সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগ। সেই সময় উত্তর মালদার বিস্তীর্ণ এলাকার রাজা ছিলেন রামচন্দ্র রায়চৌধুরী। শুধু বাংলা নয়, বিহারের কিছু অংশও তাঁর রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। দোর্দণ্ডপ্রতাপ হলেও প্রজাদরদী এবং ধর্মপ্রাণ হিসেবে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়েছিল পূর্ব ভারতে।
উমাকে চণ্ডী রূপে পুজো (Worship) করা হয় মালদহের (Malda) ঐতিহ্যবাহী চাঁচল রাজবাড়িতে (chanchal place)। দুর্গা পুজোর (Durga Puja) চারদিন ছাড়াও সারা বছর দিনে চারবেলা চলে পুজো। দশমী দিন মা চণ্ডীকে হিন্দু-মুসলিম সম্বন্বয়ে দেখানো হয় লন্ঠন। তবে দুই বছরের করোনা আবহে অনেকটা ভাটা পরেছে চাঁচোল রাজবাড়ির পুজোয়।
সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগ। সেই সময় উত্তর মালদার বিস্তীর্ণ এলাকার রাজা ছিলেন রামচন্দ্র রায়চৌধুরী (Ramchandra Roy Choudhury)। শুধু বাংলা নয়, বিহারের কিছু অংশও তাঁর রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। দোর্দণ্ডপ্রতাপ হলেও প্রজাদরদী এবং ধর্মপ্রাণ হিসেবে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়েছিল পূর্ব ভারতে। হাতির পিঠে (Elephant Back) চেপে নিয়মিত বেড়িয়ে পড়তেন রাজত্ব দেখাশোনা করতে। গঙ্গা-মহানন্দা দু'পাড়ের উর্বরা জমির চাষ পরিদর্শন, প্রজাদের সুখ-দুঃখের খবরাখবর নেওয়া ছিল তাঁর রোজনামচা। রাজবাড়ি থেকে বেরোনোর পর কখনও কয়েকদিন, আবার কখনও কয়েকমাস পর ঘরে ফিরতেন।
কথিত আছে, একবার তিনি এভাবেই রাজত্ব দেখতে বেড়িয়ে ছিলেন। বাইরেই রাত কাটাচ্ছিলেন। তখন তাঁকে স্বপ্নাদেশ দেন দেবী চণ্ডী। রাজাকে তিনি আদেশ দিয়েছিলেন, মহানন্দার সতীঘাটায় তাঁর চতুর্ভূজা অষ্টধাতু নির্মিত মূর্তি রয়েছে। রাজমাতাকে দিয়ে সেই মূর্তি নদী থেকে তুলে রাজাকে তা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। শুরু করতে হবে দুর্গাপুজো। আদেশ পেয়ে পরদিন সকালেই সতীঘাটায় চলে যান রাজা। স্বপ্নাদেশে বর্ণিত জায়গায় নদীতে নেমে রাজমাতা তুলে আনেন দেবী চণ্ডীর মূর্তি। সেই তখন থেকেই শুরু হয় রাজবাড়ির দুর্গাপুজো। এই পুজোর বয়স প্রায় ৩৫০ বছর।
আরও পড়ুন- ২০০ বছরের পুরনো হাওড়ার পাল বাড়ির দুর্গাপুজোয় আজও সিঁদুর খেলা হয় অষ্টমীতে
দেবী চণ্ডীর অষ্টধাতুর মূর্তি সতীঘাটা থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে রাজবাড়িতে এনে প্রতিষ্ঠা করেন চাঁচলের রাজা রামচন্দ্র। সেদিন থেকেই রাজবাড়িতে শুরু হয় দেবীর নিত্যপুজো। পরবর্তীতে ফের দেবীর স্বপ্নাদেশ পান রাজা। আদেশ অনুযায়ী সতীঘাটায় দেবীর আর একটি মন্দির নির্মাণ করেন তিনি। তবে প্রথমে সেখানে মাটির ঘর ও খড়ের ছাউনি দিয়ে মন্দির তৈরি করা হয়। পরবর্তীতে রাজবংশের অন্যতম রাজা শরৎচন্দ্র রায়চৌধুরীর নির্দেশে তৎকালীন ম্যানেজার সতীরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানে সেখানে পাকা দুর্গাদালান নির্মিত হয়। ততদিনে জায়গাটির নাম পরিবর্তিত হয়ে পাহাড়পুর হয়ে গিয়েছে। এখনও সেখানে ওই দুর্গাদালান রয়েছে। প্রতিবছর এখানেই রাজবাড়ির দুর্গাপুজো অনুষ্ঠিত হয়।
পাকা মন্দির নির্মাণের পর রাজা শরৎচন্দ্র দুর্গাপুজোর জন্য সেই সময় সাত হাজার টাকা বছরে বরাদ্দ করেন। তখনকার সময় অনুসারে সেই টাকা অনেক। প্রাচীন প্রথা মেনে এখনও সপ্তমী তিথিতে রাজবাড়ি থেকে দুর্গা দালানে নিয়ে আসা হয় অষ্টধাতুর চতুর্ভূজা মা চণ্ডীকে। দশমীতে তিনি ফের রাজবাড়িতে ফিরে যান। ১৭ দিন ধরে চলে চাঁচলের রাজবাড়ির পুজো।
