Doctors Day: আধুনিক বাংলার জনক বিধানচন্দ্র রায়, তাঁর তৈরি করে যাওয়া উন্নয়ন আজও বাঙালিকে অক্সিজেন জুগিয়ে চলেছে

ডক্টর বিধানচন্দ্র রায়- স্বাধীন ভারতে পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। বলতে গেলে স্বাধীন ভারতের বাংলার রূপকার হিসাবে তাঁকে আজও স্মরণ করা হয়। একজন প্রশাসনিক প্রধান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারিও চালিয়ে গিয়েছিলেন বিধানচন্দ্র রায়। 

 

Web Desk - ANB | Published : Jun 29, 2023 1:50 PM IST / Updated: Jun 29 2023, 07:24 PM IST

সালটা ১৮৮২-র ১ জুলাই। পাটনার বাঙ্কিপুরে এক বাঙালি কায়স্থর ঘরে জন্ম নিল এক শিশু। পরবর্তীকালে তিনিব পরিচিত হলেন ডক্টর বিধানচন্দ্র রায় নামে। অবিভক্ত বাংলার খুলনার সাতক্ষীরার লোক ছিলেন বিধানচন্দ্র রায়ের বাবা প্রকাশচন্দ্র রায়। বিধানচন্দ্রের ঠাকুর্দা এলাকায় একজন বিত্তশালী বাঙালি বলেই পরিচিত ছিলেন। বিধানচন্দ্র রায়ের বাবা ছিলেন এক্সাইজ দফতরের একজন ইনস্পেক্টর। মা অঘোরকামিনীদেবী ছিলেন একজন গৃহবধূ এবং ধর্মপ্রাণা। সেই সঙ্গে তিনি সামাজসেবার কাজেও ব্রতী ছিলেন।

৫ ভাই-বোনদের মধ্যে বিধানচন্দ্র রায় ছিলেন কনিষ্ঠতম। বিধানচন্দ্রের দুই দিদির নাম ছিল সুষারবাসিনী ও সরোজিনী। আর ২ ভাই-এর নাম ছিল সুবোধ ও সাধন। যদিও, বিধানচন্দ্রের বাবা পরে ব্রাহ্মসমাজে দিক্ষীত হয়েছিলেন।

যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্যের বংশধর ছিলেন বিধানচন্দ্রের বাবা প্রকাশচন্দ্র। কিন্তু রাজপরিবারের সন্তান হয়েও যতটা অর্থবানে বলীয়ান হওয়ার কথা ছিল প্রকাশচন্দ্রের কাছে ততটা ধনসম্পত্তি কোনও দিনই ছিল না। বিধানচন্দ্রের শৈশবকালেও প্রকাশচন্দ্রের মাইনে এমনকিছু ছিলও না। এত আর্থিক অস্বচ্ছলতার মধ্যে থেকেও বিধানচন্দ্রের বাবা-মা কোনও দিনই পরকে সাহায্য করা থেকে পিছিয়ে আসেননি। বিধানচন্দ্রের মা অঘোরকামিনীদেবী এই সামান্য আয়ের মধ্যে থেকেও অন্য গরীব ও অনাথ ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনায় সাহায্য করতেন।

১৮৯৭ সালে পাটনা কলিজিয়েট স্কুলে পড়াশোনা শেষ করে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন বিধানচন্দ্র রায়। সেখান থেকেই আইএ ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর ফের পাটনা যাত্রা। সেখানে পাটনা কলেজ থেকে অঙ্কে বিএ ডিগ্রি লাভ করেন বিধানচন্দ্র রায়। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার উদ্দেশে এরপর তিনি ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি-তে আবেদন করেন। আর সেই সঙ্গে ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজেও ডাক্তারি পড়ার উদ্দেশে আবেদন করেছিলেন বিধানচন্দ্র রায়।

