উঁকুন নিয়ে সমস্যায় ভোগেন সকলে। এটা একটা বড় সমস্যা যে কোনও দেশে। ভারতও এর বাইরে নয়। উঁকুন সাধারণত রক্ত চুষে খেয়ে বেঁচে থাকে। ফলে মাথায় উঁকুন থাকলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে মাথা চুলকানোর সমস্যা রয়েছে অতি একটা স্বাভাবিক বিষয়। উঁকুনের সমস্যার জন্য অনেকে আবার প্রকাশ্যে মেলামেশাতেও মানসিক হতাশায় ভোগেন।
ভারতবর্ষে উঁকুনের সমস্যায় ভোগার পরিসংখ্যানটা কেমন? এই তথ্যগুলির মধ্যে দিয়েই তা অনেকটা সামনে আসছে। একবার একটি রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছিল, ভারতে বসবাসকারী শিশুদের মধ্যে ৪ বছরের নিচেদের মাথায় ১৩.১ শতাংশ হারে উঁকুনের সমস্যা রয়েছে। আর এই পরিসংখ্যানটা প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে। আবার ভারতে বসবাসকারী ৪ থেকে ১৪ বছরের শিশুদের মাথায় উঁকুনের সংক্রমণের হার ৫৫ শতাংশ বলেও এই রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছিল। ২৫ থেকে ৩৯ বছরের মধ্যে বয়সীদের মাথায় উঁকুনের সংক্রমণের হার ১৭.৩ শতাংশ। উঁকুনের সমস্যা যে শুধু ভারতেই রয়েছে এমনটা নয়। বিশ্বজুড়েই এই সমস্যা রয়েছে। আমেরিকায় আবার উঁকুন চিকিৎসায় নির্দিষ্ট চিকিৎসা গাইডলাইনও রয়েছে। অধিকাংশ মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটিতে এই নিয়ে নিরন্তর গবেষণাও চলছে। উঁকুনের সমস্যা নিয়ে প্রায়শই বাড়িতে অভিভাবকরা চিন্তায় পড়ে যান। অনেকে বাজার চলতি অনেককিছু ব্যবহারও করে ফেলেন। অধিকাংশ সময়েই দেখা যায় যে দিন কয়েক পর থেকে উঁকুন মাথার মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এখানে এমনকিছু পদ্ধতি ও উপায় বলা হচ্ছে যা হয়তো উঁকুন থেকে একজনকে চিরতরে মুক্তি দিতে পারে।
উঁকুনের চিকিৎসা শুরু করার আগে যে বিষয়গুলি মাথায় রাখবেন
বাড়িতে এক বা একাধিক জনের মাথায় উঁকুন থাকলে একসঙ্গে চিকিৎসা শুরু করুন। যাদের মাথায় উঁকুন রয়েছে তাদের মাথার চিরুণী, চুলের ব্রাস আলাদা করে রাখুন। যাতে যাদের মাথায় উঁকুন নেই তাদের চিরুণী বা ব্রাসের সংস্পর্শে ওগুলো আসতে পারে। এমনকী, যাদের মাথায় উঁকুনের চিকিৎসা শুরু করছেন তাদের একে অপরের চিরুণী ও চুলের ব্রাস যেন কোনওভাবেই পাশাপাশি না থাকে। যাদের মাথায় উঁকুন রয়েছে তাদের বিছানার চাদর, বালিশের ওয়ার সব বদলে ফেলুন। তুলে নেওয়া এই বিছানার চাদর ও বালিশের ওয়ার গরম জলে ধুঁয়ে ফেলুন অথবা প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরে ৭ দিনের জন্য অন্যত্র ফেলে রাখুন। এমনকী বিগত ৭ দিন ধরে যে জামা-কাপড় এই ব্যক্তি বা শিশুরা ব্যবহার করেছে তাও গরম জলে ১০ মিনিট ভিজিয়ে রেখে খারযুক্ত সার্ফের জলে ধুয়ে কেচে নিন অথবা প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরে ৭ দিনের জন্য পরিত্যক্ত স্থানে ফেলে রাখুন।
