এবারের ভোটচিত্র থেকে স্পষ্ট, বাংলার মানুষ বিজেপির উপর আস্থা রাখতে পারেননি। অমিত শাহ-নরেন্দ্র মোদীর ডবল ইঞ্জিনের আহ্বান স্পষ্টতই প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের সামনে কৈলাশ বিজয়বর্গীয়কে দুপুরের পর থেকেই দৃশ্যত বিধ্বস্ত দেখিয়েছে। তিনি জানিয়েছেন, বেশ কিছু জায়গায় ফলের যে ট্রেন্ড দেখা যাচ্ছে তা তাঁকেও বিস্মিত করেছে। ঠিক কী কী কারণে বিজেপির ওপর ভরসা রাখতে পারলেন না বাংলার মানুষ- সে নিয়ে আলোচনা ও বিশ্লেষণ চলতেই থাকবে। এর মধ্যে আমরা ১০টি বিষয় বেছে নিচ্ছি।
১. নাগরিকত্ব
করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে মহামারী দেখা দেবার আগে পর্যন্ত সারা দেশ জুড়ে যে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল, তা এনআরসি-সিএএ বিরোধী আন্দোলন। প্রাতিষ্ঠানিক স্তরে এই আন্দোলনের মুখ হয়ে উঠেছিলেন মমতা, কিন্তু তা ছাড়াও বিভিন্ন অপার্টি সংগঠন সারা দেশের মতই বাংলাতেও বিভিন্ন স্তরে আন্দোলন সংগঠিত করেছে। সে আন্দোলনের বর্শামুখ ছিল বিজেপির দিকে। বেশ কিছুটা সময় জুড়ে চলা এই আন্দোলন বাংলার মানুষকে ভোটে প্রভাবিত করেছে, এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই।
২. অতিমারী রোধে ব্যর্থতা
কোভিড মহামারী ছড়িয়ে পড়ার পর তা মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় সরকার কার্যত ব্যর্থ হয়েছে। প্রথম পর্যায়ে দেশ জুড়ে যে লকডাউন হয়েছিল, সময়কালের হিসেবে তা ছিল বিশ্বের দীর্ঘতম। সে সময়ে পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্ভোগ, ট্রেনের অব্যবস্থা, এ সবই সারা ভারতের মানুষের সঙ্গেই বিপাকে ফেলেছিল বাংলাবাসীকেও। এ ঘটনা প্রথম থেকেই কিছুটা ব্যাকফুটে যে বিজেপিকে রেখেছিল, তা এখন স্পষ্ট।
৩. অতিমারী (দ্বিতীয় ঢেউ)
রাজ্যের নির্বাচনপর্ব যখন তুঙ্গে তখনই হানা দেয় সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ, যা এখনও চলছে। এবারের করোনা মহামারী আগের চেয়ে ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। এবারেও তা মোকাবিলায় ব্যর্থতাই দেখিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। অক্সিজেনের অভাব প্রকট হয়ে উঠেছে সারা দেশে। এরই সঙ্গে দায়িত্বশীল আচরণের অভাব দেখা গিয়েছে কেন্দ্রে অধিষ্ঠিত সরকারি দলের প্রতিনিধিদের মধ্যে। প্রচারের সময়ে বিধি না-মানার ধারাবাহিকতা চলেছে। শেষ দু দফার ভোট হয়েছে এই পরিস্থিতিতেই। এই দু দফার ভোটে ভোটারদের রায় উপরোক্ত ঘটনাবলীকে প্রভাবিত করেছে।
৪. বহিরাগত বনাম বাংলার মুখ
এ বারের ভোট রাজনীতিতে মুখ্য হয়ে উঠেছিল স্থানীয় বনাম বহিরাগত ইস্যু। বিজেপি মূলত অবাঙালি নির্ভর দল, এ কথা স্পষ্টই উঠে এসেছিল তৃণমূল কংগ্রেসের বয়ানে। স্থানীয় নেতাদের থেকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে ভিন রাজ্যের নেতাদের, যাঁরা বাংলাকে বোঝেন না, এমন বয়ান ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। তেমন ইস্যু যে কাজ করে থাকতে পারে, সে সম্ভাবনা উড়িয়ে দিলেন না খোদ কৈলাশ বিজয়বর্গীয়ও।
৫. মুখের অভাব