দেখা যায় একই সঙ্গে ইঞ্জিনিয়ারিং ও ডাক্তারি- দুটোতেই পড়াশোনার জন্য সুযোগ পেয়েছেন বিধানচন্দ্র রায়। ১৯০১ সালে পাটনা ছেড়ে এসে ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হন বিধানচন্দ্র। এই সময় একটি উক্তি তাঁর জীবনে অনুপ্রেরণা হয়ে দাঁড়ায়। আর সেটা ছিল- সর্বমন শক্তি দিয়ে দুইহাত ভরে তোমার যেটা করতে ইচ্ছে করছে, সেটার উদ্দেশে নিজেকে নিয়োজিত কর। আজীবন এই মন্ত্রকেই অনুপ্রেরণা বানিয়ে কাজ করে গিয়েছিলেন বিধানচন্দ্র রায়।

ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজের পড়াশোনা চুকিয়ে মেডিসিন নিয়ে পড়ার উদ্দেশে ১৯০৯ সালে ব্রিটেনে পাড়ি দেন বিধানচন্দ্র রায়। পকেটে মাত্র ১২০০ টাকা। সেই অর্থ সম্বল করেই লন্ডনের সেন্ট বার্থোলোমিউস হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু, সেন্ট বার্থোলোমিউস হাসপাতালের ডিন কোনওভাবেই তাঁর বিভাগে এশিয়ান কোনও ছাত্রকে ভর্তি নিতে রাজি ছিলেন না। হারবার পাত্র ছিলেন না বিধানচন্দ্র রায়। তিনিও নাছোড়াবান্দার মতো লাগাতার ভর্তির আবেদন জানাতে থাকেন। ৩০ বার ভর্তি আবেদনের মাথায় ভর্তি-র সুযোগ পান বিধানচন্দ্র রায়। ১৯১১ সালে মাত্র ২ বছর ৩ মাস সময়ে তিনি পড়াশোনা শেষ করেন। আর সেই সঙ্গে রয়্যাল কলেজ অফ ফিজিসিয়ানস-এর সদস্য হন। আর একই সঙ্গে রয়্যাল কলেজ অফ সার্জেনস-এর-ও ফেলো নির্বাচিত হন। সেই বছরই দেশে ফিরে আসেন বিধানচন্দ্র রায়।

কলকতায় ফিরে কখনও নার্সের কাজ, আবার কখনও নামমাত্র ফি-তে প্রাইভেট প্র্য়াকটিস করতে শুরু করেছিলেন বিধানচন্দ্র রায়। একই সঙ্গে তিনি ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজেও শিক্ষকতার কাজ শুরু করেন। পরবর্তীকালে ক্যাম্বেল মেডিক্যায়ল কলেজ ও হাসপাতাল যার বর্তমান নাম এনআরএস মেডিক্যাল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতাল- সেখানেও তিনি অধ্যাপনার কাজ শুরু করেন। এমনকী পাশাপাশি কার্মিচেল মেডিক্যাল কলেজ যা বর্তমানে আরজিকর হাসপাতাল নামে পরিচিত সেখানেও তিনি অধ্যাপনার কাজ শুরু করেন। ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত কার্ডিওলোজি সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া-র প্রথম প্রেসিডেন্ট-ও হয়েছিলেন।

বিধানচন্দ্র রায় মনে করতেন যে শরীর-স্বাস্থ্য ঠিক না থাকলে স্বরাজ-এর স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে না। আর সেই জন্য তিনি শরীর ও স্বাস্থ্য সচেতনার উপরে বাড়তি গুরুত্ব দিতেন এবং অন্যদের এর জন্য অনুপ্রাণিতও করতেন। একজন সমাজসচেতন চিকিৎসক হিসাবে তিনি একাধিক হাসপাতাল তৈরিতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। যারমধ্যে উল্লেখযোগ্য কলকাতার যাদবপুরের টিবি হাসপাতাল স্থাপন। তখন যক্ষা ছিল এক চরম মারণ রোগ। চিত্তরঞ্জন সেবা সদন-ও তাঁর হাতে তৈরি।

চিকিৎসাসেবায় তাঁর অবদানের কথা স্মরণে রেখে ১৯৪৪ সালে তাঁকে ডক্টরেট অফ সায়েন্সে সম্মানে সম্মানিত করা হয়েছিল। ১৯৪২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যও হয়েছিলেন বিধানচন্দ্র রায়। মহাত্মা গান্ধীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও বন্ধু ছিলেন তিনি।

