
'আমি এইদেশের যুবকরদের প্রতি আহ্বান জানাই যে তারা এই দেবীর পায়ের কাথে বসে স্বাধীনতা ও অধ্যাবসায়ের পাঠ শিখুক।' বিখ্যাত ভারতীয় লেখক ব্রিজ নারায়ণ চকবস্ত ১৯১৮ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামী বা মুক্তিযোদ্ধা নিশাত উননিসা বেগমকে নিয়ে এই কথা লিখেছিলেন।
দেশের মানুষ তাঁর স্বামী মাওলানা হাসরত মোহানি সম্পর্কে অনেক কথাই জানত, যিনি 'ইনকিলাব জিন্দাবাদ' (বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক) এই স্লোগান তৈরি করেছিলেন। ইতিহাসবিদরা অন্যান্য অনেক নারীর মত নিশাতকে ঐতিহাসিক বর্ণানার প্রান্তে রেখেছেন। তিনি একজন নায়ক, হিসেবে নয় বরং একটি নাটকে একজন সাহয়ক অভিনেতা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, যেখানে তাঁর স্বামী নায়ক হিসেবেই জায়গা করে নিয়েছেন।
তাঁর স্বামী হাসরাত স্বীকার করে নিয়েছিলেন তিনি যদি নিশাতকে না বিয়ে করতেন তাহলে তিনি একজন অরাজনৈতিক সম্পাদক হিসেবেই থেকে যেতেন। মৌলানা আবুল কালাম আজাদক তাঁর সংকল্প ও ধৈর্যের পাহাড়ের সঙ্গে তুলনা করেছেন। মহাত্মা গান্ধীও অসহযোগ আন্দোলনে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা স্বীকার করে নিয়েছেন। নিশান একজন স্বাধীন মহিলা হিসেবেই নিজেকে তুলে ধরতে পেরেছেন। যার স্বামী তাঁর কাছে চিরজীবন ঋণী ছিলেন।
১৮৮৫ সালে লখনউতে জন্মগ্রহণ করেন নিশাত। প্রাথমিক শিক্ষা বাড়িতেই। তিনি উর্দু, আরবি, ফার্সি আর ইংরেজি জানতেন। ১৯০১ সালে হাসরাতকে বিয়ে করেন। তবে তার আগে থেকেই নিশাত সমাজকর্মী হিসেবে নিজের কাজ শুরু করেছিলেন। বাড়িতে বসেই তিনি পিছিয়ে পড়া মুসলিম মহিলাদের পড়াতেন। বিয়ের পরই রাজনৈতিক জীবনের আঙিনায় পা রাখেন। নিশাত আর হাসরাত ভারতের প্রথম মুসলমান যাঁরা বালগঙ্গাধর তিলকের চরমপন্থী আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁরা আলিগড়ে একটি স্বদেশী দোকানও খুলেছিলেন। ১৯০৩ সালে দম্পতি একটি জাতীয়তাবাদী উর্দু সংবাদপত্র 'উর্দু ই মুআল্লা' শুরু করেন। ব্রিটিশরা এটা পছন্দ করেনি। ১৯০৮ সালে হাসরাতের জেল হয়। তাঁর মুক্তির পর, দম্পতি আবার পত্রিকা চালু করেন। পত্রিকাটির মাত্র দুজন কর্মচারী ছিল- নিশাত ও হাসরাত।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় হাসরাতকে আবারও জেলে যেতে হয়েছিল। নিশাত যিনি তাঁর সময়ের অন্যান্য মুসলিম মহিলাদের মত পর্দা ব্যবহার করতেন, আদালতের বিচারের সময় স্বামীকে রক্ষা করার জন্য জনসমক্ষে এসেছিলেন। তিনি নেতাদের চিঠি লেখেন। সংবাদপত্রে প্রবন্দ লেখেন। আদালতের যাওয়ার সময় পর্দা প্রথা পুরোটাই বিসর্জন দেন। পর্দা বা বোরখা ছাড়া ঘর থেকে বার হওয়া সেই সময় ছিল অত্যান্ত সাহসী পদক্ষেপ।
হাসরাতের বন্ধু পণ্ডিত কিশাণ পার্শাদ কৌল লিখেছেন, নিশাতক এমন সময় এই সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন যখন পর্দা প্রথা শুধুমাত্র মুসলিমদের মধ্যে নয়, হিন্দুদের মধ্যেও মর্যাদার প্রতীক ছিল। সেই সময়ে কংগ্রেস এবং অন্যান্য সংগঠনগুলি জেলে বন্দী মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারকে সাহায্য করার জন্য পাবলিক ফান্ড সংগ্রহ করত। নিশাত এতে তার অংশ গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। পণ্ডিত কিষাণ পার্শাদ পরে স্মরণ করেন যে ১৯১৭ সালে যখন তিনি একবার আলীগড়ে তাকে দেখতে