কলকাতার বিখ্যাত ব্যবসায়ী রামদুলাল দে-র দুই পুত্র ছাতুবাবু ওরফে আশুতোষ দেব এবং লাটুবাবু ওরফে প্রমথনাথ দেব ছিলেন শৌখিন এবং খরুচে। বুলবুলির লড়াই থেকে শুরু করে কুস্তির আখড়া, সবই ছিল তাঁদের নেশার মধ্যে। তাঁদের আমলে সেজে ওঠে বিরাট ঠাকুরদালান, চোখধাঁধানো ঝাড়বাতি।
বিডন স্ট্রিটে বড় রাস্তার একখানা লাল বাড়ি দেখতে পাওয়া যায়। বড় গেট। বড় থাম। অসাধারণ সব কারুকাজ। আর দেখতে দেখতে চোখে পড়ে শ্বেতপাথরের ফলকে রামদুলাল দে ছাড়াও লেখা রয়েছে আরও দুটো নাম— ছাতুবাবু আর লাটুবাবু। গলির মোড় থেকে শেষ পর্যন্ত দুই দিক নিয়ে যে বিশাল বাড়ি ছিল, তা-ও আজ বহু শরিকে বিভক্ত। শতাব্দী প্রাচীন এই পুজোর খোঁজ নিলেন অনিরুদ্ধ সরকার।
প্রাণপুরুষ রামদুলাল দে-র কাহিনী
হাটখোলা দত্তবাড়ির মদনমোহন দত্তের কর্মচারী হিসেবে ডুবন্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত জাহাজের নিলামে দত্ত বাড়ির হয়ে অংশ নিতে নিতে এই ব্যাপারে প্রভূত দক্ষতা অর্জন করেন রামদুলাল দে। এর পর মদনমোহন দত্তের উৎসাহে নিজের ব্যবসা শুরু করেন। শোনা যায়, আমেরিকান ব্যবসায়ীদের সঙ্গে লেনদেন চলত তাঁর। সদ্য স্বাধীন হওয়া আমেরিকা সেই সময় নিজেদের জন্য ব্যবসার নতুন ক্ষেত্র খুঁজছে। ১৭৯০-এর মধ্যে আমেরিকার সঙ্গে ইংরেজ শাসিত ভারতের ব্যবসা-বাণিজ্যের ভিত সুদৃঢ় ভাবে স্থাপিত হয়ে যায়। এই সময় বস্টন, সালেম, ফিলাডেফিয়া, নিউ ইয়র্ক থেকে প্রচুর জাহাজ বাংলায় আসত লোহা, ব্রান্ডি, নানা সামুদ্রিক মাছ, গরুর মাংস, মোমবাতি— এ সব নিয়ে। বিনিময়ে কলকাতা থেকে তারা নিয়ে যেত চা, চিনি, নীল এবং নানা ধরনের বস্ত্র।এই কাজে আমেরিকানদের সহায়তা করতেন এ দেশীয় ‘বেনিয়া’ সম্প্রদায়। রামদুলাল দে ছিলেন যাদের মধ্যে অগ্রগণ্য।
ছাতুবাবু-লাটুবাবুর কথা-
মারা যাওয়ার সময় রামদুলাল দে তাঁর বিপুল সম্পত্তি দুই সন্তান ছাতুবাবু এবং লাটুবাবুর জন্য রেখে যান। আশুতোষ দেব ওরফে ছাতুবাবু এবং প্রমথনাথ দেব ওরফে লাটুবাবুও ব্যবসা করে প্রভূত সম্পদ অর্জন করেন। এই দুই ভাই ছিলেন অতি শৌখিন এবং খরুচে। বুলবুলির লড়াই থেকে শুরু করে কুস্তির আখড়া, সবই ছিল তাঁদের নেশার মধ্যে। ছাতুবাবু লাটুবাবুর আমলে সেজে ওঠে তাদের বিরাট ঠাকুরদালান, চোখধাঁধানো ঝাড়বাতি।
পুজো শুরু কবে থেকে-
রামদুলাল দে-র সময়েই এই বাড়িতে প্রথম দুর্গাপুজো শুরু হয়। আর পুজো প্রাণ পায় ছাতুবাবু লাটু বাবুর হাতে। জাঁকিয়ে পুজো শুরু করেন দুভাই।
পুজো পদ্ধতি-
রথের দিন কাঠামো পুজোর পর প্রতিপদ থেকে শুরু হয় পুজো। বাড়ির প্রবীণ সদস্য কল্যাণ দেব জানালেন, প্রতিপদ থেকে ষষ্ঠী পর্যন্ত গৃহদেবতা শালগ্রাম শিলার পুজো করা হয়। তৃতীয়াতে দেবীকে আসনে বসানো হয়। পুরাণের বিধি মেনে শাক্ত শৈব এবং বৈষ্ণব মতে পুজো হয়। এই বাড়ির পুজোয় দেবীর পাশে লক্ষ্মী-সরস্বতী থাকেন না। পদ্মের উপর থাকেন জয়া আর বিজয়া। মা দুর্গার দুই সখী।
