তাঁরা জমিদারবাড়ির নারীদের সেবা করা সহ বিভিন্ন কাজ দিয়ে জমিদারদের সেবা করতে বাধ্য থাকতেন এবং প্রায়শই বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হতেন।
দক্ষিণ অসমের বরাক উপত্যকার নানকার কিয়ারান সম্প্রদায় অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে সবচেয়ে প্রান্তিক মুসলিম সম্প্রদায়গুলির মধ্যে একটি। এই সম্প্রদায়ের মানুষ কৃষকদের বংশধর। সেইসময়ে সিলেট-কাছার অঞ্চলে (বাংলাদেশের সিলেট এবং অসমের কাছাড়) জমিদার অভিজাত ও শক্তিশালী ভূস্বামীরা একটি নিম্ন বর্ণের মানুষের ওপর প্রচণ্ড অত্যাচার চালাতেন। নিম্ন বর্ণের দাস এবং আদিবাসীরা বাঁচার জন্য তখন ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন।
কিরণ, যাঁরা জমিদারের দাস বা প্রজা ছিলেন, তাঁরা দুটি শ্রেণীভুক্ত ছিলেন। স্বাধীন কিরণ এবং নানকার কিরণ। ‘কিরণ’ শব্দটি সম্ভবত 'কিষাণ' (কৃষক) এর একটি বিকৃত রূপ ছিল। পূর্ববর্তীরা জমিদারের কাছে এঁরা কৃষিশ্রমিক বা ভাগচাষী হিসেবে এবং পরবর্তীকালে ক্রীতদাস বা দাস হিসেবে কাজ করতেন। ‘নানকার’ শব্দটি সম্ভবত ফার্সি শব্দ 'নান' থেকে এসেছে, যার অর্থ রুটি। অতএব, বেতনের পরিবর্তে শুধুমাত্র খাদ্যের ব্যবস্থা নিয়ে নিযুক্ত একজন চাকর ‘নানকার কিরণ’ নামে পরিচিত। মজুরি বা পারিশ্রমিকের পরিবর্তে তাঁদের নিজেদের বাড়ি এবং চাষের জন্য একটি জমি দেওয়া হয়েছিল। তাঁরা জমিদার বাড়ির নারীদের সেবা করা সহ বিভিন্ন কাজ দিয়ে জমিদারদের সেবা করতে বাধ্য থাকতেন এবং প্রায়শই বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হতেন।
পূর্ব বাংলার পূর্ববর্তী সিলেট অঞ্চলে ১৪ শতক থেকে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষরা ব্যাপকভাবে ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন। সিলেট এবং এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে প্রধানত অনার্য জেলে উপজাতি যেমন কাইবার্তা, পাতিনি, দাস, নমশূদ্র এবং অন্যান্য জাতির মানুষরা বসবাস করতেন, যারা মাছ ধরা ও চাষাবাদের পেশার সাথে যুক্ত থাকার কারণে ‘নিম্ন শ্রেণী’ বলে গণ্য হয়েছিলেন। ১৪ শতকে বিখ্যাত সুফি সাধক শেখ শাহ জালাল ইয়েমেনি ৩৬০ জন আউলিয়া (শিষ্য) নিয়ে এখানে এসেছিলেন। তাঁর আবির্ভাবের পর এই আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে একটি বড় আকারের ধর্মান্তর ঘটে। সামাজিক সাম্যের ইসলামী বার্তায় উদ্বুদ্ধ হয়ে কৃষক, শিকারি এবং জেলেরা ব্যাপকভাবে ইসলাম গ্রহণ করে।
উল্লেখ্য, ইসলামে ধর্মান্তরিত হওয়ার ফলে জাতপাতের বিভেদ কমে যায়নি। কারণ এটি তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন করেনি। তাদের শ্রেণী ও মর্যাদা একই থেকে গিয়েছিল। বিচ্ছিন্ন জাতি থেকে ধর্মান্তরিতরা তালুকদার, তপাদার বা চৌধুরী নামক মিরাসদারের অধীনে তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য কৃষিকাজ বেছে নিয়েছিল, যা ‘কিরণ’ নামে পরিচিত একটি শ্রেণী হিসাবে সংগঠিত হয়। বরাক উপত্যকা সিলেটের পার্শ্ববর্তী জেলাগুলি নিয়ে গঠিত ছিল। কাছাড়, হাইলাকান্দি এবং করিমগঞ্জ (তৎকালীন সিলেটের একটি অংশ) প্রাকৃতিক কারণে স্বল্প সংখ্যক মানুষের বাস ছিল। কিন্তু এখানে প্রচুর অনাবাদি উর্বর জমি ছিল। তাই বাংলার জেলা বিশেষ করে সিলেট থেকে ব্যাপকভাবে মানুষের আগমন ঘটে। বরাক উপত্যকার বাঙালি মুসলমানরা বেশিরভাগই ছিলেন প্রতিবেশী বাংলা জেলা থেকে বিক্ষিপ্তভাবে স্থানীয় ধর্মান্তরিত বাঙালি অভিবাসী।
কিরণ বা নানকার কিরণরাও ছিল বেশিরভাগ বাংলার জেলা থেকে অভিবাসী যাঁরা প্রচুর উর্বর জমির লোভে পড়ে এখানে এসেছিলেন। কৃষি ছিল তাঁদের প্রধান পেশা, তাঁরা বেশিরভাগই ধান চাষের কাজ করতেন। ভারতবর্ষে তুর্কি-আফগান শাসনকালে ‘নানকার কিরণ’-দের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ হয়ে গিয়েছিল, কারণ তাঁরা জমিদারদের দ্বারা এমনভাবে শোষিত হয়েছিলেন যে, তাঁদের অবস্থা দাসদের থেকে কিছু কম ছিল না। এই ব্যবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে, জমিদারদের শোষণকে ইউরোপীয় সামন্তবাদের সাথে তুলনা করা হয়।
আরও পড়ুন-
রাস্তার ধারে উলঙ্গ হয়ে বিক্ষত দেহে কাতরাচ্ছেন মানুষ, ‘জ়ম্বি ড্রাগ’-এর নেশায় ভয়ঙ্কর অবস্থা আমেরিকায়