শাহরুখ খানের স্মৃতি ভোলার নয়। রোজের প্রেমে-অপ্রেমে জড়িয়ে গিয়ে তিনি ভুলতে দেন না কিছুতেই! বাস্তবে তাঁকে ছাড়া প্রেমে পড়া-ই যে বারণ…!
স্মৃতিগুলো আসলে মস্ত শয়তান! প্রেমের নাম রেখেছে শাহরুখ খান…… হ্যাঁ, শাহরুখ খানের জন্মদিন উপলক্ষে এটাই ছিল আমার সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট। শ্যুটিংয়ের ফাঁকে ফাঁকে তাই অজস্র স্মৃতি ভিড়ে করে এসেছে। আর শাহরুখের স্মৃতি মানে আসলে নিজেকেই ঘুরেফিরে দেখা। বিভিন্ন বয়সের আমি শাহরুখের ছবির অজুহাতে বছরের এই বিশেষ দিনে আমার সঙ্গে মেকআপ রুমে দেখা করে যায়। আমি টের পাই, শাহরুখের বয়স না বাড়ুক, ওঁর ছবি দেখতে দেখতে আমার বয়স দিব্যি বেড়েছে। শাহরুখ কত মহান তার খতিয়ান দেওয়ার আমি কেউ নই। এই লেখা আসলে নিজের স্মৃতির পুরনো কাপড় জুড়ে একটা নকশি কাঁথা বোনার চেষ্টা। শীত আসছে, মনে হল কাঁথাটা আপনাদের চোখের রোদ্দুরে মেলে রাখি। পরে জড়িয়ে নেব।
১৯৯৫, আমি পঞ্চম শ্রেণি। ফুলপিসির বাড়িতে আছি। হঠাৎ পিসতুতো দাদা রাজুদা এসে বলল, একটা দারুণ ছবি এসেছে। যাবি দেখতে? সিনেমা!! বলে কী? তখনও অবধি আমি সাকুল্যে ছবি দেখেছি দুটো। প্রথমটার স্মৃতি নেই। দ্বিতীয়টি ‘জুরাসিক পার্ক’। আমার ১০ বছরের দীর্ঘ জীবনে সিনেমা বলতে এই। তাই রাজুদার কথায় উত্তেজিত হয়ে আমার কুচিপুড়ি, সালসা নাচের দশা। প্রায় নাচতে নাচতেই প্রশ্ন করলাম, ‘‘কোন ছবি?’’ রাজুদার কথা শুনে আমার সালসা বন্ধ হয়ে গেল। মনে হল, আমার হৃদয় কেউ মালসায় তুলে নাচাচ্ছে! ‘দিলওয়ালে দুলহনিয়া লে যায়েঙ্গে’। এ কি আমি ঠিক শুনছি? বন্ধুর ঝাপসা ভিডিয়ো যাঁর ‘বাজিগর’-এ ঠোঁট কাঁপানো দেখে শিউরে উঠেছিলাম? যার ‘কভি হাঁ কভি না’ দেখে মাসতুতো ভাইয়ের পৈতে-তে এমন কেঁদেছিলাম যে সবাই ভেবেছিল আমার ভর হয়েছে! তাঁকে অর্থাৎ সেই শাহরুখ খানের ছবি এক্কেরে বড় পর্দায়! কেউ কারওর মা-বাবাকে বলবে না এই প্রতিজ্ঞা করে পৈতৃক প্রাণ নিয়ে দাদার সাইকেলের পিছনে উঠে পড়লাম। নবীনায় পৌঁছে বুক ভরা আশা দপ করে গেল নিভে। কাতারে কাতারে লোক। হাউজফুল বোর্ড ঝুলছে!
অবস্থা দেখে আমার মুখ লোডশেডিং। সেটা সম্ভবত রাজুদা দেখতে পেয়েছিল। আমাকে বলল, ‘‘সাইকেলটা ধর, আসছি।’’ বলেই ভিড়ে মিশে গেল। খানিক্ষণ পরে হাসতে হাসতে এসে বলল, ‘‘একটু বেশিই বেরিয়ে গেল। কিন্তু পেয়ে গিয়েছি, চল।’’ তার পর আড়াই ঘণ্টার ঘোরের কোনও ব্যাখ্যা আমার কাছে অনন্ত নেই। ‘মেরে খোয়াবো মে যো আয়ে’ গানে তাঁর প্রথম প্রবেশ থেকে শুরু হল চিৎকার আর পয়সা পড়া। সিনেমার শেষ যখন বেরোলাম, স্পষ্ট টের পেলাম, আমি কিছুটা বদলে গিয়েছি। অভিনেতা হিসেবে (৩ বছর বয়স থেকে অভিনয় করি), মানুষ হিসেবে। প্রেমিক হিসেবেও কি? নাহ! নিজের ক্লাস ফাইভের মনটাকে নিজেই বকেছিলাম, ‘‘বেশি পাকামি না করে ঐকিক অঙ্কে মন দাও বাবিন’’! ম্যাটিনি শো শেষের সন্ধের ছায়া দীর্ঘ হয়ে রাজুদার সাইকেলটাকে বিষণ্ণ করে তুলেছিল শুধু শুধু।
