মাথার উপরে ছাদ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন মমতা। চালু করেছিলেন গীতাঞ্জলি আবাসন প্রকল্প। এখন এই প্রকল্পই তৃণমূল নেতাদের কাটমানির উৎস হয়ে উঠেছে। উপভোক্তার তালিকা তৈরিতেও হয় ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি।
ক্ষমতায় এসে গরিব মানুষদের মাথার উপরে ছাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল মা-মাটি মানুষের সরকার। দশ বছর কেটে গিয়েছে। গরিব মানুষ ছাদ পাক আর না পাক, কাটমানির টাকায় তৃণমূল নেতাদের আঙুল ফুলে কলাগাছ। অভিযোগ অ্যাকাউন্টে টাকা ঢুকতে না ঢুকতেই বাড়ি চলে আসেন তৃণমূল নেতারা। পার্টি ফান্ডে চাঁদার নাম করে কখনও ৫ হাজার, কখনও ১০ হাজার, কখনও ২০ হাজার এমনকী ৩০ হাজার টাকাও নেওয়ার অভিযোগ আছে। উপভোক্তার তালিকা তৈরিতেও ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে। তৃণমূল নেতাদের ঘনিষ্ঠ লোকেরা পাকা বাড়ি থাকা সত্ত্বেও প্রকল্পের সুবিধা পেয়েছে এমন উদাহরণ ভূরি ভূরি।
পশ্চিমবঙ্গে গীতাঞ্জলি প্রকল্পটি চালু হয় ২০০৬ সালে বাম আমলে। তৎকালীন ইন্দিরা আবাস যোজনা (এখন যেটার নাম হয়েছে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা) প্রকল্পের ধাঁচেই এটি তৈরি করা হয়। তবে, ইন্দিরা আবাসে বাড়ি তৈরির টাকা পেতে হলে উপভোক্তাদের যেমন বিপিএল তালিকায় নাম থাকা বাধ্যতামূলক, গীতাঞ্জলির ক্ষেত্রে সেই নিয়ম নেই। নিজের বাড়ি তৈরির আর্থিক ক্ষমতা নেই, এমন সকলে এই প্রকল্পের সুবিধা পেতে পারে। এই প্রকল্পে দু’দফায় ৭০ হাজার টাকা মেলে সমতলে, পাহাড়ি এলাকায় ৭৫ হাজার। বাম জমানায় বিধায়কদের সুপারিশের ভিত্তিতে উপভোক্তাদের টাকা দেওযা হত। পালাবদলের পরে তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় এসে ওই প্রকল্পের জন্য প্রতিটি জেলায় একটা করে কমিটি গড়ার নির্দেশ দেয়। যে কোনও গরিব মানুষ ওই টাকা পাওয়ার জন্য ব্লক প্রশাসনের কাছে আবেদন করতে পারবে। জেলাশাসকের নেতৃত্ববাধীন কমিটি সেই আবেদন খতিয়ে দেখে ঠিক করবে আবেদনকারীকে প্রকল্পের টাকা দেওয়া যাবে কি না।
বলাবাহুল্য, বাস্তবে ব্লক থেকে জেলাকমিটি, স্ক্রুটিনি ইত্যাদির ধার ধারে না কেউ। বছর কয়েক আগে নদিয়ার নগরউখড়া ১ গ্রাম পঞ্চায়েতে গীতাঞ্জলি প্রকল্পে প্রচুর অনিয়ম ধরা পড়ে। ব্লক প্রশাসনের কাছে তথ্য জানার অধিকারে এক আবেদনের প্রেক্ষিতে ৩৬ জনের যে উপভোক্তা তালিকা সামনে আসে, তাতে দেখা যায় চালচুলোহীন লোকেদের বাদ দিয়ে তৃণমূল নিয়ন্ত্রিত গ্রাম পঞ্চায়েত এবং পঞ্চায়েত সমিতি নিজেদের ঘনিষ্ঠ লোকজনের