যে বাড়িতে ঠাকুর তাঁর মর্তলীলা সংবরণ করেছিলেন কাশীপুরের সেই ভাড়া বাড়িতে স্বামী বিবেকানন্দ একদিন বলেছিলেন, ‘আমাদের প্রথম মঠ’ । রামকৃষ্ণ ভাবান্দোলন সেখানে ঠাকুরকে কেন্দ্র করেই দানা বেঁধেছিল। পরে বরাহনগর, আলমবাজার হয়ে তা বেলুড়ে পৌঁছায়। এই ছিল বেলুড় মঠ প্রতিষ্ঠার সূচনালগ্নের গল্প।
বরানগরের পোড়ো বাড়ি থেকে নিদারুণ অর্থকষ্ট, হাজারো কটাক্ষ উপেক্ষাকে অবজ্ঞা করে স্বামী বিবেকানন্দের নেতৃত্বে কিভাবে গড়ে উঠল বটবৃক্ষরূপী বেলুড় মঠ সেই কাহিনি বড়ই আশ্চর্যের। লিখছেন অনিরুদ্ধ সরকার--- শ্রীরামকৃষ্ণের প্রয়াণের পর নরেন্দ্রনাথ সন্ন্যাসীভ্রাতাদের নিয়ে বরানগরে একটি পোড়ো বাড়িতে ওঠেন এবং গৃহী শিষ্যদের অর্থসাহায্যে প্রথম মঠ প্রতিষ্ঠা করেন। শুরু হয় ‘রামকৃষ্ণ মিশনে’র যাত্রা। পোড়ো বাড়ি, অসম্ভব কষ্ট, একখানা কৌপিন, মেঝেতে চাটাই পেতে শোওয়া এবং হাত কিম্বা একটুকরো ইটকে বালিশের মত করে ব্যবহার করে কষ্টের জীবন। এই ছিল রামকৃষ্ণ ভাবান্দোলন। আর বরানগর ছিল তার আঁতুড়ঘর। রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনরূপী যে বটবৃক্ষ আগামীদিনে সহস্রাধিক শাখা প্রশাখা বিস্তার করবে এই ছিল তার সুচনা।
শ্রীরামকৃষ্ণ নির্দেশিত পথে রামকৃষ্ণ সঙ্ঘ গঠন করেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ ১৮৮৬ সালে অর্থাৎ যে-বছর ঠাকুর দেহসংবরণ করলেন সে-বছর। বরাহনগরের এক জীর্ণ বাড়িতে প্রথম আস্তানা গাড়লেন সন্ন্যাসীরা। যা ‘বরাহনগর মঠ’ নামে রামকৃষ্ণ-সাম্রাজ্যে সুপরিচিত। এই রামকৃষ্ণ সঙ্ঘকে রামকৃষ্ণ মঠের রূপ দেন স্বামী বিবেকানন্দ, আর রামকৃষ্ণ সঙ্ঘকে দীর্ঘদিন লালিত-পালিত করেন সঙ্ঘজননী সারদা দেবী।
গুরুভ্রাতাদের সঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দ
বাগবাজারে বলরাম মন্দিরে ১৮৯৭ সালের ১ মে জয়যাত্রা শুরু হয় ‘রামকৃষ্ণ মিশনে’র। আর বরানগর মঠ রূপান্তরিত হয় ‘রামকৃষ্ণ মঠ’-এ। এই বরানগরে থাকতেই বিবেকানন্দের মন ঠিক করে নিয়েছিল স্থায়ী মঠ ঠিক কোথায় হবে। বরানগর খেয়াঘাটে দাঁড়িয়ে তিনি একদিন গুরুভাইদের বলেছিলেন, “আমার কেন যেন মনে হচ্ছে গঙ্গার ওপারে কাছেপিঠেই আমাদের স্থায়ী মঠ হতে চলেছে।”
আরও পড়ুন- বদলে গেল বেলুড় মঠ দর্শনের সময়সূচি, জেনে নিন কখন ঢোকা যাবে মঠে
যে বাড়িতে ঠাকুর তাঁর মর্তলীলা সংবরণ করেছিলেন কাশীপুরের সেই ভাড়া বাড়িতে স্বামী বিবেকানন্দ একদিন বলেছিলেন, ‘আমাদের প্রথম মঠ’ । রামকৃষ্ণ ভাবান্দোলন সেখানে ঠাকুরকে কেন্দ্র করেই দানা বেঁধেছিল। পরে বরাহনগর, আলমবাজার হয়ে তা বেলুড়ে পৌঁছায়। এই ছিল বেলুড় মঠ প্রতিষ্ঠার সূচনালগ্নের গল্প।
