যুদ্ধ-বিধ্বস্ত ইউক্রেনে রুশ গোলার আঘাতে মৃত ভারতীয় ছাত্র নবীন এসজি-র জন্যেই দেশে ফিরতে পেরেছেন। খারকিভ থেকে ফেরা চন্দন গৌড়া, এশিয়ানেট নিউজ'কে জানালেন সেই দেশের পরিস্থিতি।
বিশেষ উড়ানে, যুদ্ধ-বিধ্বস্ত ইউক্রেনে (Ukraine) আটকে পড়া, হাজার হাজার নাগরিককে দেশে ফিরিয়ে আনছে ভারত সরকার। তাদের বেশিরভাগই ইউক্রেনের বিভিন্ন কলেজের ছাত্রছাত্রী। তবে, খারকিভে (Kharkiv) রুশ গোলার আঘাতে ভারতীয় ছাত্র নবীন এসজি মৃত্যুতে এই উদ্ধার অভিযান ধাক্কা খেয়েছিল। নবীন কিন্তু তাঁর মৃত্যুর দিনই বহু ভারতীয় ছাত্রছাত্রীদের খারকিভ ছাড়তে সহায়তা করেছিলেন। চন্দন গৌড়া তাঁদেরই একজন। এশিয়ানেট নিউজ'কে দেওয়া একান্ত সাক্ষাতকারে তিনি জানিয়েছেন, ভারত সরকার পরিস্থিতি সম্পর্কে তাঁদের সব তথ্য দিয়েঠিল। কিন্তু, খারকিভ ন্যাশনাল মেডিকেল ইউনিভার্সিটি (Kharkiv National Medical University) তাদের সেখানে থেকে যেতে বাধ্য করেছিল। ফলে, হাজার হাজার শিক্ষার্থী ইউক্রেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহরে আটকে পড়েছিল। শুনে নেওয়া যাক, ইউক্রেনের পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি ঠিক কী জানালেন -
আপনি যখন সেখানে ছিলেন তখন খারকিভের পরিস্থিতি কী ছিল?
চন্দন - দশ দিন আগেও পরিস্থিতি স্বাভাবিক ছিল। আমাদের ক্লাসও চলছিল। ২৩ ফেব্রুয়ারি আমরা প্রথম বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পাই। আমি ও আরও নয়জন বন্ধু একটা অ্যাপার্টমেন্টে জড়ো হয়েছিলাম। খাবার-দাবার, মুদিখানার জিনিসপত্র সংগ্রহ করে রেখেছিলাম। জানতাম যে কিছু একটা ঘটতে চলেছে, কিন্তু আমরা ভাবতে পারিনি যে পরিস্থিতি এতটা গুরুতর হবে। ২৪ ঘন্টার মধ্যে পরিস্থিতির হাতের বাইরে চলে যায়। তারপর শুধু বিস্ফোরণ এবং গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছিল।
আরও পড়ুন - রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের আঁচ আন্তর্জাতিক তেল বাজারে, ২০০৮কে ছাপিয়ে গেছে মূল্যবৃদ্ধি
আরও পড়ুন - মেয়েকে ফিরে পাবো ভাবিনি- ইউক্রেন ফেরত সন্তানকে পেয়ে চোখের জলে ভাসলেন মা
বাঙ্কারে আপনারা কতজন ছিলেন?
চন্দন - প্রথম দিন আমরা মেট্রো টানেলে গিয়েছিলাম। কারণ ওটা কোনও ফ্ল্যাটবাড়ির থেকে বেশি নিরাপদ। কিন্তু সেখানে খাবার বা জলের কোনও ব্যবস্থা ছিল না। তাই আমরা ফ্ল্যাটে ফিরে আসি। তারপর ফ্ল্যাটের নিচের বাঙ্কারে আশ্রয় নিয়েছিলাম। পরের দুই দিনে মাত্র একবারই খাবার জুটেছে। সঙ্গে কিছু চকোলেট এবং স্ন্যাকস ছিল। পাঁচ দিন আমরা ওই বাঙ্কারে ছিলাম। সেখানে কোনও আলো ছিল না। তিন দিন পর পানীয় জলও শেষ হয়ে গিয়েছিল। কলের জলই খেয়েছি। মূত্রত্যাগের জন্য বাঙ্কারে একটা আলাদা জায়গা ছিল। মলত্যাগের জন্য আমাদের ফ্ল্যাটে যাওয়া ছাড়া গতি ছিল না। মাত্র ৫০ মিটার দূরে হলেও, কারফিউ শিথিল হলে তবেই আমরা পালা করে যেতে পারতাম। রাতের বেলায়, এক-দু'জন জেগে থাকত। কাছাকাছি কোনও হামলার বিষয়ে ফোনে কোনও বার্তা আসছে কিনা, সেদিকে নজর রাখত তারা।
আরও আগে কেন ইউক্রেন থেকে চলে এলেন না?
চন্দন - ইউনিভার্সিটি আমাদের বলেছিল, যারা যেতে চায় তারা চলে যেতে পারে। যাদের কাজ আছে, তারা থাকতে পারে। আমাদের ক্লাস চলছিল। আমরা চলে এলে, আর ভিসা পাব না। তাই আমরা থেকে গিয়েছিলাম। আসলে, উফনিভার্সিটির ভুলেই আমাদের কষ্ট পেতে হয়েছে।
যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে ছাত্ররা কি ভারতীয় দূতাবাসের (Indian Embassy in Ukraine) পরামর্শগুলি পেয়েছিল?