১৯২৫ সালে একজন নির্দল প্রার্থী হিসাবে ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন বিধানচন্দ্র রায়। সেটা ছিল বেঙ্গল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের নির্বাচন। এই নির্বাচনে তিনি বাংলার আর এক দিকপাল ব্যক্তিত্ব সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় যিনি গ্র্যান্ড ওল্ড ম্যান অফ বেঙ্গল নামে পরিচিত ছিলেন তাঁকে পরাস্ত করেন। নির্দল প্রার্থী হিসাবে ভোটে দাঁড়ালেও বিধানচন্দ্র রায়কে সমর্থন দিয়েছিল স্বরাজ পার্টি, যা সেই সময় কংগ্রেসের পার্লামেন্টারি উইং নামে পরিচিত ছিল।

 

বেঙ্গল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে ১৯২৫ সালে বিধানচন্দ্র রায় হুগলির দূষণ নিয়ে সওয়াল করেন। আর এই দূষণ রোধে তিনি একটি খসড়া প্রস্তাবও পেশ করেছিলেন।

১৯২৮ সালে কংগ্রেসের জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন বিধানচন্দ্র রায়। ১৯২৯ সালে কলকাতায় আইন অমান্য করতে গিয়ে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন তিনি। আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে ৬ মাসের বন্দিদশা কাটাতে হয়েছিল তাঁকে। ১৯৩১ সালে ডান্ডি অভিযানের সময় কলকাতা কর্পোরেশনে বহু কংগ্রেস সদস্যকে জেলে পুরে দেওয়া হয়। কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্বের অনুরোধে জেলের বাইরে থেকে কলকাতা কর্পোরেশনের হাল ধরেন বিধানচন্দ্র রায় এবং পরে ১৯৩১ থেকে ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত মেয়র হিসাবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। কলকাতা কর্পোরেশনের মাধ্যমে শহরে বিনামূল্যে শিক্ষা প্রসার থেকে শুরু করে বিনা খরচে চিকিৎসার সুবিধা, ভালো রাস্তা-ঘাট, রাস্তাঘাটে আলোর বন্দোবস্ত এবং পানীয় জলের সুবন্দোবস্ত করেন মেয়র বিধানচন্দ্র রায়।

স্বাধীনতার পরে নিজেকে আরও বেশি করে চিকিৎসাসেবা নিয়োজিত করতে চেয়েছিলেন বিধানচন্দ্র রায়। কিন্তু, জহরলাল নেহরুর হাজারো অনুরোধে তিনি শেষমেশ বাংলার দ্বিতীয় মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ নিতে রাজি হন। দুরদৃষ্টি সম্পন্ন এবং মানুষের সেবায় আজীবন নিয়োজিত বিধানচন্দ্র রায় এরপর বাংলার উন্নতিতে যে সোপান তৈরি করেছিলেন, তা সারা দেশের কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে থেকে গিয়েছে। আজও বাংলার বুকে যে উন্নয়নের ভিত পাওয়া যায় তার পুরোধা বিধানচন্দ্র রায়। বলতে গেলে তাঁর পরবর্তী সময়ে বাংলা উন্নয়ন হলেও বিধানচন্দ্র রায়ের অবদানকে ছাপিয়ে যেতে পারেনি। ১৯৬১ সালের চৌঠা ফেব্রুয়ারি তাঁকে ভারতরত্ন সম্মানে সম্মানিত করা হয়। ১৯৬২ সালের ১ জুলাই প্রয়াত হন ডক্টর বিধানচন্দ্র রায়। জন্মদিনেই অমৃতলোকে পাড়ি জমান আধুনিক বাংলার জনক। 

আরও পড়ুন--  
বাংলা তথা দেশের সেরা চিকিৎসক ও রাজনীতিবিদ, যার সম্মানে পালিত হয় চিকিৎসক দিবস 
নৌকায় বসে গান গাইছেন বাউলরা, বিধানচন্দ্র রায় -এর স্মরণে চলল বাউল গান

Read more Articles on
Share this article
click me!