মাটি ভেসে চলে গিয়েছে জলে। অথচ দিন পনেরো আগেও এখানে ২০ ফুটের বাঁধ ছিল। ধ্বংসের এই প্রলঙ্কর চিহ্নের মধ্যেই আস্তে আস্তে ট্রলারটা ভিড়ল ঘোড়ামারা দ্বীপে। আমরা পৌঁছলাম ঘোড়ামারায়। এবার এক অন্য অন্বেষণ।