অষ্টমীর সন্ধিপুজো এবং বলি-
সন্ধিপুজোর সময় যখন দেবী অসুরকে নাশ করেন বলে মনে করা হয়, ঠিক সেই সময় ১০৮টি কারুকার্য করা রূপোর প্রদীপ জ্বালিয়ে দেওয়া হয় দেবীর সামনে। প্রদীপের স্নিগ্ধ আলোয় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে মাতৃমুখ। আগে পুজোর সময় পাঁঠাবলি হত। বলা হয়, বলি দেওয়ার সময় পাঁঠাটি ছুটে চলে আসে সামনে দাঁড়ানো রামদুলাল দে-র কাছে। সেই থেকে এই পুজোয় পাঁঠাবলি বন্ধ হয়ে যায়। এখন আঁখ, চালকুমড়ো, শসা বলি হয় পুজোর তিন দিন।
নবমীর পুজো-
এই বাড়িতে কুমারী পুজোও হয়। বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠ মহিলারা নিজের হাতে পুরোহিতের সাহায্যে এই পুজো করেন। এই বাড়িতে অন্নভোগ হয় না। ঠাকুরকে নৈবেদ্য দেওয়া হয়। দেবীর সঙ্গে সঙ্গে পঞ্চদেবতা নবগ্রহ এবং ৬৪ দেবদেবীকে পুজো দেওয়া হয়।
ভোগবৃত্তান্ত-
এই বাড়ির ভোগ ছিল দেখার মতো। ঠাকুরকে বিরাট আকার আয়তনের সিঙাড়া, নিমকি লেডিকেনি-সহ ৬ রকমের নোনতা মিষ্টি দেওয়া হত। সেই জিনিসই প্রসাদ হিসেবে বিতরণ করা হত দর্শনার্থী এবং নিমন্ত্রিতদের মধ্যে। এখন ঠাকুরের ভোগের জন্যই শুধু এত বড় মিষ্টি তৈরি হয়। অষ্টমীর দিন বাড়িতে মহাভোজের আয়োজন করা হয়।
দশমী ও বিসর্জন-
দশমীতে ঘট বিসর্জনের পর দেবীকে অপরাজিতা রূপে পুজো করা হয়। সব বনেদি বাড়ির মতো এই বাড়িতেও আগে নীলকণ্ঠ পাখি ওড়ানো হত। নীলকণ্ঠ নিষিদ্ধ হওয়ার পর পায়রার গলায় নীল রং করে ঠাকুর বিসর্জনের সময় ওড়ানো হত। এখন অবশ্য সে প্রথাও বন্ধ। একই ভাবে বন্ধ হয়ে গিয়েছে জোড়া নৌকায় ঠাকুর বিসর্জন। এই বাড়িতে ঠাকুরকে দুই নৌকার মাঝে দোলনার মতো করে ঝুলিয়ে দেওয়া হত। মাঝগঙ্গায় গিয়ে দোলনার দড়ি আলগা করে ঠাকুরকে বিসর্জন দেওয়া হত।
পণ্ডিত বিদায়-
এই বাড়ির সাথে জড়িত একটি অন্যতম রেওয়াজ হল পণ্ডিতবিদায়। দুর্গাপুজোর সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক না থাকলেও মনে করা হত, বছরের সব থেকে শুভ উৎসব ব্রাহ্মণ এবং পণ্ডিতদের দান করে শুরু করা উচিত। পুজো শুরুর সময় থেকে আজ পর্যন্ত সেই জন্য বিশ্বকর্মা পুজোর আগের দিন শহরের ব্রাহ্মণ এবং পণ্ডিতদের বিশেষ দান করা হয়।
আরও পড়ুন-
এক লাঠির ঘায়ে কুপোকাত হয়েছিল ৬ ডাকাত, ঐতিহ্যবাহী টাকি রাজবাড়ির দুর্গাপুজো বৈষ্ণব থেকে মিলে গিয়েছিল শাক্ত ধারায়
পেতলের টিকিট দেখিয়ে চোরবাগানের শীল বাড়ি থেকে টাকা পেতেন গরীব-দুখীরা, জেনে নিন সেই বাড়ির দুর্গাকথা
বিদ্যাসাগরের বহু আগে বিধবা বিবাহ দিয়েছিলেন মতিলাল শীল, তাঁর দুর্গাপুজোর জমকে তাক লেগেছিল সমস্ত কলকাতাবাসীর