শমিকা মাইতিঃ ২০২১-এ বাংলার মসনদ দখল করতে ভোটযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে বিজেপি। এদিকে ক্ষমতা ধরে রাখলে মরিয়া শাসকদল তৃণমূলও। এই প্রেক্ষিতে নির্বাচনী ইশতেহারে দু’পক্ষই প্রতিশ্রুতির বন্যা বইয়ে দিয়েছে। একঝলকে দেখে নেওয়া যাক প্রতিশ্রুতিতে কে-কাকে টেক্কা মারল-
• কেন্দ্রের পিএম কিসান যোজনা প্রকল্পটি দ্রুত এই রাজ্যে বলবত করা হবে বলে জানিয়েছে বিজেপি। এই প্রকল্পে চাষিদের বছরে ৬ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়। পশ্চিমবঙ্গে প্রকল্পটি এখনও চালু না হওয়ার কারণে যে বকেয়া, সেই ১৮ হাজার টাকা ৭৫ লক্ষ চাষির অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে বিজেপি-র ইস্তাহার ‘সোনার বাংলা সংকল্প পত্রে’। ৬ হাজারের বদলে এই রাজ্যে ১০ হাজার টাকা করে চাষিদের দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বিজেপি। এছাড়াও চাষিদের সামাজিক সুরক্ষা খাতে ৫ হাজার কোটি টাকার একটি ফান্ড আলাদা থাকবে। থাকছে চাষিদের জন্য পেনশনের ব্যবস্থা। এমনকী চাষি ও মৎস্যজীবী পরিবারগুলিকে বিমার আওতাতেও আনতে চাইছে বিজেপি। তৃণমূলের নির্বাচনী ইস্তাহারে সেখানে কৃষক বন্ধু প্রকল্পের মাধ্যমে ৬৮ লক্ষ ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিকে বছরে ১০ হাজার টাকা করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি রয়েছে শুধু।
• এই রাজ্যে মা ক্যান্টিন আগেই চালু করে দিয়েছিল মমতার সরকার। তৃণমূলের ইস্তাহারে ‘মা’ প্রকল্পে ৫০টি শহরে ২৫০০টি ক্যান্টিন স্থাপনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, যেখানে ৫ টাকায় খাবার পাওয়া যাবে। মায়ের বিকল্প হিসাবে বিজেপির ইস্তাহারে রয়েছে ‘অন্নপূর্ণা ক্যান্টিন, যেখানেও পাঁচ টাকায় খাবার পাওয়া যাবে।
• মমতার সরকারের কন্যাশ্রী প্রকল্প বেশ জনপ্রিয়। তার টেক্কা হিসাবে বিজেপির ইস্তাহারে ১৮ বছর বয়সের পরে মেয়েদের ২ লাখ টাকা দেওয়া হবে বলে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। এই প্রকল্পের নাম ‘বালিকা আলো’। বলা হয়েছে, ছাত্রীরা ষষ্ঠ শ্রেণিতে উঠলেই বছরে তিন হাজার, নবম শ্রেণিতে পাঁচ হাজার এবং একাদশ শ্রেণিতে উঠলে সাত হাজার টাকা করে পাবে।
• মেয়েদের জন্য আরও নানা সুযোগ-সুবিধার কথা রয়েছে বিজেপি-র ইস্তাহারে। সরকারি চাকরিতে মেয়েদের জন্য ৩৩ শতাংশ সংরক্ষণ থাকবে। সর্বোপরি, মেয়েদের প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত সমস্ত খরচ মকুব করে দেওয়া হবে। এমনকী সরকারি পরিবহণ ব্যবস্থায় বিনামূল্যে যাতায়াত করতে পারবে মেয়েরা। তফসিলি ও অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি ও আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে থাকা পরিবারে কন্যা সন্তান জন্ম নিলেই ৫০ হাজার টাকার বন্ড দেওয়া হবে। এই শ্রেণির পরিবারে ১৮ বছর বয়সের পরে বিয়ে হলে মহিলাদের জন্য ১ লক্ষ টাকার ফিক্সড ডিপোজিট করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি রয়েছে ইস্তাহারে। উল্লেখ্য, তৃণমূলের ইস্তাহারে মেয়েদের জন্য আলাদা করে নতুন কোনও প্রকল্পের বা সুবিধার উল্লেখ নেই।
• রেশনে এক টাকায় চাল-গম, তিন টাকায় নুন, পাঁচ টাকায় চিনি আর ৩০ টাকায় ডাল দেওয়া হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে বিজেপি-র ইস্তাহারে। তৃণমূল আগেই বিনামূল্যে রেশন শুরু করে দিয়েছিল। ইস্তাহারে খাদ্য সাথী প্রকল্পের নতুন ব্যবস্থায় বলা হয়েছে, এখন থেকে আর রেশন দোকানে যাওয়ার দরকার নেই। ১.৫ কোটি পরিবারের দুয়ারে মাসিক রেশন সরবরাহ করা হবে বিনামূল্যে। ফলে এই ক্ষেত্রে তৃণমূলের ইস্তাহার ছাপিয়ে গিয়েছে বিজেপিকে।