বেলুড় মঠ, ১৯৪০ সালে তোলা ছবি
বিশ্বনাথ উপাধ্যায় ছিলেন নেপালের রাজার ভারতে নিযুক্ত উকিল। রাজপ্রতিনিধিরূপে তিনি কলকাতায় বাস করতেন। বেলুড়ে নেপালরাজের একটি কাঠগোলা ছিল। প্রথম দিকে বিশ্বনাথ উপাধ্যায় ওই কাঠগোলাতে কর্মচারী হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। একদিন তিনি শ্রীরামকৃষ্ণের সান্নিধ্য লাভ করেন আর ঠাকুরের পরম ভক্ত হয়ে ওঠেন। ঠাকুর তাঁকে আদর করে ‘কাপ্তেন’ বলে ডাকতেন। কাপ্তেনের অনুরোধে ঠাকুর একদিন বেলুড়ের ওই কাঠগোলা ঘুরতে গেছিলেন।
এদিকে বেলুড়ে জমি কেনা হল। কিন্তু তা অসমতল। অতএব সেখানে মঠ নির্মাণ করতে একটু সময় লাগবে, তার বিশেষ তদারকি প্রয়োজন তা বুঝলেন তরুণ সন্ন্যাসীরা। সেকারণে বেলুড়ের কাছাকাছি নীলাম্বর মুখোপাধ্যায়ের বাগানবাড়ি ভাড়া নিলেন সন্ন্যাসীরা। মঠ অস্থায়ীভাবে স্থানান্তরিত হল সেখানেই। বারাণসীর সমতুল গঙ্গার পশ্চিম তীরের সেই বাড়িতে শ্রীমা বসবাস করার সময় ছোটো ছাদে ‘পঞ্চতপা’ ব্রত করেছিলেন। সদ্য-কেনা ‘কাপ্তেনে’র কাঠগোলার মঠভূমিতে ঠাকুরকে স্বামীজি প্রতিষ্ঠা করলেন।
বরানগরের সেই পোড়াবাড়ি যেখানে এখন বরানগর মঠ
১৮৯৮ সালের ৯ ডিসেম্বর স্বামীজি নতুন মঠের জমিতে শ্রীরামকৃষ্ণের চিতাভস্ম ‘আত্মারাম’কে প্রতিষ্ঠা করে পুজো করে পায়েস নিবেদন করেন। বেলুড় মঠের জমি কেনার পর স্বামীজী আর মাত্র সওয়া চার বছর জীবিত ছিলেন। এই সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যেই তিনি মঠ প্রতিষ্ঠার মূল কাজগুলি দক্ষতার সঙ্গে করে গেছিলেন। আর মঠ চালানোর জন্য সহজ একটি কথা বলতেন- “শাকের টাকা শাকে, আর মাছের টাকা মাছে।” এই ছিল উনার ম্যানেজমেন্ট। যার টাকা যে খাতে তাকে সেই খাতে খরচ করো।
রামকৃষ্ণ মিশন কলকাতা কেন্দ্রের ভার বর্তেছিল স্বামী ব্রহ্মানন্দের ওপর। অন্যদিকে, ১৮৯৮ সালে বেলুড়ে নতুন মঠ নির্মাণের কাজ শুরু হলে তার দায়-দায়িত্বও পড়ে স্বামী ব্রহ্মানন্দের ওপর। আমেরিকা, ব্রিটেনসহ সমগ্র পাশ্চাত্যে স্বামীজির কী বিরাট প্রভাব ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় মঠ তৈরির সূচনা থেকেই। রামকৃষ্ণ মঠ প্রতিষ্ঠার সময় স্বামীজীর একাধিক বিদেশি ভক্ত-অনুরাগীরা কুণ্ঠাহীনভাবে স্বামীজির পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য দু’জন হলেন ইংরেজ শিষ্যা মিস মিলার এবং আমেরিকান শিষ্যা ওলি বুল। বেলুড় মঠের জমি কেনার সময় তাঁরা অকৃপণ হাতে অর্থ সাহায্য করেছিলেন।
