গত কয়েক বছরে তিনি যত না বক্সিং রিং কাঁপাচ্ছিলেন তার থেকে বেশি তাঁর বাকযুদ্ধ লেগেছিল মেরি কমের বিরুদ্ধে। নিখাত জারিন আসলে একজন বক্সার। আর এক বক্সারের সঙ্গে চারিত্রিকগতভাবে জুড়ে থাকে আগ্রাসী মনোভাব এবং প্রতিবাদ। এর জন্যই তাঁর সঙ্গে হওয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলেন নিখাত। কিন্তু, তাঁর মানসিকতা যে সাধারণ নয় একজন বিশ্বচ্যাম্পিয়নের মতোই তা নিখাত বোঝালেন বৃহস্পতিবার ইস্তানবুলে।
যে মেরি কম-কে তিনি গত কয়েক বছর ধরে বারবার কড়া বাকযুদ্ধে জর্জরিত করেছিলেন, এবার সেই মেরি কমের পাশে নাম তুলে ফেললেন নিখাত জারিন। যে বিশ্ব বক্সিং চ্যাম্পিয়নশিপে মেরি কম ছয় বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন সেই প্রতিযোগিতায় নয়া বিশ্বচ্যাম্পিয়নের নাম নিখাত জারিন। ইস্তানবুলে বিশ্ব বক্সিং চ্যাম্পিয়নশিপের ফ্লাইওয়েট বিভাগের ৫২ কেজিতে থাইল্যান্ডের অলিম্পিয়ান জিতপং জুতামাসকে হারান তিনি। খেলার ফল ৫-০।
শেষ চোদ্দ বছরে বিশ্ব বক্সিং চ্যাম্পিয়নশিপে সেরার পদক আনা একমাত্র ভারতীয়র নাম মেরি কম। তাই মেরি কমের পর নিখাত জারিন হলেন সেই মহিলা ভারতীয় বক্সার যিনি এই চ্যাম্পিয়নশিপের সোনা জিতলেন। নিখাত জারিনের আগে, মেরি কম ছাড়াও আরও তিন ভারতীয় বিশ্ব বক্সিং চ্যাম্পিয়নশিপে সোনা জিতেছিলেন। এরা হলেন সরিতা দেবী, জেনি আরএল এবং লেখা কেসি। মেরি কম আবার বিশ্ব বক্সিং চ্যাম্পিয়নশিপের ছয় বার সোনা জিতেছিলেন। নিখাত জারিন হলেন পঞ্চম ভারতীয় যিনি বিশ্ব বক্সিং চ্যাম্পিয়নশিপে সোনা জিতলেন।
বিশ্ব বক্সিং চ্যাম্পিয়নশিপে ভারতের সেরা পারফরম্যান্স ২০০৬ সালে। সেবার মোট ৮টি পদক জয় করেছিল ভারত। সেবার চারটি সোনা, একটি রূপো এবং তিনটি ব্রোঞ্জ ঝুলিতে এসেছিল। এবার ভারতের ঝুলিতে এসেছে একটি সোনা এবং ২টি ব্রোঞ্জ। ৫৭ কেজি বিভাগে মণীষা মোন এবং ৬৩ কেজি বিভাগে পরভিন হুড়া সেমিফাইনালে হেরে যাওয়ায় ব্রোঞ্জ পদক নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় তাঁদের। ২০০১ সালে বিশ্ব বক্সিং চ্যাম্পিয়নশিপে ভারত প্রথম পদক জিতেছিল। ৪৮ কেজি বিভাগে রূপো জিতেছিলেন মেরি কম। পরের বছর ৪৫ কেজি বিভাগে সোনা জেতেন মেরি কম।
নিখাত জারিন তাঁর কেরিয়ারের একটা সময় সমালোচিত হয়েছিলেন তাঁর রক্ষণাত্মক কৌশলের জন্য। কিন্তু এবার বিশ্ব বক্সিং চ্যাম্পিয়নশিপে কৌশল পুরো বদলে ফেলেন নিখাত। তাঁর আক্রমণাত্মক খেলা প্রশংসা কুড়িয়েছে সকলের। ইস্তানবুলে বিশ্ব বক্সিং চ্যাম্পিয়নশিপের প্রথম তিনিট বাউট তিনি জিতেছিলেন ৫-০ ফলে। ফাইনালেও তিনি একই ফলে মাত দিয়েছেন থাইল্যান্ডের প্রতিপক্ষকে। ফাইনাল ম্যাচে নামার আগে নিখাত জানিয়েছিলেন যে তিনি তাঁর আক্রমণাত্মক ও প্রতি-আক্রমণাত্মক খেলার মেজাজটা পছন্দ করছেন। অনুশীলনে এর জন্য প্রচুর পরিশ্রম তিনি করেছিলেন বলেও জানান নিখাত। ভারতীয় বক্সিং দলের প্রধান কোচ ভাস্কর ভাটও জানিয়েছিলেন যে নিখাত আগের চেয়ে অনেক বেশি আগ্রাসী মেজাজে খেলছে। এর আগে নিখাতকে নাকি তিনি এত আক্রমণাত্মক খেলতে দেখেননি।
সম্প্রতি মেরি কমের সঙ্গে লাগাতার বচসায় শিরোনামে আসেন নিখাত জারিন। ২০১৯ সালে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের ট্রায়ালের দিন সকালে আচমকাই নিখাতকে দল থেকে বাদ দেওয়া হয়। কারণ, মেরি কম-কে জায়গা করে দিতে চেয়েছিল ভারতীয় বক্সিং ফেডারেশনের কিছু কর্তা। এই ভারতীয় বক্সিং ফেডারেশনের এথিকস কমিটিতে অভিযোগও করেছিলেন নিখাত। এই নিয়ে চরম বিতর্ক হয়। টোকিও অলিম্পিক্সে যাওয়ার জন্য যোগ্যতা নির্ণয়ের ম্য়াচে মেরি কমের কাছে হেরে গিয়ে টোকিও অলিম্পিক্সের স্বপ্ন অধরা হয়ে গিয়েছিল নিখাত। এতেও তিনি ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। এবং অনৈতিকভাবে তাঁকে হারানো হয়েছে বলেও অভিযোগ তুলেছিলেন। মেরি কমের যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিলেন নিখাত জারিন।
২০২২ সালটা কেরিয়ারের পক্ষে ভালো যাচ্ছে নিখাতের। ফেব্রুয়ারিতে স্ত্রান্দজা মেমোরিয়াল বক্সিং প্রতিযোগিতায় প্রথম ভারতী মহিলা হিসাবে জোড়া সোনার পদক জিতেছেন তিনি। ইউরোপের সবচেয়ে প্রাচীন এই বক্সিং প্রতিযোগিতায় তিনি হারান টোকিও অলিম্পিক্সে রূপো জয়ী বুস নাজ কাকিরারোগ্গু এবং তিন বারের ইউরোপ চ্যাম্পিয়ন তাতিয়ানা ববকে। ২০১৯ সালে এশিয় বক্সিং চ্যাম্পিয়নশিপের ব্রোঞ্জ জিতেছিলেন। ২০১১ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সে জুনিয়র বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন।