মুসলমান জেলের বাড়ির মাটির নিচে পাল রাজাদের আমলের কষ্টিপাথরের দুর্গামূর্তি, হালদার বাড়ির পুজোর সেই অমলিন ইতিহাস

হালদার পরিবারের এক আদিপুরুষ  মাটি খুঁড়ে মহিষাসুরমর্দিনীর একটি মূর্তি বের করে আনেন। অনুমান সেটি পালরাজাদের আমলের মূর্তি। কষ্টিপাথরের সেই মূর্তিটি আজও পূজিত হয়ে আসছে হালদার বাড়িতে। 

প্রায় চারশো বছরেরও বেশি প্রাচীন হালদার বাড়ির দুর্গাপুজো কলকাতার মধ্যে অন্যতম প্রাচীন এবং ঐতিহাসিকভাবে প্রসিদ্ধ। সেকালের বিখ্যাত পত্রিকা ‘ক্যালকাটা গেজেট’-এর ১৮০৭ সালের ২০ সেপ্টেম্বর সংখ্যায় প্রাণকৃষ্ণ হালদারকে চূঁচুড়ার এক বিখ্যাত জমিদার বলে পরিচয় দেওয়া হয়েছে। আবার অন্যদিকে ‘সমাচারদর্পণ’ পত্রিকায় তাঁকে ‘বাবুদের বাবু’ বলে সম্বোধন করা হয়েছে। কলকাতার অন্যতম প্রাচীন পুজোর খোঁজ নিলেন অনিরুদ্ধ সরকার।


পুজো শুরু - 
জমিদার প্রাণকৃষ্ণ হালদারের এক বিশাল প্রাসাদ ছিল চুচূঁড়ায় যা পরে স্কুলে পরিণত হয়। পরবর্তীকালে কলকাতার বাগবাজারে আরেকটি প্রাসাদোপম বাড়ি তৈরি করেন তিনি, এই বাড়িটিই এখনকার বিখ্যাত হালদারবাড়ি বলে পরিচিত। এই বাড়তেই শুরু হয় দুর্গাপুজো। হালদারবাড়ির উত্তরসূরি প্রাণকৃষ্ণ হালদারের সময় কষ্টিপাথরের একটি দেবীমূর্তি চর্চার আলোয় উঠে আসে। ১৮০৭-০৮ নাগাদ প্রাণকৃষ্ণ হালদারের বাড়িতে দুর্গাপুজো উপলক্ষে নৃত্য পরিবেশনায় আমন্ত্রণপত্রটিও প্রকাশিত হয়েছিল ‘ক্যালকাটা গেজেট’ পত্রিকায়। 

Latest Videos


কষ্টিপাথরের মূর্তিতে দেবীপুজো- 
হালদারবাড়ির কোনো এক পূর্বপুরুষ চন্দননগরের ন’পাড়ায় থাকতেন। একবার নিছক ভ্রমণের জন্যেই তিনি ওড়িশার বালাসোরের কাছে সাহেবপুর প্রাসাদে গিয়ে ওঠেন। সেখানে থাকার সময়েই তিনি এবং তাঁর কয়েকজন সঙ্গী-সাথী স্বপ্নাদেশ পান এক মুসলিম জেলের বাড়িতে মাটির নীচে প্রায় ১৪ ফুট গভীরে দেবীর মূর্তি রয়েছে যা খুঁড়ে বের করতে হবে। শুধু তাই নয় সেই মূর্তিকে প্রতিষ্ঠা দিয়ে নিত্য পুজো করতে আদেশ করেন দেবী। স্বপ্নাদেশ মতো হালদার পরিবার মাটি খুঁড়ে দেবীর মহিষাসুরমর্দিনী মূর্তি বের করে আনে। কষ্টিপাথরের সেই মূর্তিটিই আজও পূজিত হয়ে চলেছে। দেবী মূর্তির মাথার দিকে দেখা যায় মহাকালের মুখ আর দেবীর পায়ের নীচে বসে আছেন জয়া এবং বিজয়া। সমগ্র মূর্তি একটি পদ্মের উপর অধিষ্ঠিত।


মূর্তির প্রাচীনত্ব - 
ঐতিহাসিকদের মতে মূর্তির গায়ের কারুকার্য দেখে অনুমান করা হয় যে এটি পাল যুগের নিদর্শন যার ফলে সহজেই বলা যেতে পারে আজ থেকে প্রায় ৬০০-৭০০ বছর আগে মূর্তিটি নির্মিত হয়েছিল। এমনটাও হতে পারে বলে মনে করেন ঐতিহাসিকরা যে কোনো হিন্দু ভক্ত সেই সময়ের বাংলায় তুর্কি আক্রমণের ভয়ে বা সুলতানি শাসনে ইসলামি আগ্রাসন থেকে বাঁচাতে দেবীর মূর্তিকে মাটির নীচে পুঁতে দিয়েছিল। 


পুজোপদ্ধতি-  
পঞ্চমীতে বিধিসম্মতভাবে বোধন হয় এবং সেদিন বিকালে আমন্ত্রণ এবং অধিবাসের অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। এইদিন পুজোমণ্ডপে একটি জাগপ্রদীপ জ্বালানো হয়। অনির্বাণ এই প্রদীপ পরিবারের শুভ-অশুভের নির্ণায়ক বলে ধরা হয়।হালদারবাড়ির অন্য একটি শাখা-পরিবার বাগবাজারেই থাকায় মহাসপ্তমীর দিন এই দুই পরিবারের পক্ষ থেকে দুটি আলাদা নবপত্রিকা স্নান করানো হয়, বিশাল কারুকার্যখচিত ছাতার নীচে সেই নবপত্রিকাকে নিয়ে যাওয়া হয় মায়ের ঘাটে স্নান করাতে। মহাঅষ্টমীর দিন সবথেকে বড়ো অনুষ্ঠান এখানকার সন্ধিপুজো। একশো আটটা পদ্ম আর ঐ একই সংখ্যক প্রদীপ জ্বালিয়ে সন্ধিপুজোয় দেবীর আরাধনা করা হয় হালদারবাড়িতে। এই প্রদীপগুলি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন আকারে সাজানো হয় – ত্রিনয়ন, প্রজাপতি, ত্রিশূল, কল্পতরু গাছ বিভিন্ন রকম আকারে সাজানো হয়ে থাকে প্রদীপগুলি।





নবমীর কুমারী পুজো- 
মহানবমীতে মহাসমারোহে কুমারী পুজো হয়ে থাকে এখানে। এখানে একটা বিষয় খুবই উল্লেখযোগ্য তেরো বছর বয়সী কুমারীকে মহালক্ষ্মীরূপে এবং ষোলো বছর বয়সী কুমারীকে অম্বিকারূপে পুজো করা হয়ে থাকে। দেবীপুরাণে ব্রাহ্মণ কন্যার উল্লেখ থাকলেও বিভিন্ন সময় পুজোর উদ্দেশ্যভেদে কখনো জয়লাভের উদ্দেশে ক্ষত্রিয়কন্যা এবং কখনো ব্যবসায়িক সমৃদ্ধির উদ্দেশে বৈশ্য কন্যাকে কুমারীরূপে পুজো করা হয়ে থাকে।


ভোগবৃত্তান্ত-
অন্যান্য বাড়িতে যেমন পুজোর দিন অষ্টমী পর্যন্ত বাড়ির সকলে বিশেষত মহিলারা নিরামিষ খেয়ে থাকেন তা এখানে মানা হয় না।মহাষষ্ঠীর দিন হালদার বাড়ির মহিলারা মাছ-ভাত খেয়ে পান চিবোতে চিবোতে দেবীকে বরণ করেন। উপবাস কিংবা নিরামিষ আহার মানেন না হালদাররা। দশমীর দিন মাছ-ভাত খেয়ে বাড়ির মহিলারা মুখে পান দিয়ে ঘটের গঙ্গাজল বিসর্জন করাতে যান ঘাটে। 


বিসর্জন- 
মহাদশমীর বিসর্জনের পালা। হালদারবাড়ির দুর্গামূর্তি কখনো বিসর্জন হয় না বলে শুধুমাত্র ঘটের গঙ্গাজল পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই বিসর্জনের রীতি পালিত হয়ে থাকে। সাধারণভাবে নিত্যপুজোর জন্য দেবীর মুখ পশ্চিমদিকে ঘোরানো থাকলেও, পঞ্চমী থেকে দশমী পর্যন্ত দেবীর মুখ দক্ষিণদিকে ঘোরানো থাকে। কারণ হালদার বাড়ির মানুষ বিশ্বাস করেন যে দেবী এইসময় উত্তরের কৈলাস ছেড়ে দক্ষিণে মর্ত্যে আসেন।


আরও পড়ুন-
দেবীর বিসর্জনের পর গলায় বাজে স্বদেশী গান, নেতাজি সুভাষচন্দ্রের দাদুর বাড়ি হাটখোলার দত্ত বাড়ির দুর্গাপুজোর গল্প
ইউরোপের 'আড্ডা'-য় দুর্গাপুজোর আজ ষষ্ঠী, দেখে নিন প্রবাসের মাটিতে খাদ্যরসিক বাঙালিদের পেটপুজোর কিছু ছবি
ক্ষতিগ্রস্ত জাহাজের নিলাম থেকে বুলবুলির লড়াই, ছাতুবাবু লাটুবাবুর বাড়ির দুর্গাপুজোর কাহিনীটি বড়ই অদ্ভুত!

Read more Articles on
Share this article
click me!

Latest Videos

হঠাৎ করে TMC নেতারা পুলিশের বিরুদ্ধে কেন? কী উদ্দেশ্যে? প্রশ্ন অগ্নিমিত্রার | Agnimitra Paul
Naihati-তে কার পাল্লা ভারী? ফল ঘোষণার আগে উত্তেজনা তুঙ্গে গোটা এলাকায় | Naihati By Election Results
ট্যাব কেলেঙ্কারির প্রতিবাদে শিক্ষকদের জোরদার বিক্ষোভ! দাবি সঠিক তদন্তের! | Bengal Tab Scam
'কয়লার ৭৫ ভাগ তৃণমূলের (TMC) পকেটে যায়' বিস্ফোরক অভিযোগ শুভেন্দুর (Suvendu Adhikari)
Bear Rescue Operation | বরফের মধ্যে ভাল্লুকের প্রান বাঁচাল ভারতীয় সেনা, দেখুন দুঃসাহসিক ভিডিও