১৭৯০ সাল নাগাদ শুরু হয় শোভাবাজার রাজবাড়ির ছোট তরফের দুর্গা পুজো।একটা সময় এই বাড়ির সন্ধিপুজোর সূচনা হত কামান দেগে। শহর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ত সে শব্দ।
শোভাবাজার রাজবাড়ির ছোট তরফের পুজো শুরুর ইতিহাস -
রাজা নবকৃষ্ণদেব অপুত্রক ছিলেন বলে দাদার ছেলে গোপীমোহন দেবকে দত্তক নিয়েছিলেন।এর কিছুদিন পরেই ১৭৮২ সালে নবকৃষ্ণের চতুর্থ স্ত্রী একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেন। পুত্র রাজকৃষ্ণ দেব জন্মগ্রহণ করলে পরিবারের সম্পত্তি দুই ভাগে ভাগ করে দেওয়া হয়। পুরনো বাড়ির দক্ষিণ দিকে বিশাল আর একটি বাড়ি তৈরি করা হল।১৭৯০ সাল নাগাদ সেখানেও শুরু হয় দুর্গা পুজো। এই পুজো ছোট বাড়ির পুজো বা ছোট তরফের পুজো নামে পরিচিত।লিখেছেন, সংবাদ প্রতিনিধি অনিরুদ্ধ সরকার।
অতীত ঐতিহ্য মেনে পুজো-
রাজবাড়ির ছোটতরফের কাঠামো পুজো হয় উল্টো রথের দিন। মহালয়ার দিন দেবীর চক্ষুদান করা হয়। কৃষ্ণা নবমীর দিন ঘট স্থাপন করা হয়, হয় বোধনও। চণ্ডীপাঠও শুরু সে দিন থেকেই। এর পরে ষষ্ঠী পর্যন্ত টানা চলতে থাকে চণ্ডীপাঠ। সুরেলা মন্ত্রোচ্চারণে মথিত হয় গোটা বাড়ি। শুক্ল প্রতিপদ থেকে পঞ্চমী পর্যন্ত দেবীকে দেওয়া হয় নানা প্রসাধনী- অঙ্গরাগ, কেশ সংস্কারের সামগ্রী, সুগন্ধী আতর, আলতা সিদুঁর,কাজল।
দেবীমূর্তি ও সাজসজ্জা-
শোভাবাজার রাজবাড়ির ছোটতরফের মূর্তিও একচালার। ডাকের সাজে দেবীকে সাজানো প্রথম থেকেই রীতি এ বাড়িতে। আগে জার্মানি থেকে অর্ডার দিয়ে ডাকের সাজ আনানো হত। সেই প্রথা বহুদিন আগে বন্ধ হওয়ার পরে কৃষ্ণনগরের শিল্পীরাই পরম যত্নে দেবীর সাজ বানিয়ে দেন। তবে দুই তরফেই প্রথম থেকেই পুজোর পোশাক হয় রাজস্থানী ঘরানার। ছোট তরফের সিংহের চেহারা বড় তরফের চেয়ে আলাদা। সিংহের মুখ অনেকটা সিংহীর মতো, গায়ের রং রূপোলি। আগে বিদেশ থেকে রুপোর পাত এনে সিংহের গা মুড়ে দেওয়া হত প্রতিবছর। সেই পাত-সহই প্রতিমা বিসর্জন হত। এখন আর তা সম্ভব হয় না। তবে সিংহের গায়ের রং এখনও প্রথা মেনে রুপোলিই রাখা হয়। ষষ্ঠীর দিন দেবীকে গয়না পরান পরিবারের সদস্যরা। রুপোর অস্ত্রশস্ত্র ওঠে দেবীর হাতে।
পুজো পদ্ধতি-
ছোটতরফের গোপীনাথজিউকেও উপরে নিয়ে যাওয়া হয়। সন্ধিপুজোর সূচনা হত কামান দেগে। শহর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ত সে শব্দ। ছোট তরফে আজও সন্ধি পুজোর আগে শূন্যে গুলি ছুঁড়ে পুজোর সূচনা করা হয়।ছোট তরফে অবশ্য সাবেক নিয়ম মেনে এখনও ছাগ বলি হয়। সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী তিন দিনে তিনটি।
দেবীকে সিধে দেওয়া হয়-