চন্দন - হ্যাঁ, তিন সপ্তাহ আগে, দূতাবাসের পক্ষ থেকে ভারতীয় শিক্ষার্থীদের দেশে ফিরে যেতে বলা হয়েছিল। কিন্তু, সেই সময়ও বিশ্ববিদ্যালয় আমাদেরকে সেখানে থেকে যাওয়ার জন্য চাপ দিয়েছিল। তাও, আমরা অ্যাডভান্সড টিকিট বুক করেছিলাম। ৬ মার্চ পর্যন্ত সব টিকিট বুক ছিল। দুর্ভাগ্যবশত, ২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে উড়ান পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়।
খারকিভ থেকে আপনারা কীভাবে বের হলেন?
চন্দন - ২৮ ফেব্রুয়ারী আমরা নিজেদের দায়িত্বেই খারকিভ ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। পরের দিন আমাদেরকে খুব ভোরে ঘুম থেকে তুলে দিয়েছিলেন আমাদের সিনিয়র, নবীন। সেই সময়ে কোনও কারফিউ না থাকায় তিনি আমাদের তখনই বেরিয়ে পড়তে বলেন। তবে, তিনি নিজে সেখানে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। নবীন বলেছিলেন, তিনি অন্য জুনিয়রদের সঙ্গে নিয়ে খারকিভ ছাড়বেন। তিনি আমাদের বলেছিলেন, চিন্তা নেই, আমরা সবাই লভিভে দেখা করব। আমরা একটি ক্যাব নিয়ে স্টেশনে পৌঁছে ট্রেনে উঠেছিলাম। সব ব্যবস্থা নিজেদেরই করতে হয়েছিল। দুই ঘণ্টা পরই, আমরা ওই বাঙ্কারে থাকা বন্ধুদের কাছ থেকে জানতে পারি, নবীনের মৃত্যু হয়েছে। ভিডিওটা দেখে আমরা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। তাকে দেখতে যেতে পারিনি আমরা। যুদ্ধের মধ্যে, বাঙ্কারে যারা ছিল তারাও যেতে পারেনি। নবীন অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। গত বছরের পরীক্ষায় তিনি শীর্ষস্থান পেয়েছিলেন।
এমন শোনা যাচ্ছে যে ইউক্রেনে ভারতীয়দের ট্রেনে উঠতে দেওয়া হচ্ছে না?
চন্দন - ট্রেনে, আমাদের ১৫ ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল। পোল্যান্ড (Poland) সীমান্তে পৌঁছতেই, স্থানীয় কিছু বন্দুকধারী বাতাসে গুলি ছুড়তে শুরু করেছিল। তারা, প্রথমে তাদের মহিলা ও শিশুদের ট্রেনে উঠিয়েছিল, তারপরে বাকিদের ট্রেনে ওঠার অনুমতি মিলেছিল। দরজার কাছে দাঁড়ালে, কিয়েভে ধাক্কা মেরে ট্রেন থেকে নামিয়ে দেওয়া হতে পারে, কারণ সেখানেও অনেক লোক ওঠার জন্য অপেক্ষা করবে। তাই আমরা বগির মাঝখানে চলে গিয়েছিলাম। তবে, লভিভে পৌঁছানোর পর স্বস্তি মিলেছিল। ওই একই লোকজন আমাদের সঙ্গে খুব ভাল ব্যবহার করে। তারা আমাদের খাবারও দিয়েছিল।
ইউক্রেন পুলিশ বা রুশ বাহিনী কি আপনার আসার পথে কোন বাধা সৃষ্টি করেছে?
চন্দন - না, আমি আগেই বলেছি, খারকিভ ছেড়ে যাওয়ার সময় একমাত্র স্থানীয়রাই বাধা দিয়েছিল। কিন্তু, পরে তারাই আবার আমাদের অত্যন্ত শ্রদ্ধা-সম্মান দেখিয়েছে। রাশিয়া থেকে মাত্র ৬০ কিলোমিটার দূরে খারকিভ, তাই সেখানে দারুণ উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি ছিল। আর উত্তেজনা ছিল পশ্চিম দিকে, পূর্ব দিকে নয়। পোল্যান্ডে প্রবেশ করার পর, ভারত সরকার সমস্ত ব্যবস্থা করেছে। েষ পর্যন্ত আমরা ভারতে ফিরতে পেরেছি।
ভারত সরকারের প্রথম সাহায্য কখন আসে?
চন্দন - সরকার সবসময় সব তথ্য দিয়েছে এবং আমাদের সেখান থেকে চলে যেতে বলেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভুলেই আমরা সবাই আটকে পড়েছিলাম। আমরা সবাই তো আগেই থেকে আমাদের টিকিট বুক করে রেখেছিলাম। ৬ মার্চের মধ্যে চলেও আসতাম, কিন্তু তার আগেই উড়ান বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আপনি কি ফের ইউক্রেনে ফিরে যাবেন?
চন্দন - কখনই না, আমি আর কখনই ইউক্রেনে ফিরে যাব না। আসলে, আমরা পোল্যান্ডে থাকার সময়, খবর পেয়েছিলাম, শিক্ষার্থীরা যাতে দের তাদের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেন, তার জন্য এখন তাদেরকে পোল্যান্ড এবং অন্যান্য দেশে সরিয়ে দেওয়া হবে। আমরা এখনও এই বিষয়ে একটি পরিষ্কার চিত্র পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছি।