দেবীর বিসর্জনের পর গলায় বাজে স্বদেশী গান, নেতাজি সুভাষচন্দ্রের দাদুর বাড়ি হাটখোলার দত্ত বাড়ির দুর্গাপুজোর গল্প

বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহের অন্যতম সমর্থক ছিলেন গোবিন্দরাম দত্ত। তাঁর নামেই নাকি সেকালের গোবিন্দপুরের নামকরণ হয়েছিল। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ছিলেন এই বাড়ির দৌহিত্র। 

আহিরীটোলা জোড়াবাগান থানার কাছেই ৭৮ নম্বর নিমতলা ঘাট স্ট্রীটে দীর্ঘ দুশোবছরেরও বেশি সময় ধরে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে হাটখোলার দত্তবাড়ির পুজো। আজও বিজয়া দশমীতে প্রতিমা বিসর্জনের পরে বাড়ির সদস্যরা গঙ্গার ঘাট থেকে স্বদেশি গান গাইতে গাইতে বাড়িতে ফেরেন। দত্ত বাড়ির অতীত ইতিহাস খুঁজলেন অনিরুদ্ধ সরকার। 

হাটখোলার দত্তদের ইতিহাস- 
জগৎরাম দত্ত ছিলেন ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ান। ইতিহাস বলে জগৎরাম দত্তের পূর্বপুরুষ গোবিন্দশরণ বা গোবিন্দরাম দত্তের নামেই নাকি সেকালের গোবিন্দপুরের নামকরণ হয়েছিল। সুতানুটি, গোবিন্দপুর আর কলকাতা এই তিন গ্রাম নিয়েই তৈরি হয়েছিল কলকাতা নগরী। এই গোবিন্দরাম বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহের অন্যতম সমর্থক ছিলেন।

Latest Videos


ইতিহাসপ্রসিদ্ধ কনৌজ থেকে এসে এই গোবিন্দপুরে বসবাস শুরু করে দত্ত পরিবার যা পরে আন্দুলে ছড়িয়ে যায়। আন্দুলের দত্ত চৌধুরী বাড়ির রামচন্দ্র দত্ত হাটখোলায় এসে বিরাট প্রাসাদোপম রাজবাড়িটি তৈরি করেন, সেসময় তাঁর পৌত্র জগৎরাম দত্ত বালক। পরে সেই জগৎরাম দত্ত এই নিমতলা স্ট্রিটের বাড়িতে প্রথম দুর্গাপুজো চালু করেন। কীভাবে তৈরি হল এই বাড়ির ঠাকুরদালান? শুনলে আশ্চর্য হয়ে যেতে হয়। দ্বারকা, পুরী, কাশী, হরিদ্বার প্রভৃতি সব তীর্থস্থান থেকে নৌকা বোঝাই করে পবিত্র মাটি এসেছিল কলকাতার গঙ্গাঘাটে যা দিয়েই তৈরি হয়েছিল ঠাকুরদালান। 


পুজো শুরু কবে থেকে- 
ঐতিহ্যবাহী এই পুজো শুরু হয়েছিল ১৭৯৪ খ্রিস্টাব্দে। সে বছর হাটখোলায় ভদ্রাসন পত্তন করেছিলেন জগৎরাম দত্ত। তাঁর তিন সন্তানের মধ্যে জ্যেষ্ঠপুত্র রামজয়ের উত্তরসূরিরা বর্তমানে এই পুজোর মূল হোতা।


পুজো পদ্ধতি- 
দত্ত পরিবার বৈষ্ণব। কাঠামো পুজো এখানে শুরু হয় উল্টোরথের দিন আর কাঠামো পুজোর পর থেকেই শ্রাবণ মাস নাগাদ এখানে দেবী প্রতিমা নির্মাণের কাজ শুরু হয়ে যায়। দত্তরা কায়স্থ, তাই পুজোর কাজে সরাসরি কেউ অংশ নিতে পারতেন না বলে পরিবারের কুলগুরুই এই পুজো পরিচালনা করতেন, কিন্তু সে রীতি এখন আর নেই। পোশাকহীন ঠাকুরের গায়ের রঙ-তুলি দিয়ে আঁকা হয় পোশাক। তবে বৈশিষ্ট্যসূচকভাবে বারোজন পণ্ডিত এই পুজোর আগে থেকে বিসর্জন পর্যন্ত দুর্গা ও চণ্ডী নাম জপ করেন হাটখোলার দত্তবাড়ির পুজোয়। দুর্গার বাহন সিংহ এখানে অশ্বমুখী। আর চালচিত্রের মধ্যে একদিকে রাধাকৃষ্ণের মূর্তি, একদিকে কালী আর রাম-সীতা থাকে। চালচিত্রের নীচে বিষ্ণুর দশাবতারের মূর্তি খোদাই করা থাকে দত্তবাড়ির দেবী প্রতিমা। সেকালে নবদ্বীপ থেকে শিল্পী শিবপ্রসাদ, কাঞ্চন প্রমুখরা আসতেন প্রতিমা রং করার জন্য। দেবী দুর্গার আবাহন হয় এখানে ষষ্ঠীর দিন, বেল বরণের মাধ্যমে দেবীর আবাহনের রীতি আজও সমানভাবে প্রচলিত আর এই সময়েই কেবল পারিবারিক কুলদেবতাকে নীচে নামানো হয়। কায়স্থ হওয়ার কারণে অষ্টমীর দিন অঞ্জলি দিতে পারেন না এই বাড়ির লোকেরা। তবে নবমী পুজোর দক্ষিণান্ত উপাচার শেষ হলে তারপর একমাত্র বাড়ির লোকেরা অঞ্জলি দিতে পারেন। খাঁটি বৈষ্ণবীয় রীতি মেনে হওয়া এই শক্তি আরাধনায় জীববলি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। বলি দেওয়া হয় ক্ষীরের পুতুল। সেই বলিও দেওয়া হয় আড়াল রক্ষা করে। কারণ, পরিবারের কোনও সদস্যের যে কোনও বলি দেখা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। 




