হাটখোলা থেকে ইংলিশ চ্যানেল, বিশ্ব সাঁতারের দরবারে বাঙালিদের নাম উজ্জ্বল করেছিলেন তিনি

  • ৪ বছর বয়স থেকেই জলের সঙ্গে সখ্যতা
  • কোচের কোলে চড়ে গিয়েছিল প্রথম পুরস্কার আনতে
  • জেদকে সঙ্গী করেই ইংলিশ চ্যানেল পার হওয়ার স্বপ্ন দেখলেন
  • তখন তাঁর বয়স মাত্র ১৮

Tapan Malik | Published : Sep 24, 2020 9:57 AM IST / Updated: Sep 24 2020, 03:28 PM IST

মাত্র ৪ বছর বয়স থেকেই জলের সঙ্গে তাঁর সখ্যতা গড়ে উঠতে থাকে! ওই বয়সেই কাকার সঙ্গে চাঁপাতলার ঘাটে কাকার সঙ্গে প্রতিদিন স্নান করতে যেত সে। জলের নেশা তখন থেকেই তাঁকে পেয়ে বসে। মেয়ের উৎসাহ দেখে বাবা তাঁকে হাটখোলা সুইমিং ক্লাবে ভরতি করে দিলেন।এক বছর পর শৈলেন্দ্র স্মৃতি সাঁতার প্রতিযোগিতায় ১১০ গজ ফ্রি-স্টাইলে প্রথম হল মেয়েটি। ছোট্ট মেয়েটি কোচের কোলে চড়ে গিয়েছিল পুরস্কার আনতে। সবাই দেখে বেশ অবাক হয়েছিল।

শুরু হয়ে গেল সাঁতার প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ। স্বাধীনতার আগের বছর থেকে পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত যতগুলি প্রতিযোগিতায় সে অংশ নিয়েছিল সবকটিতেই প্রথম। বাংলার মাটি ছাড়িয়ে গোটা দেশ, এমনকী দেশের সীমানা ছাড়িয়ে অনেকেই তাঁর নাম জেনে গেল। মাত্র আড়াই বছর বয়সে মাকে হারিয়েছিলেন আরতি সাহা। বাবা পাঁচুগোপাল সাহা চাকরি করতেন সেনা বিভাগে। মায়ের মৃত্যুর পর বোন ও দাদা মামারবাড়িতে চলে গেলেও ছোট্ট আরতি থেকে যায় উত্তর কলকাতার সাহাবাড়িতে, ঠাকুমার কাছে।

১৯৫২ সালে হেলসিঙ্কি অলিম্পিকে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাঁতারু ডলি নজিরের সঙ্গে সে ছিল ভারতের সর্বকনিষ্ঠ প্রতিনিধি। বাংলাদেশের সাঁতারু ব্রজেন দাসের কাছ থেকে পেয়েছিলেন অনুপ্রেরণা। সেই অনুপ্রেরণা আর নিজের জেদকে সঙ্গী করে তিনি  ইংলিশ চ্যানেল পার হওয়ার স্বপ্ন দেখলেন ৷ তখন তাঁর বয়স মাত্র ১৮৷ অবশ্য সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল৷ কিন্তু হতাশা তাঁকে একেবারেই মানায় না। এর পরের বছর আবার ইংলিশ চ্যানেল জয় করার স্বপ্ন নিয়ে জলে নামেন৷ ১৯৫৮-৬১ সালের মধ্যে মোট ছ’বার ইংলিশ চ্যানেল পারাপার করেছিলেন এশিয়া তথা তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের সাঁতারু ব্রজেন দাস। ভারতীয় মহিলা হিসেবে কে এই সাঁতার-অভিযানে সক্ষম হবে জানতে চাওয়ায়, তিনি আরতি সাহার নাম সুপারিশ করেন। তত দিনে আরতি সাহা নামটি বিশ্বের সাঁতারের দরবারে বেশ পরিচিত। কিন্তু কেবলমাত্র নামই যথেষ্ট নয়! প্রয়োজন ছিল প্রায় কুড়ি হাজার টাকা! 