আমি তখন অষ্টম শ্রেণি, সাল ১৯৯৮। আমার জন্মদিনে বাবা জিজ্ঞেস করল, ‘‘কী নেবে?’’ জন্মদিন একটা আশ্চর্য দিন। ও দিন কেউ বকে না। অনেকটা সেই বিশ্বাসে ভর করেই বলে ফেললাম, ‘‘কুছ কুছ’ দেখতে নিয়ে যাবে বাবা?’’ বাবা মুহূর্তে গম্ভীর হয়ে গেলেন। কিন্তু পরে আবার রাজিও হয়ে গেলেন! যদিও এর পিছনে আমার সূক্ষ্ম রাজনীতি ছিল। স্থানীয় কেবল টিভিতে ‘দিল সে’, ‘দিল তো পাগল হ্যায়’ দেখিয়ে দলে টানতে পেরেছিলাম। এই বার মধুবন প্রেক্ষাগৃহে যাওয়া হল। আমার জন্মদিন ১৬ অক্টোবর। ছবি সে দিনই মুক্তি পেয়েছে। বাবা নাটকের দলের কাকুকে পাঠিয়ে টিকিট তুলিয়ে রেখেছিল। শাহরুখ ব্রিজ দিয়ে দৌড় শুরু করল। শুরু হল আমারও স্বপ্নের দৌড়।
মরি বাঁচি, অভিনেতাই হব। আর হ্যাঁ, এই বার নিজের প্রেমিক সত্তাকে না বকে বরং প্রশ্রয় দিলাম। তত দিনে পাড়ার এক জনকে মন দিয়েছি। বাবার ছেঁড়া রেনকোট পরে মনে মনে ‘ম্যায় কোয়ি অ্যায়সা গীত গাউ’ প্র্যাকটিসও করা হয়ে গিয়েছে। শুধু সুইৎজারল্যান্ডকে কাটছাঁট করে গলফ গ্রিন করতে হয়েছে। মনে আছে, রাতের শো ভাঙার পরে আমি-দাদা-মা-বাবা হেঁটে ফিরেছিলাম মধুবন থেকে বিজয়গড়ের বাড়িতে। আমার নাট্য শিক্ষক আমার বাবা। মেনে নিয়েছিলেন, ছেলেটা ভাল অভিনয় করে। এটা যেন আমার ব্যক্তিগত জয়! সে দিন শাহরুখ আমায় জিতিয়ে দিলেন। ‘স্বদেশ’ আর ‘চক দে’ নিয়ে অন্য কোনও জন্মদিনে লিখব। ‘দিল সে’ বা ‘কভি হাঁ কাভি না’ নিয়েও।
এর পর শাহরুখের সব ছবি আমি ওপনিং ডে-তে দেখেছি। ‘কভি খুশি কভি গম’-এ শাহরুখ হেলিকপ্টার থেকে নামল। আমি মেনকা হলের সিট থেকে পড়ে গেলাম। ‘মহব্বতেঁ’-তে রাজ আরিয়ান যখন প্রেম শেখাচ্ছে, এমন মন দিয়ে শিখছি, যেন ক্লাসে ক্যালকুলাস শেখাচ্ছে! ‘দেবদাস’ না ‘কাল হো না হো’, কোনটা দেখে বেশি কেঁদেছি? বলা খুব কঠিন। কিন্তু দুটোতেই চোখ লাল করে বেরিয়েছিলাম। দিন গিয়েছে। আমি নিজে অভিনেতা হয়েছি। শাহরুখকে নিয়ে আমার উন্মাদনা বেড়েছে বই কমেনি। আমার ব্যক্তিত্বের উপরেও যে শাহরুখের অমোঘ প্রভাব, তা আমি অস্বীকার করি কী করে? এক জন অভিনেতা ‘সেরা অভিনেতা’র সম্মান নিতে উঠে অমর্ত্য সেনকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে। কারণ, আগের দিন তিনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। এ তো আগে দেখিনি! আমার পড়াশোনার বিশেষ প্রশংসা হয় বিভিন্ন জায়গায়। বিশ্বাস করুন, এর পিছনেও এই একটা মানুষ। ওকে দেখে শিখেছি, আমি কী রকম দেখতে সেটা আমার হাতে নেই। কিন্তু রোজ শিখতে চাই কিনা সেটা আমার হাতে।
আমার উন্মাদনার দুটো উদাহরণ দিই। সদ্য ‘চিরদিনই তুমি যে আমার’ মুক্তি পেয়েছে। আমি আর প্রিয়াঙ্কা কোচবিহারে শো করতে গিয়েছি। সে দিন রব নে বনা দি জোড়ি মুক্তি পেয়েছে। ওপেনিং ডে-তে দেখব না? কাউকে না বলে আমি আর প্রিয়াঙ্কা সেখানকার ঘুপচি হলে অন্ধকারে ঢুকলাম। বিপদ হল ইন্টারভ্যালে। শেষ পর্যন্ত পুলিশ দিয়ে বের করতে হয়েছিল আমাদের। পুরুলিয়ায় শ্যুট চলছে ‘বর বৌ খেলা’ ছবির। ‘মাই নেম ইজ খান’ মুক্তি পেল। সারা দিন শ্যুট করে ছয় ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে এসে ছবি দেখে আবার শ্যুটিং এলাকায় ফিরেছিলাম!
এখন প্রশ্ন করবেন, শাহরুখের থেকে বড় অভিনেতা তুমি কি আর দেখনি? আমি বলব বিস্তর দেখেছি। নিজে এক জন অভিনেতা হয়ে দেখব না! কিন্তু আমি যখন প্রথম প্রেম বুঝি তখন আমার হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকা বন্ধুটার নাম শাহরুখ খান! তাই এতগুলো ফ্লপের পরেও আমি জানি, ২৫ জানুয়ারি আমি শুটিং করব না। পাঠান আসছে। আর আমি ওপেনিং ডে ছাড়া ‘বস’-এর ছবি দেখি না।