কে হতে পারে বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী! এ নিয়ে টানা আলোচনা প্রায় গোয়েন্দা কাহিনিকেও হার মানিয়েছে। বহু নাম উঠে এসেছে, তার মধ্যে শুভেন্দু অধিকারী থেকে রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসীও রয়েছেন। এই জল্পনা সামাল দিতে বিজেপি কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে নিষেধাজ্ঞা জারি করতে হয়েছে নিজের দলের নেতাদের উপর, জনসমক্ষে বলতে হয়েছে, বাংলার ভূমিপুত্রকেই মুখ্যমন্ত্রী করা হবে। স্পষ্টতই, এই দোটানার কারণ, দলের মধ্যে সংহতির অভাব। মানুষের কাছে কোনও গ্রহণযোগ্য মুখ হাজির করতে না পারা ফলে নির্ভরযোগ্য বিকল্প হয়ে ওঠার সম্ভাবনা হারিয়েছে পদ্মশিবির।
৬. দলবদল
এবারের রাজনীতিতে বারবার উঠে এসেছে বিশ্বাসঘাতক শব্দটি। শুভেন্দু অধিকারী শুধু নয়, তাঁর সঙ্গে ও তাঁর পরে অনেকেই দল ছেড়েছিলেন। ঠিক ভোটের আগে তৃণমূল ছাড়া ও বিজেপির হয়ে ভোটে দাঁড়ানোর ঘটনা যেমন এক দিক থেকে তাঁদের রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে, তেমনই বিজেপির তরফে সদ্য দলে যোগ দেওয়া নেতাদের টিকিট দেওয়ার নীতিও তাদের বিপক্ষে গিয়েছে।
৭. কুকথা-কুইঙ্গিত
নরেন্দ্র মোদী প্রচারে এসে যেভাবে কিছুটা বিকৃত উচ্চারণে “দিদি, ও দিদি” বলে ডাক দিয়েছিলেন, সে নিয়ে মুখর হয়েছেন অনেকেই। একজন প্রধানমন্ত্রীর মুখে যে তা শোভা পায় না, সে নিয়ে প্রায় সকলেই সহমত হয়েছেন। এরই সঙ্গে বিজেপি রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের “রগড়ে দেব” জাতীয় বক্তব্য বাংলার মানুষকে বিরক্ত করেছে, দলীয় কর্মীদের বিব্রত করেছে। অগ্নিমিত্রা পালের মত বিজেপি নেত্রী তাঁর কেন্দ্রের প্রতিদ্বন্দ্বী সায়নী ঘোষ সম্পর্কে বলেছেন, “ভোটের পর কন্ডোম বিক্রি করবে”। বিজেপি নেতারা সম্ভবত গোটা উত্তর ভারতীয় গোবলয় সংস্কৃতি এ রাজ্যে আমদানি করতে চেয়েছিলেন, যা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে।
৮. মমতার পায়ে চোট
নন্দীগ্রামে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে চোট পেয়েছিলেন, তাকে নাটক বলে আখ্যা দিয়েছিলেন বিজেপি নেতা-কর্মীরা। সম্ভবত অসুস্থ বা আহতের সম্পর্কে এ ধরনের বক্তব্য ভাল চোখে নেননি ভোটাররা, যা বিজেপির বিরুদ্ধে গিয়েছে।
৯. অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস
লোকসভা ভোটের পর থেকে বিজেপি ধরেই নিয়েছিল তাদের এ রাজ্যে ক্ষমতা দখল সময়ের অপেক্ষা। সে হিসেবে গরমিল যে ছিল তা স্পষ্ট। অন্তত ৬ শতাংশ ভোট তাদের দিক থেকে সরে গিয়েছে। একটা গুঞ্জন ইতিমধ্যেই বাজারে শুরু হয়ে গিয়েছে, যার মর্ম হল, যে বাম ভোট আগের বার রামে গিয়েছিল, তা এবার তৃণমূলে গিয়েছে। এ বিশ্লেষণ ঠিক কিনা আরও পরে বোঝা যাবে, তবে কমিটেড বাম ভোট যে তাদের নিজেদের দিকে ফেরেনি, তা
১০. বিপদে আপদে অনুপস্থিতি
করোনা বা আমফান, যে কোনও দুর্যোগের পরিস্থিতিতে কোনও বিজেপি নেতাকেই ধারে কাছে দেখা যায়নি। আমফান দুর্নীতি নিয়ে বিজেপি যত সরব হয়েছে, তার একাংশ উপস্থিতিও দুর্গতদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য ব্যয় করেননি গেরুয়া শিবিরের নেতা-নেত্রীরা। লকডাউনের সময়ে সরকারের তরফ থেকে ও বামেদের তরফ থেকে সাধারণ মানুষের জন্য যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, তার ন্যূনতমও দেখা যায়নি বিজেপির তরফে। এসব যে মানুষ বিস্মৃত হননি, তা ভোটের ফল থেকে স্পষ্ট।