গরম জলে স্টেরেলাইজেশন
উঁকুন যাদের মাথায় রয়েছে প্রতিদিন পারলে চিরুণী ও চুলের ব্রাস-কে গরম জলে ভিজিয়ে রাখুন ১০ মিনিটের জন্য। এতে লেগে থাকে উঁকুন বা তার ডিম জলের তাপে মরে যাবে। আর গরম জল থেকে এগুলোকে তুলে নিয়ে ভালো করে ধুয়ে নেবেন। আর এই কাজটা করতে হবে, রোজ মাথায় চিরুণী ও ব্রাসের ব্যবহারের পর।
যাদের মাথায় উঁকুন রয়েছে তাদের একত্রে শোয়ান
একটা জিনিস মাথায় রাখবেন, যাদের মাথায় উঁকুন রয়েছে তাদের পাশে যদি মাথায় উঁকুনহীন কেউ শুয়ে থাকেন তাহলে তাহলে এই সমস্যা তার ক্ষেত্রেও তৈরি হতে পারে। তাই উঁকুনের চিকিৎসায় একটা সবচেয়ে বড় বিষয় যে উঁকুনের সমস্যায় ভোগা মানুষের পাশে উঁকুনহীনদের না শোয়া। অনেকসময় শিশুদের ক্ষেত্রে বাড়ির বড়দের তাদের পাশে শুতে হয়। এক্ষেত্রে যদি বাড়ির বড় ব্যক্তিটির মাথায় উঁকুনের সমস্যা নাও থাকে তাহলেও তাকে বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করে চিকিৎসার আওতায় থাকতে হবে।
উঁকুন দূর করতে ওষুধের ব্যবহার
এই ক্ষেত্রে ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই ৯০ শতাংশ উঁকুনকে মাথা থেকে সরানো সম্ভব। কিন্তু, এর কিছু পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াও রয়েছে। আর এই পদ্ধতি ৬ মাস বা তার বেশি বয়সীদের জন্য। এই ওষুধ কেনার খরচ অবশ্য এতে তেমন কিছু নয়। বাজার থেকে আইভার শাইন লোশন বা শ্যাম্পু কিনে নিয়ে আসতে হবে। ১০০টাকার মধ্যেই এই ওষুধ পাওয়া যায়। তবে, সম্প্রতি ওষুধের দাম বৃদ্ধি পাওয়ার পর এর দামেও কিছু পরিবর্তন এসেছে। সেটা তেমন কিছু নয়।
এই ওষুধ মাথায় লাগানোর সময় চুল শুকনো থাকতে হবে। প্রথমে মাথার তালুতে ভালো করে ঘষে ঘষে আইভার শাইন লোশন বা শ্যাম্পুকে লাগাতে হবে। এরপর প্রতিটি চুলকে ধরে ধরে গোড়া থেকে আগা পর্যন্ত আইভার শাইন লোশন বা শ্যাম্পুতে ভালো করে মাখিয়ে নিতে হবে। এই প্রক্রিয়া অন্তত ৩০ মিনিট লাগবে। আইভার শাইন লোশন বা শ্যাম্পুতে চুল মাখানোর পর অন্তত ১০ মিনিট তা রাখতে হবে। এরপর জল দিয়ে ভালো মাথা ধুয়ে নিন। একটা জিনিস মাথায় রাখবেন আইভার শাইন লোশন বা শ্যাম্পু ব্যবহারের ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত মাথায় কোনওভাবেই সাবানজাতীয় কিছু ব্যবহার করা যাবে না। যে সব মহিলা গর্ভধারণ করেছেন অথবা শিশুকে ব্রেস্ট ফিডিং করান তারা এই আইভার শাইন লোশন বা শ্যাম্পু ব্যবহার করার আগে চিকিৎসকের পরামর্শ অবশ্যই নেবেন। এই পদ্ধতি সাত দিনে অন্তত ২ বার অভ্যাস করুন। চুল ধোয়া হলে ভালো করে চুল টেনে টেনে আঁছড়াতে হবে। ছেলের ক্ষেত্রে চুল আঁচড়ানোর