প্রথম বাঙালি হিসেবে একশো বছর আগে শরৎচন্দ্র নিজেও কোয়ারেন্টিনে ছিলেন, জানুন সেই অজানা কাহিনি

Published : Sep 15, 2020, 05:40 PM IST
প্রথম বাঙালি হিসেবে একশো বছর আগে শরৎচন্দ্র নিজেও কোয়ারেন্টিনে ছিলেন, জানুন সেই অজানা কাহিনি

সংক্ষিপ্ত

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাঁচতে কোয়ারেন্টিনে থাকার কথা বলা হচ্ছে শব্দটি বাংলা বা বাঙালির কাছে একেবারে নতুন কিন্তু নয় কোয়ারেন্টিন-এর সঙ্গে পাঠকের পরিচয় ঘটে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের হাত ধরে জনপ্রিয় উপন্যাস শ্রীকান্ত-র দ্বিতীয় পর্বের তৃতীয় অধ্যায়ে কোয়ারেন্টিন শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন

প্রায় শুরুর দিন থেকেই করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাঁচতে কোয়ারেন্টিনে থাকার কথা বলা হচ্ছে। যে কারণে কোয়ারেন্টিন কথাটি দুনিয়াজুড়ে আলোচিত। পৃথিবীর লাখ লাখ মানুষ আজ এখনও কোয়ারেন্টিনে। যে কারণে কথাটি আমাদের কাছে এই করোনাকালে খুবই পরিচিত। তবে শব্দটি বাংলা বা বাঙালির কাছে একেবারে নতুন কিন্তু নয়। আজ থেকে একশোরও বেশী  বছর আগে বাংলা ভাষাতেই এই শব্দটি ব্যবহৃত হয়ছিল। কোয়ারেন্টিন-এর সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের পাঠকের পরিচয় ঘটে কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের হাত ধরে। তিনি তাঁর অন্যতম জনপ্রিয় উপন্যাস ‘শ্রীকান্ত’ দ্বিতীয় পর্বের তৃতীয় অধ্যায়ে কোয়ারেন্টিন শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন।  

রাজলক্ষ্মী ওরফে পিয়ারীবাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে শ্রীকান্ত বার্মা যাচ্ছেন। তখন সেখানে প্লেগের প্রকোপ। তাই কোয়ারেন্টিনে থাকার নিয়ম। চতুর্থ পরিচ্ছেদে শরৎচন্দ্র লিখছেন: 'পরদিন বেলা এগার-বারটার মধ্যে জাহাজ রেঙ্গুনে পৌঁছবে; কিন্তু ভোর না হইতেই সমস্ত লোকের মুখচোখে একটা ভয় ও চাঞ্চল্যের চিহ্ন দেখা দিল। চারিদিক হইতে একটা অস্ফুট শব্দ কানে আসিতে লাগিল, কেরন্টিন্। খবর লইয়া জানিলাম, কথাটা Quarantine:  তখন প্লেগের ভয়ে বর্মা গভর্নমেন্ট অত্যন্ত সাবধান। শহর হইতে আট-দশ মাইল দূরে একটা চড়ায় কাঁটাতারের  বেড়া দিয়া খানিকটা স্থান ঘিরিয়া লইয়া অনেকগুলি কুঁড়েঘর তৈয়ারী করা হইয়াছে;  ইহারই মধ্যে সমস্ত ডেকের যাত্রীদের নির্বিচারে নামাইয়া দেওয়া হয়। দশদিন বাস করার পর তবে ইহারা শহরে প্রবেশ করিতে পায়।'