• বাংলায় প্রতিটি পরিবারে ন্যূনতম মাসিক আয় সুনিশ্চিত করতে চায় তৃণমূলের সরকার। দুর্বল পিছিয়ে পড়া দরিদ্র পরিবারের কর্ত্রীদের অ্যাকাউন্টে টাকা চলে যাবে সরাসরি। বিজেপি-র ইস্তাহারে এই ধরনের কোনও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেই।
• মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিধবা ভাতা হিসাবে মাসিক এক হাজার টাকা দেওয়ার কথা বলেছেন যেখানে সেখানে বিজেপি বলছে ৩ হাজার টাকা করে দেবে।
• বিজেপি-র ইস্তাহারে বলা হয়েছে, তফসিলি জাতি, উপজাতি, দুর্বল, অনগ্রসর শ্রেণি ও মেয়েদের স্কুলের বই, ব্যাগ, ইউনিফর্ম, বাইসাইকেল ও নবম শ্রেণি পাশ করলে ডিজিটাল ট্যাবলেট দেওয়া হবে বিনামূল্যে। এই জন্য সহজ পাঠ প্রকল্পে ৫০০ কোটি টাকার আলাদা ফান্ড থাকবে। স্কুলের পরিকাঠামো উন্নয়ন ও নতুন পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার জন্য ২০ হাজার কোটি টাকার ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ফান্ডের কথা রয়েছে বিজেপি-র ইস্তাহারে। তৃণমূলের ইস্তাহারে সেখানে ব্লক প্রতি মডেল আবাসিক স্কুল, শিক্ষকের আসন সংখ্যা বাড়ানোর মতো কিছু শুকনো প্রতিশ্রুতি রয়েছে মাত্র।
• তৃণমূলের ইস্তাহারে ‘মাস্টারস্ট্রোক’ হল স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ড। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে পড়ুয়াদের যাতে বাবা-মায়ের উপর নির্ভর করতে না হয় তার জন্য ৪ শতাংশ সুদে ১০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ঋণ মিলবে এই ক্রেডিট কার্ডে।
• বাংলা আবাস যোজনায় আরও ২৫ লক্ষ স্বল্প মূল্যের বাড়ি বানানো হবে বলে তৃণমূলের ইস্তাহারে জানানো হয়েছে। ৪৭ লক্ষ পরিবারকে নলযুক্ত পানীয় জল পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে তৃণমূলের সরকার। বিজেপি সামগ্রিক ভাবে ‘সোনার বাংলা’ ফান্ড গড়ে পরিকাঠামো উন্নয়নের কথা বলেছে।
• রাজ্যের পর্যটনের পরিকাঠামো উন্নয়নে নানা প্রতিশ্রুতি রয়েছে বিজেপির ইস্তাহারে। পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে এক হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হবে। বাংলার ১৩টি শক্তিপীঠকে কলকাতার সঙ্গে যুক্ত করে বিশেষ শক্তিপীঠ সার্কিট তৈরি করা হবে। এছাড়া ও জঙ্গলমহল, পাহাড় ও উপকূলের পর্যটনশিল্পে আলাদা আলাদা প্যাকেজ। তৃণমূলের ইস্তাহারে এই প্রসঙ্গে কোনও প্রতিশ্রুতি নেই।
• বাংলার শিল্প-সংস্কৃতির উন্নয়নে ১১ হাজার কোটি টাকার পৃথক ফান্ডের কথা বলা হয়েছে বিজেপি-র ইস্তাহারে। নোবেল প্রাইজের মতো করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্মৃতি পুরস্কার দেওয়া হবে। একই ভাবে সিনেমার জন্য থাকবে সত্যজিৎ রায় পুরস্কার। কলকাতা ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালকে আরও উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হযেছে ইস্তাহারে। তৃণমূলের ইস্তাহারে কিন্তু শিল্পসংস্কৃতি নিয়ে কোনও শব্দ খরচ করা হয়নি।
• কলকাতার পরিকাঠামো উন্নয়নে বহু প্রতিশ্রুতি রয়েছে বিজেপির ইস্তাহারে। কলকাতাকে ইউনেস্কো ‘হেরিটেজ সিটি’র আওতায় আনতে চায় বিজেপি। এই জন্য কলকাতার পরিকাঠামো উন্নয়নে ২২ হাজার কোটি টাকার আর একটি ফান্ড থাকবে। কলকাতা মেট্রো ব্যবস্থাকে শ্রীরামপুর, ধূলাগড় ও কল্যাণী পর্যন্ত সম্প্রসারিত করার প্রতিশ্রুতিও রয়েছে ইস্তাহারে। তৃণমূলের ইস্তাহারে কলকাতার আলাদা উল্লেখ নেই।
এককথায়, প্রতিশ্রুতি দেওয়ার প্রশ্নে তৃণমূলের থেকে এগিয়ে বিজেপি। তবে প্রতিশ্রুতি-রক্ষাতেও তারা এগিয়ে থাকবে কিনা, বলবে সময়।