দিনে পাঁচ-ছ’ঘণ্টা অনুশীলন, চাকরি, তার পর টাকার জন্য ঘুরে ঘুরে খালি হাতে ঘরে ফেরা এই ছিল তাঁর তখনকার দিন প্রতিদিন। অল ইন্ডিয়া স্পোর্টস কাউন্সিল-এর সদস্য পঙ্কজ গুপ্ত আরতিকে নিয়ে গেলেন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের কাছে আর্থিক সাহায্যের জন্য। চ্যানেল পার হওয়ার কথা শুনে বিধানচন্দ্র রায় বলেছিলেন, ‘ইংলিশ চ্যানেল চোখে দেখেছ! পার যে হবে বলছ?’ পরে অবশ্য আরতির মাথায় হাত রেখে মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন,  টাকা কাল সকালে তোমার বাড়িতে পৌঁছে যাবে। চিন্তা করো না হাসি মুখে বাড়ি ফিরে যাও’। হ্যাঁ আর্থিক সাহায্য আরও অনেক মিলেছিল। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন জওহরলাল নেহরু, মিহির সেন, প্রফুল্লচন্দ্র সেন, অতুল্য ঘোষ।  

তারপর এল সেই দিনটি, ২৭ অগস্ট, ১৯৫৯, কিন্তু সূচনা শুভ হল না, শুরুতেই গণ্ডগোল! প্রায় চল্লিশ মিনিট দেরিতে এল ন্যাভিগেশন বোট। কিন্তু তা দমিয়ে রাখতে পারেনি আরতিকে। ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করা প্রথম এশীয় মহিলা আরতি বলেছিলেন, ‘সাঁতার কাটতে কাটতে চোখে পড়ল একটা কচ্ছপ পাশ দিয়ে ভেসে যাচ্ছে। মনে হয়েছিল ওটার পিঠে চেপে চলে যাই। ঠান্ডায় হাত পা কেটে কেটে যাচ্ছিল। দশটা জ্বলন্ত উনুন পেটের কাছে থাকলে ভাল হয়। ১৪ ঘণ্টা ১০ মিনিট সাঁতার কাটার পর লক্ষ্য স্পর্ষ করতে তখন বাকি মাত্র ৩ মাইল। বোটম্যান ঘুরপথে নিয়ে গেলে আরতি স্রোতের বিপরীতে পড়ে যায়। তাঁর পাশে তখন সাঁতার কাটছেন ১৯৪৮ সালের লন্ডন অলিম্পিকের সোনাজয়ী সাঁতারু গ্রেটা অ্যান্ডারসন। স্রোতের মুখে আর এগোতে পারছেন না দেখে বোটম্যান আরতিকে ছুঁয়ে দেন— নিয়মানুয়াযী কেউ সাঁতারুকে স্পর্শ করলে তিনি বাতিল হয়ে যান।

২৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৫৯— সাঁতরে ইংলিশ চ্যানেল পার করলেন আরতি সাহা। সময় নিয়েছিলেন ১৬ ঘণ্টা ২০ মিনিট। ফ্রান্সের কেপ গ্রিস নে থেকে ইংল্যান্ডের স্যান্ডগেট।ভোর ৫ টা ৫৫ মিনিটে জলে নেমে আঁকাবাঁকা পথে ৪২ মাইল পথ অতিক্রম। ক্যাপ্টেন হার্টিনসন গাইড হিসেবে তাঁর জীবনে প্রথম কোনও মহিলাকে পথ দেখাচ্ছিলেন। চ্যানেলের একটি বন্দর ফকস্টোন থেকে ৫ মাইল দূরে স্যান্ডগেটে বোট থেমে গেলেও নিয়ম অনুযায়ী আরও ১০ গজ হেঁটে যেতে হয় প্রতিযোগীদের। অবশেষে সাফল্য পান আরতি সাহা।

Share this article
click me!