ভোগবৃত্তান্ত- 
বৈষ্ণব ধারা মেনে এই বাড়ির ঠাকুরদালানে মা দুর্গার সামনে সাজানো হয় নিরামিষ ভোগ। বিশুদ্ধ ঘিয়ে ভাজা লুচি আর চিনির গুঁড়ো এই পুজোর ভোগের মূল বৈশিষ্ট্য। চিনিগুঁড়ো মানে, বাটা চিনি। নিরামিষ ভোগপ্রসাদে আরও বহু উপাদান থাকলেও দশভুজার সামনে লুচির পাশে গুঁড়ো চিনি থাকবেই। হাটখোলার দত্তবাড়িতে আরো নানারকম ভোগের মধ্যে আলুছাড়া সিঙাড়া, পোস্ত দিয়ে বানানো গজা খুব বিখ্যাত। মেদিনীপুর থেকে বামুন এসে এইসব মিষ্টি তৈরি করতেন দত্তবাড়ির ভিয়েনে।


সিঁদুর খেলার অভিনব রেওয়াজ- 
হাটখোলা দত্তবাড়ির দালানে বিজয়া দশমীতে কোনও সিঁদুরখেলা হয় না। চলে আসা রীতি মেনে সিঁদুরখেলা হয় মহাষ্টমীতে। 


দত্তবাড়ির পুজোয় স্বদেশীয়ানা- 
একটা সময় স্বাধীনতা সংগ্রামীরা ভিড় করত এই দত্ত বাড়িতে। গোপন মিটিংও কম হয়নি। এই বাড়ির দৌহিত্র সুভাষ চন্দ্র বসু।

স্বাধীনতার আগে স্বদেশি আন্দোলনের সময়ে কোনও ভাবে হাটখোলা দত্ত পরিবারের পুজোর সঙ্গে স্বদেশী গান গাওয়ার এক রীতি জড়িয়ে পড়ে। তার পর কেটেছে বহু দশক। ভারত স্বাধীন হয়েছে অনেকদিনই কিন্তু এখনও হাটখোলা দত্তবাড়ির পুজোর বিসর্জনে দেশাত্মবোধক সুর শোনা যায়। আজও বিজয়া দশমীতে প্রতিমা বিসর্জনের পরে বাড়ির সদস্যরা গঙ্গার ঘাট থেকে স্বদেশি গান গাইতে গাইতে বাড়িতে ফেরেন। তারপর শূন্য ঠাকুরদালানের সামনে সবাই বৃত্তাকারে দাঁড়িয়ে গেয়ে ওঠেন ‘বঙ্গ আমার জননী আমার’ গানটি। একে একে পালিত হয় আলিঙ্গন, শান্তির জল এবং অন্যান্য সব প্রথা।


গোমাতার সেবা- 
বহু প্রাচীনকালে নীলকন্ঠ পাখি ওড়ানোর পাশাপাশি একটি বাছুরকে বেঁধে রাখা হতো ঠাকুরদালানে। বিসর্জনের পরে ফিরে এসে তার পা ধুইয়ে তাকে ধরে উঠোন প্রদক্ষিণ করেন পরিবারের লোকেরা যাকে বৈতরণী পার বলা হয়। আসলে দত্তদের বিশ্বাস দেবীকে বিসর্জনের মধ্যে দিয়ে যে পাপ হয়, তা স্খালন করার জন্য গোমাতার পূজা করা হয়, একইসঙ্গে দুর্গার রূপ ভগবতীর আরাধনাও করতেন দত্তরা, তবে সেই রীতি আজ আর নেই।

আরও পড়ুন-
ইউরোপের 'আড্ডা'-য় দুর্গাপুজোর আজ ষষ্ঠী, দেখে নিন প্রবাসের মাটিতে খাদ্যরসিক বাঙালিদের পেটপুজোর কিছু ছবি
পেতলের টিকিট দেখিয়ে চোরবাগানের শীল বাড়ি থেকে টাকা পেতেন গরীব-দুখীরা, জেনে নিন সেই বাড়ির দুর্গাকথা
বিদ্যাসাগরের বহু আগে বিধবা বিবাহ দিয়েছিলেন মতিলাল শীল, তাঁর দুর্গাপুজোর জমকে তাক লেগেছিল সমস্ত কলকাতাবাসীর

Read more Articles on
Share this article
click me!

Latest Videos

Suvendu Adhikari Live: এগরায় জনসভা শুভেন্দুর, কী বার্তা, দেখুন সরাসরি
'কুমিল্লা ছেড়ে চলে যা' কুমিল্লায় বৃদ্ধ মুক্তিযোদ্ধার গলায় জুতোর মালা! | Bangladesh News |
'একটা আস্ত অশিক্ষিত...গোটা রাজ্যটাই জঙ্গিদের হাতে' কড়া বার্তা শুভেন্দুর | Suvendu Adhikari
Viral Video! আবাসের টাকা ঢুকতেই বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাটমানি চাইছেন TMC কর্মী | Murshidabad Latest News
‘Bangladesh-কে মারতে হবে না চোখ দেখালেই যথেষ্ঠ’ বাংলাদেশকে ধুয়ে দিলেন Dilip Ghosh | Bangladesh News