পীত বর্ণ না হরিদ্রা রঙে রাঙিয়ে থাকেন দেবী, মা দুর্গার গাত্রবর্ণ নিয়ে রয়েছে নানা মুনির নানা মত

  • মা দুর্গার গাত্রবর্ণ নিয়ে রয়েছে নানান রহস্য
  • দুর্গার বর্ণ-মালা ত্রিবর্ণরঞ্জিত
  • বড়দেবীর মন্দিরে রয়েছে লাল দুর্গামূর্তি
  • বৈকণ্ঠপুর রাজবাড়ির দুর্গাও রক্তবর্ণা

Tapan Malik | Published : Oct 20, 2020 9:48 AM IST / Updated: Oct 20 2020, 03:20 PM IST

দেবী দুর্গা বলতেই চোখে ভেসে ওঠে পীতবর্ণ কিংবা হরিদ্রাবর্ণ অথবা অতসী। রঙ নিয়ে রহস্য লুকিয়ে আছে সনাতন বিধানে। সেখানে বলা হয়েছে, দেবীর গায়ের রং অতসী ফুলের মতো। এবার মজার ব্যাপার হল, অতসী ফুল বঙ্গদেশের একেক জায়গায় একেক রঙের ফোটে। বেশির ভাগ জায়গাতেই তার রঙ হয় সোনালি, তাই বঙ্গদেশের দুর্গার মূর্তির গায়ের রং হয় সোনার মতো।আবার কিছু কিছু জায়গায় অতসী ফুল ফোটে নীল রঙের,  সেইসব জায়গায় দুর্গামূর্তি হত নীল রঙের। এই রং নিয়ে নানা রকম ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ আছে। দেবীর বর্ণনায়  ‘তপ্তকাঞ্চনবর্ণাভ্যাম্’ কথাটা পাওয়াই যায়। ঋগ্বেদ অনুযায়ী আদিবর্ণ, ‘লোহিতকৃষ্ণশুক্লাম্’। ছান্দোগ্য উপনিষদে বলা হচ্ছে, তিনটি বর্ণই আদি, ‘ত্রীণি রূপাণীত্যেব সত্যম্’। অগ্নি বা সূর্য হল লোহিত। জল বা বরুণ হল শ্বেত। পৃথ্বী বা পৃথিবী হল কৃষ্ণ।

আরও পড়ুন- উত্তর থেকে দক্ষিণ, কলকাতার দুর্গা পুজোয় এবারও থিমের রমরমা

আবার দুর্গার বর্ণ-মালা ত্রিবর্ণরঞ্জিত! প্রাতে সরস্বতী, অর্থাৎ শুক্লাবর্ণা। মধ্যাহ্নে হরিদ্রাবর্ণা। সায়াহ্নে লোহিত-স্বর্ণবর্ণা! বর্ণনায় দিনের তিনটি বিভিন্ন সময়ে সূর্যের তিন রকম রঙের আভাস। সেই রং থেকেই ভেবে নেওয়া হয়েছে দেবীর তিন বর্ণ! ১৫৬২ তে কোচ রাজা নরনারায়ণ সংকোশ নদীর ধারে চামটা গ্রামে যে পুজোর সূচনা করেছিলেন সেই বন্দিত দেবীর গায়ের রং টকটকে লাল। কোচবিহারের বড়দেবী বাড়ির দুর্গাপুজো। দুর্গা-মূর্তির রং ও রুপ সম্পূর্নভাবেই অন্যরকম। দুর্গা বসে আছেন বাঘের পিঠে। দেবীর রূপ নয় শান্ত, সৌম। দশপ্রহরনধারিণী ভয়াল দর্শনা। দেবীর সংসারে লক্ষ্মী, গনেশ, কার্তিক, সরস্বতীর বদলে দুপাশে আছেন জয়া ও বিজয়া। 