সময় মাথার উপরে তা তুলে দেবেন না। মহিলারা যেভাবে মাথায় চিরুণী দিয়ে চুলের গোড়া থেকে আগা পর্যন্ত আঁচড়ায় সেভাবেই চুল আঁচড়াবেন। এই পদ্ধতিতে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া এই যে মাথায় খুসকি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অনেকের ক্ষেত্রে অ্যালার্জির সমস্যা হতে পারে। আবার কারও কারও ক্ষিদে কমে যাওয়ারও সমস্যা লক্ষ করা গিয়েছে।
ঘরোয়া পদ্ধতিতে উঁকুন দূর করার লড়াই
এটা একটা প্রাকৃতিক পদ্ধতি। এতে উঁকুন দূর করতে অন্তত ২ সপ্তাহ সময় লাগবে। এতে চুল ভেজানো এবং চিরুণী করা অতি আবশ্যিক একটা বিষয়। এই পদ্ধতিতে একটা ফর্মূলা রয়েছে। আর সেটা হল প্রতি তিন দিন অন্তর চুল ভালো করে ভেজাতে হবে এবং চুলের গোড়া থেকে আগা পর্যন্ত টেনে টেনে আঁছড়াতে হবে। এই প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে এই অভ্যাস অনুসরণ করতে হবে চিকিৎসা শুরুর প্রথম, পঞ্চম, নবম এবং তেরো তম দিনে। খেয়াল রাখতে হবে প্রথম অভ্যাসের থেকে দ্বিতীয় অভ্যাসের মধ্যে ৩ দিনের অন্তর থাকতে হবে। চুলকে অতি যত্ন সহকারে এবং ভালো করে ভেজাতে হবে। এই প্রসঙ্গে জেনে রাখা ভালো প্রথম যেদিন এই অভ্যাস অনুসরণ করছেন সেদিন চুল ভেজানো এবং তারপর টেনে মাথায় চুলে চিরুণী করায় বড় উঁকুনগুলো পড়ে যাবে। কিন্তু, এই বড় উঁকুনগুলো মাথার চুলে যে ডিম পেড়ে রেখেছে সেগুলো কীভাবে নির্মূল করবেন। উঁকুনের ডিম ফুটতে ৩ দিন সময় লাগে। তাই তিন দিন পরে ফের যখন চুল ভিজিয়ে চিরুণী করবেন তখন ডিম ফুটে বের হওয়া উঁকুনগুলো পড়ে যাবে। মোটামুটি দেখা গিয়েছে যারা এই নিয়মকে চারবার নির্দিষ্টভাবে অনুসরণ করতে পেরেছেন তাদের ক্ষেত্রে সাফল্যের হার ৯৫ শতাংশ। ১০০ থেকে ৫ শতাংশ কম এই কারণে যে উঁকুন শুধু তাড়ালে তো হবে না, যাদের মাথায় উঁকুন রয়েছে অতি কাছ থেকে তাদের সংস্পর্শে এলে ফের তা মাথায় এসে বাধা বাঁধবে। এই প্রাকৃতিক উপায়ে কোনও ধরনের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনা নেই। মাথায় রাখতে হবে যে চুল ভেজাতে আপনি তেল বা জল যে কোনও একটি ব্যবহার করতে পারেন। আর যে পোশাক পরে চুল আঁচড়াছেন তা ছেড়ে ফেলতে হবে। কারণ, চুল আঁচড়ানোর সময় তাতেও উঁকুন পড়ে থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। আর মাথা আঁচড়ানো হলে চিরুণীকে গরম জলে ১০ মিনিট চুবিয়ে রাখুন। বিছানার উপর বসে এই অভ্যাস করবেন না। সেক্ষেত্রে বিছানায় উঁকুন ছড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকবে। পারলে মেঝের উপরে বসে চুল আঁচড়ান অথবা বাথরুমে এই অভ্যাস করুন- ঝাঁটা দিয়ে ঝাড় দিয়ে অথবা বাথরুমে জল ফেলেদিলে উঁকুনগুলোকে সহজে দূর করা যাবে। এক্ষেত্রে অন্যত্রব ছড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাটা অনেক কমে যাবে।