ছোট তরফে দেবীকে 'সিধে' দেওয়া হয়। এর মধ্যে থাকে চাল, ডাল, আনাজপাতি, মশলা, মানকচু, রুইমাছ, সৈন্ধব লবন, শাড়ি ও ধুতি।
কনকাঞ্জলি প্রথা-
বাড়ির মেয়েরা বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার সময় যেমন কনকাঞ্জলি দেয়, এ বাড়ির দুর্গাও কৈলাশে ফেরার সময়ে কনকাঞ্জলি দেন। শোভাবাজার রাজবাড়ির দুই তরফেই এই প্রথা প্রচলিত আছে। আগে বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠা মহিলারা আঁচল পেতে সেই কনকাঞ্জলি নিতেন। সোনা রূপোর মুদ্রা, চাল দেওয়া হত তাতে। সেই দিন আর নেই।এখন দেওয়া হয় টাকা-পয়সা আর চাল। দেবীর হয়ে পুরোহিত পিছন দিকে এগুলি ফেলেন। বাড়ির বড়রা প্রতিমার পিছনে দঁড়িয়ে সেগুলি গ্রহণ করেন। প্রতিমা বিসর্জন দিতে বাড়ি থেকে রওনা করার সময় তলোয়ার এবং ঘোড়া পূজা করা হয়। মনে করা হয় এই তলোয়ারই সারা বছর পরিবারকে রক্ষা করবে বিপদ-আপদ থেকে।
দশমীর রেওয়াজ-
দশমীর দিন নীলকন্ঠ পাখি ওড়ানোর রেওয়াজ ছিল তা এখন বন্ধ। তার জায়গায় মাটির নীলকন্ঠ পাখি তৈরি করে দেবীর সঙ্গেই সেগুলির পুজো করে ছোটতরফ। তারপর গঙ্গায় গিয়ে বিসর্জন দেয়। সেই সঙ্গেই বাড়ি থেকে বেরনোর সময়ে এবং পরে দুটি নীলকণ্ঠ পাখি আঁকা ফানুস ছাড়ে। এরপর মাঝগঙ্গায় জোড়া নৌকায় করে প্রতিমা নিয়ে গিয়ে বিসর্জন দেওয়া হয়
ভোগবৃত্তান্ত-
শোভাবাজার রাজবাড়ির ছোট তরফে এক সময়ে বিশাল বিশাল থালায় ১ কিলো ওজনের সাদা রংয়ের মোতিচুর লাড্ডু ভোগে দেওয়া হত, তাতে থাকত গোলমরিচ আর এলাচ। বিশালাকার জিভেগজা,এক আঙুল সমান উঁচু জিলিপি-সব মিলিয়ে আকারে আয়তনে দেখার মতো ছিল সেকালের ভোগের আয়োজন।
বিসর্জন -
শোভাবাজার রাজবাড়ির বিসর্জন প্রথম দিন থেকেই এক জমজমাট ব্যাপার। দু’বাড়ির থেকে ৩২ থেকে ৪০জন বাহক দেবীকে বহন করে গঙ্গায় নিয়ে যায়। বাড়ির ঠাকুরদালানের উপরে রয়েছে অস্ত্রাগার। পলাশীর যুদ্ধের সময়কার বল্লম, তলোয়ার গদা এখনও রাখা আছে এখানে। আগে এগুলি নিয়ে বাড়ির লোকেরা বিসর্জনের সময়ে দেবীর সাথে যেতেন। বিসর্জনের পথের দু’দিকে হাতে হাত জড়িয়ে মানবশৃঙ্খল তৈরি করে ঘিরে দেওয়া হত পুরো রাস্তা। সত্তরের দশকে কলকাতার অশান্ত সময়ের জন্য অস্ত্র নিয়ে শোভাযাত্রা বন্ধ করে দেওয়া হয়। তারপর থেকে তা চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়।
আরও পড়ুন-
ঢাকের তালে সাড়ম্বরে উদ্বোধন হল চালতাবাগান লোহাপট্টির দুর্গাপুজোর মণ্ডপ, আনন্দে মাতলেন সুদীপ,শ্রীজাত, শশী পাঁজা
স্বৈরাচারী রাজার বিনাশের পর কীভাবে শুরু হয়েছিল সাবর্ণ রায় চৌধুরীদের বাড়ির দুর্গাপুজো?
বাঈজি নাচ থেকে বলড্যান্স, নবাব সিরাজের অর্থ পেয়ে শোভাবাজার রাজবাড়ির দুর্গাপুজোয় এসেছিল ইংরেজরেজদের বৈভবের ছাপ