তপন মল্লিকঃ দৈনিক ইংলিশম্যান তাঁকে ‘চিনের প্রাচীর’ আখ্যায়িত করেছিল। তিনিই ছিলেন প্রথম ফুটবল খেলোয়াড় যিনি পদ্মশ্রী পান। এ দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি তাঁর খেলা দেখতে মাঠে আসতেন। ফুটবল ছাড়াও তিনি হকি, ক্রিকেট ও টেনিস খেলতেন। চারটি খেলাতেই তিনি মোহনবাগানের অধিনায়ক ছিলেন। পূর্ববঙ্গের ফরিদপুর জেলার মানুষ হলেও তিনি রাইট ব্যাক পজিশনে মোহনবাগান ক্লাবে খেলতেন। ব্রিটিশ আমলে তিনি ময়দান কাঁপিয়ে রেখেছিলেন খালি পায়ে ফুটবল খেলে। বলাই হত, যে ফরোয়ার্ডই হোক না কেন; তার পায়ে বল জমা পড়ে যাবে। তাকে কাটিয়ে গোল করা অসম্ভব ব্যাপার। ফুটবলপ্রেমীরা তাঁকে চেনে মোহনবাগান রত্ন হিসেবে। কিন্তু আমৃত্যু মোহনবাগানে খেলা সেই গোষ্ঠ পাল সদ্য ভূমিষ্ঠ হওয়া ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের হয়ে ফুটবল ম্যাচ খেলেছিলেন। প্রথম বছরই ইস্টবেঙ্গল ক্লাব যে ট্রফি জিতেছিল তাতে গোষ্ঠ পালেরও বিরাট অবদান ছিল। এই ঐতিহাসিক তথ্য যদি ভুল মনে হয়, ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট খুলে দেখে নিন। তথ্য অনুযায়ী মোহনবাগান থেকে সেবার ইস্টবেঙ্গল ক্লাব গোষ্ঠ পালকে লোনে নিয়েছিল।
আরও পড়ুনঃমরার আগে ধোনির বিশ্বকাপ জয়ের ছয়টা দেখতে চান সুনীল গাভাস্কার, উত্তরে কি বললেন ক্যাপ্টেন কুল
মোহনবাগান ক্লাব পূর্ববঙ্গ থেকে ফুটবলার নিয়ে এসে বুক ফুলিয়ে বড়াই করে- এমনটাই ভাবতেন সুরেশ চৌধুরী বা তড়িৎ ভূষণ রায়দের মতো মানুষরা। তাঁরা ঠিক করলেন, যে এটা বেশি দিন চলতে দেওয়া যাবে না। তাই বাঙাল ফুটবলারদের জন্য জন্ম দেওয়া হল ইষ্টবেঙ্গল ক্লাব। বাঙালদের ইষ্টবেঙ্গল ক্লাবের ন’বছর আগে জন্ম নেওয়া কলকাতার অভিজাত ঘটিদের ক্লাব মোহনবাগান ১৯১১ সালে ইংরেজদের ইস্ট ইয়র্কশায়ারকে হারিয়ে আইএফএ শিল্ড জিতেছিল। সেটা কেবলমাত্র ইতিহাস নয়, গর্বের এবং ঐতিহ্যেরও বটে। কিন্তু সেই ঐতিহাসিক জয়ের নেপথ্যে যে আটজন পূর্ববঙ্গীয় ফুটবলার ছিল সে কথা কখনো মোহনবাগান কিংবা ঘটিরা বুক বাজিয়ে বলে না। হয়ত তাই কলকাতায় বসেই মোহনবাগানকে শিক্ষা দেওয়ার ইচ্ছাটা মাথা চাঁড়া দিয়ে উঠেছিল সুরেশ চৌধুরী বা তড়িৎ ভূষণ রায়দের কাছে। তাই ঢাকা শহরে নয় খোদ কলকাতায় জন্ম দিলেন ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের।
আরও পড়ুনঃকার পরামর্শে ধোনিকে অধিনায়ক করেছিল বিসিসিআই, সামনে এল সেই তথ্য
১৯২০ সালের ১ আগস্ট ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের জন্ম। কিন্তু ফুটবল প্রতিযোগিতা ছাড়া ক্লাবের নাম মানুষের কাছে পৌঁছবে কিভাবে। এদিকে কলকাতা ফুটবল মরসুম তখন পুরোদস্তুর চলছে। ময়দানে চলছে লিগের খেলা। কিন্তু মাঝপথে তাতে অংশগ্রহণ করা অসম্ভব। তাহলে কি করা যায়। একটা সদ্য জন্ম নেওয়া ক্লাব কি ম্যাচ না খেলে বসে থাকবে। সুরেশ চৌধুরী বা তড়িৎ ভূষণ রায় যে ধরণের মানুষ তাঁরা কিছুতেই সেটা হতে দেবেন না। আদা জল খেয়ে নেমে পড়লেন। খোঁজ করতে করতে খবর পেলেন উত্তর কলকাতার শ্যাম পার্কে চলছে হারকিউলিশ কাপের টুর্নামেন্ট। সেই টুর্নামেন্টে ইস্টবেঙ্গল ক্লাব নাম দিল।ভীষণ জেদ নিয়ে ইস্টবেঙ্গল ক্লাব গড়েছেন সুরেশ চৌধুরী, তড়িৎ ভূষণ রায়রা। যাতে বাঙালরা আত্নসম্মান নিয়ে নিজেদের ক্লাবে খেলতে পারে। পূর্ববঙ্গ থেকে নামী দামী খেলোয়ারদের এক জায়গায় জড়ো করেছেন। এই টুর্নামেন্টে একটা সমস্যা দেখা ছিল। ছ’জন ফুটবলারের টিম দিয়ে ম্যাচ। তাই ইস্টবেঙ্গল দুটি টিম করে নাম দিয়েছে- ইস্টবেঙ্গল ‘এ’ ও ‘বি’, যাতে সব খেলোয়ার মাঠে নামতে পারে।
আরও পড়ুনঃ'অবসরের পর সারা রাত ভারতীয় দলের জার্সি পরে বসেছিলেন ধোনি, চোখে ছিল জল'
শ্যাম পার্কে আয়োজিত সেই প্রতিযোগিতায় লাল-হলুদ জার্সি গায়ে খেলেন গোষ্ঠ পাল। ইস্টবেঙ্গলের দুটি টিম সেমিফাইনালে উঠলে ‘বি’ টিম সরে যায়। ফাইনালে ইস্টবেঙ্গল ‘এ’ টিম বিদ্যাসাগর ক্লাবকে হারিয়ে হারকিউলিশ কাপ জেতে। সেই টিমে ছিলেন গোষ্ঠ পাল। ১৯২০ সালের ১৩ আগস্ট অমৃতবাজার পত্রিকায় খবর হল ‘হারকিউলিশ কাপে ইস্টবেঙ্গলের জয়লাভ’, সব খেলোয়াড়দের নামও ছাপা হল, কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে বাদ পড়ে গেল গোষ্ঠ পালের নাম। পরবর্তী সময়ে সেই ম্যাচকে সরকারিভাবে স্বীকৃতি দেয়নি ইস্টবেঙ্গল। তাকে প্রদর্শনী ম্যাচ হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। তবে গোষ্ঠপাল যে ইস্টবেঙ্গলের হয়ে একটি ম্যাচ খেলেছিলেন সেই তথ্যে কোনও ভুল নেই।