গুরুভ্রাতাদের সঙ্গে বরানগরে স্বামীজি
আর্থিক দুর্দিনে মঠকে নিয়মিত অর্থ সাহায্য করতেন সুরেশ মিত্র ও বলরাম বসু। তাঁদের মৃত্যুর পরই অনটন বৃদ্ধি পায়। একসময় অভাব-অনটন এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছায় যে মঠের কাজ প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার মুখে পড়ে। স্বামীজী সহ ঠাকুরের সব শিষ্য এবং ভক্তরা চিন্তিত হয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতিতে শশী মহারাজ হার না মেনে বেরিয়ে পড়েন। এই শশী মহারাজ স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি মঠের জন্য অর্থের সংস্থান করতে সাময়িকভাবে স্থানীয় এক স্কুলে মাস্টারি করেন। বিদেশে বক্তৃতা করে টাকা সংগ্রহের চেষ্টা করতে থাকেন স্বামীজী। গুরুভাইদেরও কেউ কেউ তীর্থে তীর্থে বেরিয়ে পড়েন অর্থের যোগান দিতে।
আরও পড়ুন- Durga Puja : করোনা আতঙ্ক এই বছরের দুর্গাপুজোতেও দর্শনার্থীদের জন্য বন্ধ বেলুড় মঠের দ্বার
১৯০০ সালের অগাস্ট মাসে দলিল তৈরি করে মঠের যাবতীয় বিষয়-সম্পত্তি স্বামীজী গুরুভাইদের হাতে তুলে দিলেন। আর ১৯০১ সালের গোড়ার দিকে মঠ ও মিশনের দায়িত্ব স্বামী বিবেকানন্দ তুলে দিলেন স্বামী ব্রহ্মানন্দের হাতে। ঠাকুর প্রায়শই বলতেন, "রাখাল একটা সাম্রাজ্য চালাতে পারে।" বিবেকানন্দ এবং তাঁর গুরুভ্রাতারা রাখাল মহারাজের ওপর ঠাকুরের এই অগাধ আস্থার কথা ভোলেননি। তাই নির্দ্ধিধায় রাখাল মহারাজের হাতে 'বেলুড় মঠ রূপী সাম্রাজ্যের' দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্ত হন স্বামীজী ও অন্য গুরুভ্রাতারা।
মঠ কী আকার নেবে স্বামীজী তা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন অপর আরেক গুরুভ্রাতা স্বামী বিজ্ঞানানন্দকে, পূর্বাশ্রমে যিনি ছিলেন একজন দক্ষ সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। মন্দিরের প্রতীক তৈরি করেছিলেন স্বামীজী। তা তৈরি করার পর স্বামীজীর তত্ত্বাবধানে মন্দিরের নকশা তৈরি করেছিলেন বিজ্ঞানানন্দজী। বিভিন্ন ধর্মস্থানের আদলে গড়ে উঠছিল বেলুড় মঠ।