আরও পড়ুন,Durga Puja: ২৫০ বছর পুরোনো বর্ধমানের দে পরিবারে হরগৌরী রূপে পূজিত হন দেবী দুর্গা
কালের নিয়মে বয়ে গিয়েছে সময়। এখন সেই রাজাও নেই, আর রাজত্বও নেই। চাঁচল রাজবাড়িতে এখন স্থাপিত হয়েছে কলেজ, মহকুমা প্রশাসনিক ভবন, আদালত সহ একাধিক সরকারি দফতর। তবে রাজবাড়ির একাংশে থাকা ঠাকুরবাড়ি এখনও আগের মতোই রয়ে গিয়েছে। বর্তমানে চাঁচল রাজ ট্রাস্টি বোর্ড রাজবাড়ির ঠাকুর এবং রাজাদের প্রবর্তিত বিভিন্ন পুজো, স্কুল, মন্দির সংস্কার ইত্যাদি দেখাশোনা করে। ট্রাস্টি বোর্ডের বর্তমান দ্বায়িত্বে রয়েছেন দেবা জয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, "এই পুজো অন্তত ৩৫০ বছর পেরিয়ে গিয়েছে। কথিত আছে, ওই জায়গায় মহানন্দার তীরে এই রাজ পরিবারের একজন সতী হয়েছিলেন। তখন থেকেই জায়গাটি সতীঘাটা নামে পরিচিত। মা চণ্ডীর স্বপ্নাদেশে মহারাজ রামচন্দ্র রায়চৌধুরী নদী থেকে অষ্টধাতুর চণ্ডীমূর্তি পান। তখন থেকেই পাহাড়পুরে দুর্গাপুজো শুরু হয়। পরবর্তীতে ঈশ্বরচন্দ্র রায়চৌধুরী, শরৎচন্দ্র রায়চৌধুরী এখানে রাজত্ব করেন। তারপর শরৎচন্দ্র রায়চৌধুরীর রাজত্বে সব কিছু ভাগবাটোয়ারা হয়ে যায়। কলকাতা হাইকোর্টের আদেশে শরৎচন্দ্রের রাজত্বের অংশ আসে রাজ্য সরকারের অফিশিয়াল ট্রাস্টির মালিকানায়। এই ট্রাস্টি বোর্ডের একটি লোকাল ম্যানেজিং কমিটি রয়েছে। এই কমিটি রাজত্বের আয়ব্যয়ের হিসেব সরকারকে পাঠায়। তার ভিত্তিতে এখানে একটি বাজেট পাঠানো হয়। সেই বাজেট মেনেই এখন রাজ পরিবারের সব খরচ বহন করা হয়। বাজেটে রাজত্বের সব ব্যয়ের জন্য বছরে ২ লাখ ২৫ হাজার টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে রাজাদের প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন পুজো, রাজবাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ, ঠাকুরবাড়ির নিত্যপুজো। বাজেট অনুযায়ী, ২০১৩ সাল থেকে পাহাড়পুর দুর্গাপুজোর জন্য ৯ হাজার টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। তবে এত কম টাকায় পুজো সম্ভব নয়। গ্রামবাসীরা আমাদের অনুমতি নিয়ে ওই পুজোয় অর্থ সাহায্য করেন।"
আরও পড়ুন- নেই রাজত্ব, দশমীর দিন রাজবেশে সিংহাসনে বসেন রাজাহেঁসলার বর্তমান রাজা
এই পুজোর বৈশিষ্ট্য, কৃষ্ণা নবমী তিথিতে দুর্গাদালানে কল্পারম্ভ হয়। এবার মল মাসের জন্য একমাস আগেই সেই পুজো শুরু হয়েছে। সপ্তমীর দিন মিছিল সহকারে মা চণ্ডী ঠাকুরবাড়ি থেকে দুর্গাদালানে পুজো নিতে যান। অষ্টমীতে কুমারী পুজো প্রথম থেকেই হয়ে আসছে। দশমীর পুজো শেষে পাহাড়পুর থেকে ঠাকুরবাড়ি চলে আসেন সিংহবাহিনী। সেখানেই তাঁর ভোগ রান্না হয়। কথিত আছে, একসময় সতীঘাটায়, মহানন্দার পশ্চিম পাড়ে মহামারী দেখা দিয়েছিল। তখন দেবী সেখানকার মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষকে স্বপ্নাদেশ দিয়েছিলেন, গোধূলিলগ্নে বিসর্জনের সময় তাঁরা যেন মাকে আলো হাতে পথ দেখায়। মাকে আলো দেখানোর পর থেকেই মহামারী দূর হয়। তখন থেকেই প্রতিবছর বিসর্জনের সময় সেখানকার অর্থাৎ মহানন্দার নদীর ওপারে বৈরগাছি এলাকার মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ হাতে লণ্ঠন ও মোমবাতি নিয়ে মাকে পথ দেখান। সেই রীতি এখনও চলে আসছে। এখন মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে মাকে ঘাটের পথ দেখানো হয়।