এরপর জাহাজের চিকিৎসক শ্রীকান্তকে একান্তে ডেকে জানাচ্ছেন যে তার একটা চিঠি নিয়ে আসা উচিত ছিল। ‘’ চিকিৎসক বলেন, 'এরা মানুষকে এত কষ্ট দেয় যে কসাইখানার গরু-ছাগল-ভেড়াকেও এত কষ্ট সইতে হয় না। সেখানে যাওয়ার জন্য কুলি পাওয়া যায় না। সব জিনিস কাঁধে বইতে হয়। সরু সিঁড়ি দিয়ে ওঠা-নামা করতে হয়। রোদের মধ্যে যেতে হয় অনেকটা পথ। এমন বর্ণনা শুনে শ্রীকান্তের কপালে চিন্তার ভাঁজ। তিনি ভয় পেয়ে বিকল্প খুঁজছিলেন। চিকিৎসক ঘাড় নেড়ে জানালেন, না। ফলে কোয়ারেন্টিন অনেকটা বাধ্যতামূলক হয়ে গেল। উপন্যাসের এই পর্যায়ে এসে শরৎচন্দ্র লিখছেন:  'বেলা এগারটার সময় Quarantine-এর কাছাকাছি একটা ছোট স্টীমার আসিয়া জাহাজের গায়ে ভিড়িল। এইখানি করিয়াই নাকি সমস্ত ডেকের যাত্রীদের সেই ভয়ানক স্থানে লইয়া যাইবে। জিনিসপত্র বাঁধা-ছাদার ধুমধাম পড়িয়া গিয়াছে। আমার তাড়া ছিল না, কারণ ডাক্তারবাবুর লোক এইমাত্র জানাইয়া গেছে, আমাকে আর সেখানে যাইতে হইবে না। নিশ্চিন্ত হইয়া যাত্রী ও খালাসীর চেঁচামেচি দৌড়ঝাঁপ কতকটা অন্যমনস্কের মত নিরীক্ষণ করিতেছিলাম, হঠাৎ পিছনে একটা শব্দ শুনিয়া ফিরিয়া দেখি, অভয়া দাঁড়াইয়া।'

শ্রীকান্তকে ছেড়ে অভয়া কিছুতে কোয়ারেন্টিনে যাবেন না, ‘আমি বরং জলে ঝাঁপিয়ে পড়ব, তবু কিছুতেই এমন নিরাশ্রয় হয়ে ও জায়গায় যাব না’। শরৎচন্দ্রের পাঠকমাত্র জানেন যে এই আবেগ হল তাঁর সাহিত্যের সম্পদ। ‘আত্মাহুতির হুমকির পর শ্রীকান্তের পক্ষে আর অভয়াকে একা ফেলে যাওয়া সম্ভব হয় না। নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে তিনি যখন ছোট স্টিমারে উঠলেন, তখন ডাক্তার ডেকের ওপর থেকে চিৎকার করে হাত নেড়ে যেতে নিষেধ করলেন, 'ফিরুন, ফিরুন—আপনার হুকুম হয়েচে... আমিও হাত নাড়িয়া চেঁচাইয়া কহিলাম, অসংখ্য ধন্যবাদ, কিন্তু, আর একটা হুকুমে আমাকে যেতেই হচ্ছে।'  বর্মা মুলুকে দশ দিন সরকারি কোয়ারেন্টাইনে থাকার অভিঙ্গতা শরৎচন্দ্রের নিজের ভাষায় পঞ্চম পরিচ্ছেদের শুরুতেই রয়েছেঃ ‘কেরেন্টিন্‌-কারাবাসের আইন কুলিদের জন্য—ভদ্রলোকের জন্য নয়।' এই একটি বাক্যই যথেষ্ট সেকালের কোয়ারেন্টাইন বোঝার জন্য। আর শুধু সেকাল কেন, এ কালেও শরৎচন্দ্রের কথার মিল পাওয়া যাচ্ছে।   

শরৎচন্দ্র আজও প্রাসঙ্গিক। কিছুদিন আগেও উহান থেকে শিক্ষার্থীরা ফেরার পর তাদের নিয়ে রাখা হয়েছিল হজ ক্যাম্পে। সমালোচনা হয়েছিল তাদের গাদাগাদি করে থাকা আর খাওয়ার কষ্ট নিয়ে। একশো বছর আগের বার্মা বা মিয়ানমার ছিল ইংরেজ কলোনি। সেখানে প্লেগের প্রকোপ বাড়লে নেওয়া হয়েছিল নানা পদক্ষেপ। কিন্তু সেই যন্ত্রণার বেশিরভাগটাই সইতে হত গরিবদের। শরৎচন্দ্রের ভাষায় কেয়ারেন্টিনের যন্ত্রণা পোহাতে হতো মূলত ‘ছোটলোকদের’। যদিও কিছুটা খোল নলছে বদলেছে। এখন শুধু কোয়ারেন্টিনে কাজ হচ্ছে না বলে চালু হয়েছে লকডাউন। তাতেও ধনী, গরিবের মধ্যে ফারাক রয়েছে। যদিও করোনা রাজা থেকে প্রজা কাউকেই ভয় করছে না, ক্ষমার তো প্রশ্নই আসে না। না হলে দুনিয়ার তাবৎ রথি মহারথীরাও এ রোগে কাবু হতেন না।

PREV
click me!

Recommended Stories

৬০ সেকেন্ডের কম সময়ে মন ভালো করে দেওয়া অভ্যাসগুলি জানেন?
আজ বিশ্ব মানবাধিকার দিবস, প্রতিটি অধিকার রক্ষা করা প্রয়োজন