নাম ঢুকিয়েছে। অধিকাংশেরই আগে থেকে পাকা বাড়ি রয়েছে। এক জন হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক, একজন বড় ব্যবসায়ী একজন আবার পঞ্চায়েত অফিসে কাজ করেন। বর্ধমানের চান্ডুল গ্রামে আবার ইন্দিরা আবাসে তৈরি হওয়া বাড়ি সারিয়ে সেটা গীতাঞ্জলি প্রকল্পের দেখিয়ে টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে এক ঠিকাদারের বিরুদ্ধে। হুগলির গোঘাটে তৃণমূল পরিচালিত নকুণ্ডা পঞ্চায়েতের প্রধান শ্যামলী ঘোষের স্বামী সুজয়বাবুর নামে গীতাঞ্জলি প্রকল্পে বাড়ি তৈরির টাকা বরাদ্দ হওয়ার পর আবার কেন্দ্রীয় প্রকল্প প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় শ্যামলীদেবীর নাম উঠেছে। সরকারি নিয়ম হল, প্রতি উপভোক্তা পরিবার কেবলমাত্র একটি আবাস প্রকল্পের সুবিধা পেতে পারে। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় নাম তোলার জন্য বিপিএল হতে হয়, যেটা শ্যামলীদেবী নন। এতগুলো নিয়মের ব্যত্যয় হল কী করে। জবাব নেই কারও কাছে।
দ্বিতীয় সমস্যা হল কাটমানির উপদ্রব। অনেক কষ্টে তৃণমূলের দাদা-দিদিদের ধরে বাড়ি তৈরির টাকা হাতে পেতে না পেতেই ভাগের বখরা নিতে হাজির দলের লোকেরা। পশ্চিম মেদিনীপুরের শালবনির মৌপালের বাসিন্দা বাসন্তী কিস্কুর অভিযোগ, ‘বাড়ি বানাব কী করে। টাকা হাতে পেতে না পেতেই পার্টির নাম করে ৩০ হাজার নিয়ে গেল তৃণমূলের লোকেরা’। মাসখানেক আগে আলিপুরদুয়ার জেলার মাদারিহাট এলাকার ইসলামাবাদ মৌজার সভাপতি খাদেমুল ইসলাম আবাস প্রকল্পের কাটমানির টাকা ফেরত দিতে গিয়ে বিক্ষোভের মুখে পড়েন। স্থানীয় বাসিন্দা খালেকুল ইসলামের কাছে কাটমানি বাবদ ৯ হাজার টাকা তাঁর লোকেরা নিয়ে গিয়েছিল বলে অভিযোগ। এদিকে, গৃহ নির্মাণের টাকা পাওয়ার জন্য অভিনন্দন জানিয়ে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর চিঠি পেয়ে হতবাক জলপাইগুড়ির ১৬ জন। তাঁদের দাবি, কোনও টাকা পাননি। সেই জানিয়ে পাল্টা চিঠি দিলে তারও উত্তর পাওয়া যায় নি।
আরও পড়ুন - বঙ্গের কোন কোন কেন্দ্রে সহজে জিতবে বিজেপি, কোথায় লড়াই কঠিন - কী বলছে দলের গোপন বিশ্লেষণ
আরও পড়ুন - বিজেপি এলে CAA হবেই, কিন্তু NRC-র কথা তুলছে কেন তৃণমূল - গেরুয়া শিবিরের কী পরিকল্পনা
আরও পড়ুন - কৃষি না শিল্প - একদশক পর নির্বাচনে ফিরে এল পুরোনো প্রশ্ন, কী বলছে সিঙ্গুর
বিজেপির সর্বভারতীয় নেতা অমিত শাহ বলেন, ‘গরিব মানুষদের মাথার উপরে ছাদ দিতেও কাটমানি খায় তৃণমূলের সরকার। এদের ক্ষমতায় থাকার অধিকার নেই। বাংলার মানুষ এদের উৎখাত করবে এবার।’