গিয়েছিলেন তখন তিনি তাকে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে থাকতে দেখেছিলেন। হাসরাতের বন্ধু হওয়ায় সে তাকে টাকার প্রস্তাব দেয়। নিশাত তাকে বলেন, “আমার যা আছে তাই নিয়ে খুশি”। পরে তিনি তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে তিনি তাকে তাদের বিলুপ্ত প্রেস থেকে মুদ্রিত উর্দু বই বিক্রি করতে সাহায্য করতে পারেন কিনা। কিষাণ পার্শাদ নিশাতের অবস্থা সম্পর্কে লখনউয়ের আরেকজন বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী শিব প্রসাদ গুপ্তকে বলেছিলেন। শিবপ্রসাদ গুপ্ত নিশাতের কাছ থেকে সমস্ত বই কিনে নেওয়ার জন্য চেক লিখে দিয়েছিলেন।
যাইহোক এডইউন মন্টেগু ১৯১৭ সালে ভারত সফর করেন। নিশাত তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য অল ইন্ডিয়া উইমেন্স কনফারেন্সের প্রতিনিধিদের মধ্যে ছিলেন। বৈঠকে তিনি সকল মুক্তিযোদ্ধাকে জেল থেকে মুক্তির দাবি জানিয়েছিলেন। নিশাত ভারতের ভাল জন্য পর্দা ত্যাগ করেছিলেন। ১৯১৯ সালে তিনি জালিওয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের পরে অমৃতসর কংগ্রেসের অধিবেশনে যোগদান করেন। তাঁর আবেগপূর্ণ ভাষণ সেই সময় অনেককেই মুগ্ধ করেছিল। একজন মুসলিম মহিলা, পরদা ছাড়া স্বামীর সঙ্গে সমানভাবে রাজনীতিতে অংশ নিয়েছিল- যা দেখে সেই সময় অনেকেই অবাক হয়েছিলেনয তাঁদের হাসরাতের কমরেড বলেও ডাকত।
নিশান হাসরাত নিশ্চিত ছিলেন যে ব্রিটিশদের কাছ থেকে চেয়ে স্বাধীনতা পাওয়া যাবে না। তারা পার্টির লক্ষ্য স্থির করেন ১৯২১ সালের কংগ্রেসের আহমেদাবাদ আধিবেশনে। সেখানেই পূর্ণ স্বরাজের দাবি উঠে। একটি একটি অধিপত্যের লড়াই। আন্দোলনের সমর্থনে নিশাতের বক্তব্য মন ছুঁয়েছিল মহাত্মা গান্ধীরও। যদিও তিনি এই ধারনার বিরোধিতা করায় প্রস্তাবটি খারিজ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ৮ বছর পরে কংগ্রেসই পূর্ণ স্বরাজ প্রস্তাব গ্রহণ করেছিল।
১৯২২ সালে হাসরাতকে আবারও জেলে পাঠান হয়। সেই সময় হাসরাত ছাড়াই গয়াতে কংগ্রেসের অধিবেশনে যোগ দেন নিশাত। তিনি আইন পরিষদে কংগ্রেস সদস্যদের যোগদানের বিরোধিতা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, যারা ব্রিটিশ শাসন থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি করছে তারা কী করে অ্যাসেম্বলিতে প্রবেশের স্বপ্ন দেখতে পারে।
অধ্যাপক আবিদা সামিউদ্দিনের মতে, নিশাতের রাজনীতি শুধু হাসরাতের ওপর নির্ভর করেনি। তিনিই প্রথম মুসলিম মহিলা যিনি কংগ্রেসের অধিবেশনে ভাষণ দেন। স্বদেশী জনপ্রিয়তা করার জজন্য তার কাজ, অল ইন্ডিয়া উইমেন কনফারেন্স, জাতীয়তাবাদী নেতাদের সাথে চিঠিপত্র, সংবাদপত্রে নিবন্ধ, জনসাধারণের বক্তৃতা এবং অন্যান্য রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড- এগুলি প্রমাণ করে যে তিনি ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামে অত্যান্ত সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে ছিলেন। ১৯৩৭ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি শ্রমিক আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন।
আরও পড়ুনঃ
Monsoon: বিলম্বিত লয়ে আসছে বর্ষা, কেরলে মৌসুমী বায়ুর প্রবেশ চার দিন পিছিয়ে - জানাল মৌসম ভবন
চলতি মাসে মোদীর হাতে উদ্বোধন নতুন সংসদ ভবনের ? ৯ বছর পূর্তিতে চমক মোদী সরকারের