মন্দিরের ছত্রীগুলি কামারপুকুরে ঠাকুরের বাসগৃহের আদলে গড়ে ওঠে। গম্বুজে মুসলিম স্থাপত্যরীতির সঙ্গে ওড়িশা মন্দিরস্থাপত্যের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। নাটমন্দিরের বাঁকানো ছাদ ও বারান্দা বৌদ্ধ গুম্ফার কথা মনে করিয়ে দেয়। মন্দিরে প্রবেশপথের গোপুরমটি তৈরি করা হয় অজন্তা ও ইলোরা রীতির আদলে। বেলুড়ে মন্দিরটির উদ্বোধন হয় ১৯৩৮ এর ১৪ জানুয়ারি। পৌষ সংক্রান্তির দিন। মঠের তৎকালীন অধ্যক্ষ স্বামী বিজ্ঞানানন্দ নতুন মন্দিরে ঠাকুরকে স্থাপন করেন। মঠের পুরনো মন্দির থেকে বুকে করে আত্মারামকে নিয়ে এসে নবনির্মিত মন্দিরে ঠাকুরের মূর্তির সামনে রেখে প্রার্থনা করেন।
আরও পড়ুন- কীভাবে বেলুড়ে পালিত হবে দুর্গাপূজো, সূচি প্রকাশ করল বেলুড় মঠ
এই মঠকে নিয়েও সেযুগে কম চর্চা হয় নি। পরাধীন ভারতে ব্রিটিশ সরকার বেলুড় মঠকে যথেষ্ট সন্দেহের চোখে দেখত। ভাবত, মঠ ছিল সন্ত্রাসবাদীদের আখড়া। তাদের সম্পর্কে বিরাট এক বিরূপ রিপোর্টও তৈরি করেছিল পুলিশ।
মঠকে স্বামীজী বরাবর রাজনৈতিক নেতাদের সংস্পর্শ থেকে দূরে রাখতে চেয়েছিলেন। তাই অনেক নেতা চাইলেও তিনি মঠে তাঁদের সঙ্গে দেখা করেননি। এই নেতাদের মধ্যে গান্ধীজীও রয়েছেন।
বালি পুরসভা নানা কারণ দেখিয়ে বাড়িয়ে দিয়েছিল মঠের ট্যাক্স। কেউ কেউ বেলুড় মঠকে সেযুগে কটাক্ষ করে বলত, “নরেন'স প্লেসার হাউস"। যার মধ্যে কলকাতার এলিট বাঙালিরাও ছিলেন। তাঁদের কেউ কেউ বলতেন, "ওখানে এক তরুণ সন্ন্যাসী থাকেন। বিদেশিনীরা আসেন খানাপিনা হয়, মজা হয়।” এমনকি লোকমুখে বদলে গেছিল বিবেকানন্দের নাম অবধি। বিবেকানন্দ হয়ে গেছিলেন 'বিবি-কা-আনন্দ'।
হাজারো অপমান, অসম্মান, উপেক্ষাকে অতিক্রম করে স্বামীজীর স্বপ্নের বেলুড় মঠ আজও স্বমহিমায় উজ্জ্বল। যুগের নিয়মে হারিয়ে গেছেন বিরুদ্ধবাদীরা। স্বামীজী একসময় বুঝেছিলেন তিনি আর ধরাধামে বেশিদিন থাকবেন না তখন বলেছিলেন, “আমি চল্লিশ পের হব না।” হয়েও ছিল তাই। চল্লিশ পার হন নি। ঊনচল্লিশ বছর, পাঁচ মাস, চব্বিশ দিনে চলে গেছিলেন যুগনায়ক। কিন্তু তাঁর বেলুড় মঠ আজ সারাবিশ্বে নিজেদের কর্মকাণ্ডের জন্য সমাদৃত। স্বামীজীর কথা থেকে ধার নিয়ে বলা যায়, "আরেকজন বিবেকানন্দ থাকলে বুঝতে পারত বিবেকানন্দ কি করে গেল!"
ঋণ:
1| A Symphony in Architecture Ramakrishna Temple Belur Math- Swami Tattwajnanananda
2| The Ramakrishna Math and Mission, Hinduism: New Essays in the History of Religions- Cyrus R. Pangborn
3| যুগনায়ক বিবেকানন্দ- স্বামী গম্ভীরানন্দ(খণ্ড ২,৩)
4| পত্রাবলী,স্বামী বিবেকানন্দ- উদ্বোধন কার্যালয়
pic courtesy: Vedanta Society of St. Louis and Belur math archive