বাজার চলতি কিছু পদ্ধতি যা কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই
অনেকেই বলে থাকেন যে তেল গরম করে মাথায় লাগালে উঁকুন মারা সম্ভব। আবার কেউ বলেন টি-ওয়েল বা ভিনিগার লাগালেও উঁকুন মরে যায়। এখন পর্যন্ত এমন কোনও বৈজ্ঞানিক তথ্য পাওয়া যায়নি- যার সুবাদে এমন দাবি করা যায়। অনেকে আবার পেঁয়াজের রস অথবা রঁসুন বাটাও উঁকুন ভরা মাথায়া লাগানো কথা বলেন। কিন্তু এতেও কোনও প্রামাণ্য নেই যে উঁকুনের সমস্যা নির্মূল হওয়ার।
ফেসবুকের জনপ্রিয় হেলথ ভিডিও কনটেন্ট মেকার বাংলাদেশের চিকিৎসক ডক্টর তাসনিম জারা দাবি জানিয়েছেন, ২০১৫ সালে ইরাকের কিরকুক প্রদেশে ৫টি স্কুলে যাদের মাথায় উঁকুন রয়েছে তাদের চুলে রসুন বাটা এবং আপেল ভিনিগার প্রয়োগ করা হয়েছিল। কিন্তু, গবেষণায় নাকি দেখা যায় ৪৮ ঘণ্টা পরেও উঁকুন মরেনি। এই প্রসঙ্গে ডক্টর তাসনিম আরও একটি গবেষণার উল্লেখ করেছেন যা হয়েছিল ২০০৭ সালে অস্ট্রেলিয়াতে। সেখানে চুলের উপরে নারকেল তেল এবং নিমতেল মাখিয়ে উঁকুন ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু দেখা গিয়েছে চুলে তেল থাকার সত্ত্বেও উঁকুন দিব্যি মাথা থেকে রক্ত চুষে খেয়ে নিচ্ছে। এমনকী ২০১৫ সালেও ইংল্যান্ডে এই নিয়ে বিস্তারিত পর্যবেক্ষণ হয়। বিভিন্ন গবেষণাপত্র ঘেঁটে সেখানেও সিদ্ধান্ত হয় যে নারকেল তেল বা টিওয়েলে যে উঁকুন মরে যায় এমন কোনও অকাঠ্য প্রমাণ নেই। ২০২১ সালে ব্রিটেনের সরকারি সংস্থা নাইসও সিদ্ধান্তে পৌঁছয় যে ভেষজ উপায়ে যে উঁকুন নিমূলের যে দাবি করা হয় তার কোনও প্রমাণ সেভাবে নেই।
উঁকুন কীভাবে আসে
একটা জিনিস মাথায় রাখতে হবে যে উঁকুনের সঙ্গে অস্বাস্থ্যবিধি বা নোংরা থাকার কোনও সংযোগ নেই। উঁকুন সবসময়ই আসে অন্যের মাথা থেকে। কেউ নোংরা হয়ে যাকে বলে বা চুলের পরিচর্যা নেয় না বলে উঁকুন হয়- এই ধারণা ঠিক নয়। তবে, নিজেকে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করে রাখলে এবং চুলের স্বাস্থ্যকে বজায় রাখলে উঁকুনের সংক্রমণ চট করে একজনকে আক্রমণ করতে পারে না। তাই নিজেকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখলে ফায়দা যেমন আপনার তেমনি উঁকুনের সমস্যায় ভোগাদের থেকে একটি দূরত্ব মানুন। তাহলে সমস্যাটা অনেকটাই কমে যাবে।
আরও দেখুন, যৌনতা নিয়ে কথা বলতেই লজ্জায় মুখ ঢাকেন, জানুন কীভাবে হতে হবে 'সেক্স পজিটিভ'
আরও দেখুন, বিয়ের পরের সেই প্রথম স্পর্শ পেতে চান, রইল যৌন মিলনের সাতকাহন
আরও পড়ুন, প্রথম যৌন মিলন কবে করা উচিত, কী বলছেন তরুণ-তরুণীরা
আরও পড়ুন, যৌন রোগ মানেই এইডস নয়, না লুকিয়ে জানুন এই উপসর্গ গুলি আছে কি