আপাতত তিনটি ‘মোমো চিত্তে’-র আউটলেট। আরও দুটো খুলে যাবে এ বছরেই। একটি পুজোর আগে। একটি শীতে। স্বপ্ন, ১০০টি ক্যাফে হবে।
মৌমিতা মিস্ত্রি, কলকাতা--- সময়টা করোনা-কাল। আমি একটি বেসরকারি বিবাহ প্রতিষ্ঠানের কর্মী। রাজ্যে লকডাউন। বুঝে গিয়েছি, যে কোনও সময় আমাদের সংস্থাও সাময়িক বিরতি নেবে। কিন্তু আমি তো বসে থাকার বান্দা নই। অজয় নগরে বাড়ি। পাড়ায় বাবার মুদির দোকান। দাদা-দিদিরা সরকারি স্কুলের শিক্ষক। আমারও সরকারি অফিসে চাকরিরই ইচ্ছে। ভূগোলে স্নাতক। বাবাকে সবাই বেশ অন্য নজরেই দেখতেন। নিজেকে তৈরি করার পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেছিলাম। কিন্তু একটুও খুশি নই। বলতে পারেন, লকডাউন, করোনা আমার জীবনে শাপে বর। তখনই ভাবলাম, কারওর অধীনে থাকব না। স্বাধীন ব্যবসা করব। এ দিকে পুঁজি নেই। তা হলে কী করতে পারি?
আমার মায়ের ডায়াবেটিস। তাই ছোট থেকেই ঘরের কাজ, রান্নাবান্না সামলাতে হত। তা ছাড়া, আমি রাঁধতে আর খাওয়াতে ভীষণ ভালবাসি। আমাদের অজয় নগরে মোমোর অনেক দোকান আছে। কিন্তু আমি যে পাড়ে থাকি সেখানে একটাও এই খাবারের দোকান নেই। সবাই রাস্তা পেরিয়ে উল্টো পাড়ে গিয়ে মোমো কেনেন। সেটা মাথায় আসতেই ঠিক করলাম, গাড়িতে করে মোমো বেচব। আমার পুঁজি সামান্য। তার থেকে ঠেলাা গাড়ি বানাতেই খরচ হয়ে গেল কমবেশি ২৩ হাজার টাকা। বাকি রান্নার সরঞ্জাম। সে সব মিলিয়ে খরচ দাঁড়াল ৩৮ হাজার টাকা। ‘ঠাকুর ঠাকুর’ বলে নির্দিষ্ট দিনে কাজ শুরু করলাম। একই পাড়ায় বাবা-মেয়ের ভিন্ন ব্যবসা! লোকে ছিঃ ছিঃ করতে শুরু করল। তাঁদের টিপ্পনি, ‘‘লেখাপড়া শিখে শেষে এই!’’
ব্যবসা দাঁড় করাতে কাউকে পাশে পাইনি। একটি মেয়ে ঠেলা গাড়িতে করে ঘুরে ঘুরে মোমো বিক্রি করবে! কে সমর্থন করবে? মা-বাবা আর প্রেমিক-স্বামী ছাড়া আর কেউ উঁকি দিয়েও দেখেননি। না আত্মীয়, না পড়শি, না বন্ধু— সবাই নিমেষে অচেনা। গায়ে মাখিনি। ভেঙেও পড়িনি। দাঁতে দাঁত চেপে বিক্রি শুরু করেছি। তখন আমি শুধুই চিকেন মোমো বিক্রি করতাম। প্রথম দিন সাত প্লেটও বিক্রি হয়নি। চোখে জল এসেছিল বর্ষাকালে। ঠেলা গাড়ির মাথায় প্লাস্টিকের ছাউনি। ঝড়ে সে সব উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছে। বৃষ্টির জলে পাম্প স্টোভের আগুন নিভে যা তা অবস্থা। কী করে বিক্রি করব? হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলেছিলাম।
এ ভাবেই আপাতত তিনটি ‘মোমো চিত্তে’-র আউটলেট। আরও দুটো খুলে যাবে এ বছরেই। একটি পুজোর আগে। একটি শীতে। স্বপ্ন, ১০০টি ক্যাফে হবে। সেখানে শেফ বাদে সব সামলাবেন মেয়েরা। নিজে মেয়ে হয়ে দেখলাম তো, মেয়েদের চট করে কেউ কাজ দিতে চায় না। সমর্থনও করে না। আমি যতটা পারব সেই অভাব পূরণ করব। মোমো বিক্রি করতে করতেই দেখেছি, ক্রেতারা ফিউশন মোমো খেতে চান। সেখান থেকেই পিৎজা মোমো সহ কমবেশি ৩০ রকমের মোমো আমার দোকানে পাওয়া যায়। ক্যাফেতে সঙ্গে মকটেল, স্যান্ডউইচ। যা চটপট বানানো যায়। ঝটপট পেট ভরায়।
আমার স্বামী বাবাই একটি ফুড ডেলিভারি চেনে চাকরি করতেন। আমার ব্যবসা সামলাবেন বলে সেই চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন! জানেন, তিনটি আউটলেট খুলতে কারওর কাছে এক পয়সাও নিইনি। ব্যাঙ্কের থেকেও না। একটি ক্যাফের লভ্যাংশ দিতে অন্য ক্যাফে খুলেছি। তবে আগামিতে ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নেব। নতুন ক্যাফেগুলো যাতে আরও আকর্ষণীয় হয় তার জন্য। ক্যাফের নামও আমার দেওয়া। বাঙালি আজও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলতে অজ্ঞান। বিশ্বকবির থেকেই ধার নিয়ে তাই আমার ক্যাফের নাম ‘মোমো চিত্তে’। অর্থাৎ, সবার মনে আমার মোমো যেন জায়গা করে নেয়।
যাঁরা ব্যঙ্গ করেছিলেন আজ তাঁরা চুপ। আমার কোনও ক্ষোভ নেই। দুঃখ, রাগ, নিজের কাজ নিয়ে লজ্জা—কিচ্ছু নেই। আমি যা করেছি, করব--সব সৎ ভাবে খেটে করব। ইতিমধ্যেই জি বাংলার ‘দিদি নম্বর ১’, ‘সুদীপার রান্নাঘর’-এ অংশ নিয়েছি। ক্রেতারা সত্যিই মৌমিতার মোমো ভালবেসে খান। তাই রান্নার সঙ্গে আমার কোনও সমঝোতা নেই। কোনও রাসায়নিক রং, প্রক্রিয়া না মিশিয়ে, খাদ্যগুণ বজায় রেখে প্রতিটি মোমো রান্না করা হয়। নিজের ঠেলা গাড়ির দোকান সামলে প্রতি রাতে নিজে ক্যাফেতে যাই। সব কিছুর তদারকি করতে। কারণ, আমার মোমো খাওয়ার জন্য হবু মায়েরাও যে লাইনে দাঁড়ান!
আরও পড়ুন--
'যাঁদের জন্য কোণঠাসা তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞ! আপনারা না থাকলে ঘুরে দাঁড়াতে পারতাম না'- শ্রীলেখা মিত্র
শাড়ি বেচে সংসার চালিয়েছেন, হার মেনেছে ক্যান্সার! দেবীর আশীর্বাদে ‘জয়ী’ ভারতী চক্রবর্তী
'শ্বশুরবাড়ির লোকেরাই মুখ ফিরিয়েছিলেন, এখন সবাইকে ডেকে বলেন, নন্দিনী তো আমাদেরই বৌমা!'