পুরনো কোচবিহার থেকে মাত্র এক কিমি দূরে বড়দেবীর মন্দির। সারা বছর কোনও পুজোআচ্চা না হলেও বড়দেবী বাড়ী কোচবিহারে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ। সপ্তমী থেকে দশমী- বছরে চারটি দিন তাঁর দর্শন ও তাঁকে নিবেদনের সুযোগ পান সাধারণ মানুষ। পুজোর অন্যতম অনুষঙ্গ পশুবলি- পায়রা থেকে পাঠা, মোষ, শোল মাছ, শুয়োর; বলি হয় রোজ। একসময় নাকি নরবলি প্রচলিত ছিল। প্রতীকী নরবলি এখনো চালু আছে তবে সাধারণের দেখা নিষেধ।  কেবলমাত্র কোচবিহারেই নয়, নবদ্বীপের যোগনাথতলার কুমারনাথ ভট্টাচার্যর বাড়িতে একশো সতেরো বছর ধরে হয়ে আসছে লাল দুর্গার পুজো। তবে ভট্টাচার্য পরিবারের আদি বাড়ি ঢাকার মিতরা গ্রামেও লাল দুর্গাপুজো হত। দেশভাগের বহু আগেই ভট্টাচার্য পরিবার মিতরা থেকে যোগনাথতলায় চলে এসেছিলেন। ঠিকানা বদল হওয়ার পরও পূর্বপুরুষদের পুজো যেমন চালিয়ে যাচ্ছেন, ধরে রেখেছেন লাল দুর্গামূর্তির ঐতিহ্য। 

আরও পড়ুন- কবে থেকে কিভাবে শুরু হয়েছিল পুজোর নতুন বাংলা গান

জলপাইগুড়ি বৈকণ্ঠপুর রাজবাড়ির দুর্গাও রক্তবর্ণা। হাতে থাকে শূল বা বল্লম জাতীয় অস্ত্র, সেটা দিয়েই দেবী অসুরের বক্ষদেশে আঘাত করেছেন। আগে কার্তিক, গনেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী কেউ থাকত না। কয়েক বছর ধরে তাদের লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তবে আগের মতো জয়া, বিজয়া, মহাদেব, ব্রহ্মা, মেছেনিও আছেন। রায়কত পরিবারের লাল দুর্গা বাঘের ওপরই অধিষ্ঠান করেন।  ওপার বাংলাতেও লাল দুর্গা পুজোর ঐতিহ্য রয়েছে। মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার পাঁচগাঁওয়ে লাল দুর্গা পুজো হয়ে আসছে প্রায় তিনশো বছর ধরে। মৌলভীবাজার জেলা সদর থেকে প্রায় ১৭ কিলোমিটার ও রাজনগর উপজেলা সদর থেকে প্রায় সাড়ে ৪ কিলোমিটার উত্তরে পাঁচগাঁও গ্রামে সর্বানন্দ দাসের বাড়িতে পালিত হয়ে আসছে এই পুজো।

আসলে দুর্গার 'শতরূপা' নামের মতোই, বঙ্গদেশ জুড়ে তাঁকে নিয়ে শতাধিক সংস্কার আজও রয়ে গেছে।এখনও বহু রাজবাড়ি, জমিদার বাড়িতে দুর্গাপুজো হয় নানা রূপে, নানা রীতিতে। প্রতিটি বাড়ির পুজোয়চলে নিজস্ব নিয়মরীতি। আবার দুর্গার বিভিন্ন রূপের পিছনেই লুকিয়ে রয়েছে নানা ধরণের গল্প। দক্ষিণ ২৪ পরগনার সুভাষ গ্রামের একটি পুজোর দুর্গার একদিক কালো আর একদিক সোনালি। সাধারণ মানুষের ধারণা, কালী আর দুর্গা এক হয়ে গিয়েছেন। মূর্তির কালো দিকটায় হাজার চেষ্টা করেও সোনালি রং করা যায়নি।  উত্তর ২৪ পরগনার ধান্যকুড়িয়ার সাহু-দেব বাড়ির পুজোতে সিংহর মুখ থেকে একটা ছোট্ট শাড়ির আঁচলের অংশ বের হয়ে থাকে। পরিবারের লোকরা বলেন, বহু বছর আগে এই বাড়ির এক বউ এলোচুলে সন্ধের সময় ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। তারপর থেকে বউটিকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। পরের দিন দেখা যায়, বউটির শাড়ির আঁচলের কিছুটা অংশ সিংহর মুখ থেকে বেরিয়ে আছে।  হুগলির একটি গ্রামে প্রত্যেক বছর পুজো হয় না। কারণ, সব বছর মা আসেন না। একটি নির্দিষ্ট পুকুরে দশমীতে দুর্গাকে বিসর্জন দেওয়া হয়। এরপর রথ পর্যন্ত অপেক্ষা! ওইদিন পুকুরের জলে কাঠামো ভেসে ওঠে। কিন্তু সব বছর কাঠামো ভেসে ওঠে না। যে-বছর ভাসে না, সে বছর ওখানে পুজো হয় না।

Share this article
click me!