সংখ্যালঘু তোষণেই এককাট্টা হিন্দু ভোট, বাংলা জয়ের স্বপ্ন দেখছে বিজেপি

 

  • বাংলা জয়ের স্বপ্ন দেখছে বিজেপি
  • হিন্দু ভোট নিয়ে আশাবাদী বিজেপি 
  • সংখ্যালঘু তোষণের রাজনীতি দায়ি 
  • দায়ি করছেন রাজনৈতিক মহল 

শমিকা মাইতি, প্রতিনিধি,  ভারত ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। ধর্মনিরপেক্ষ কথার অর্থ হল কোনও ধর্মেই পক্ষপাত না করা। সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু হোক বা সংখ্যালঘু মুসলিম- প্রশাসন যেন নিরপেক্ষ থাকে উভয় ক্ষেত্রে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হল, গত কয়েক দশকে পশ্চিমবঙ্গের ভোট ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতীক হতে পারেনি। রাজ্যের প্রায় ৬৯ শতাংশ ভোটার হিন্দু হওয়া সত্ত্বেও মুসলিম ভোটব্যাঙ্ক ফ্যাক্টর হয়েছে বিগত ভোটগুলিতে। কারণ, মুসলিমদের ভোট পড়ে এককাট্টা হয়ে, হিন্দুরা সেখানে বিচ্ছিন্ন। মুসলিম ভোটের পুরোটা নিজেদের ঝুলিতে নিতে মরীয়া শাসকদল তাই তোষণের রাজনীতি করেছে চোখ-নাক-কান বুজে। সংখ্যালঘু তোষণের এই রাজনীতি কোনও কালেই পছন্দ করেনি বাংলার হিন্দুরা। কিন্তু ভোটবাক্সে সেই ক্ষোভের প্রতিফলনও হয়নি। এর দু’টো কারণ আছে। প্রথমত, বামেদের সংখ্যালঘু তোষণের নীতি ছিল খুবই সূক্ষ। মাথায় ওড়না দিয়ে মমতা ইমামদের ভাতা চালু না করলে তোষণের রাজনীতি এতটা প্রকট হয়ে ধরা দিত না। দ্বিতীয় কারণ হল, হিন্দুদের এককাট্টা হয়ে যাওয়ার মতো কোনও জায়গা ছিল না বাংলায়। ২০১৯ সালে লোকসভা ভোটের সময় হিন্দুত্ববাদের ধ্বজাধারী বিজেপিকে আশ্রয় করে হিন্দুভোট পুঞ্জীভূত হওয়া শুরু করে। দু’বছর পর সংখ্যাগরিষ্ঠ সেই হিন্দু ভোটে সওয়ার হয়ে ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে জয়ের স্বপ্ন দেখছে বিজেপি।

Latest Videos

দুই মন্ত্রীর ভাগ্যপরীক্ষা চতুর্থ দফায়, তালিকায় রয়েছে বাম-কংগ্রেস-বিজেপির গুরুত্বপূর্ণ প্রার্থীরা ...
ভোটকুশলী প্রশান্ত কিশোরের সদ্য ভাইরাল হওয়া একটি অডিও ক্লিপেও এই মতের স্বপক্ষে কথা শুনতে পাওয়া গিয়েছে। অডিও ক্লিপে প্রশান্তকে বলতে শোনা গিয়েছে, ‘গত ২০ বছর ধরে বাংলায় সিপিএম থেকে শুরু করে তৃণমূল কংগ্রেস পুরোপুরি মুসলিম ভোটব্যাঙ্ককে নিশানা করেছিল। এর মানে ছিল, মুসলিমরা যে রাজনৈতিক দলকে সমর্থন দেবে তারাই সরকার তৈরি করবে। কিন্তু, এবারের ভোটের অঙ্কটা আলাদা। কারণ,  হিন্দুদের ভোটের বিশাল অংশ বিজেপি-র দিকে ঝুঁকে রয়েছে। যেভাবে সিপিএম, তৃণমূল, কংগ্রেসরা সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্কের ফায়দা তুলেছে তার একটা খারাপ প্রভাব পড়েছে সমাজের উপরে। এই কথাকে কেউ অস্বীকার করতে পারবে না।’ প্রশান্ত আরও বলেছেন, ‘ভোট থাকলে তা মোদীর নামে রয়েছে। ভোট থাকলে হিন্দুত্বের নামে রয়েছে। মেরুকরণ, মোদী, হিন্দিভাষী, দলিত এগুলিই ফ্যাক্টর। শুভেন্দু গেল কী প্রশান্ত কিশোর এল, তা এখানে ধর্তব্যের বিষয় নয়।’

৪র্থ দফায় ৪৪টি আসনে লড়াই, বিজেপির উত্তরবঙ্গে উত্থানের প্রভাব কি পড়বে দক্ষিণবঙ্গে ...
২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে বিজেপির আভ্যন্তরীণ সমীক্ষাও এই হিন্দুভোটের উপরেই জোর দিচ্ছে। ওই সমীক্ষা মোতাবেক, পশ্চিমবঙ্গে ২৯৪টা বিধানসভা আসনের মধ্যে যে ১৪৫টিতে ৮০ শতাংশের উপর ভোটার হিন্দু, সেখানে ৬০ শতাংশ হিন্দু-ভোট এককাট্টা হয়ে বিজেপির পক্ষে গেলে ১১০-১২০টা আসনে জয় নিশ্চিত। সেক্ষেত্রে ‘ম্যাজিক ফিগার’ ১৪৮টা আসনের অনেকটাই কাছে পৌঁছে যাবে বিজেপি। তবে, হিন্দু ভোট ১০ শতাংশ কমে ৫০ শতাংশ হলে ওই ১৪৫টা আসনের মাত্র ৭০-৭৫টা পাবে বিজেপি। সেক্ষেত্রে তার প্রতিপক্ষ তৃণমূল ৬০-৬৫টা আসনে জিতে ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলবে।  
প্রসঙ্গত, ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে এই ১৪৫টা আসনের মধ্যে ৯২টিতে এগিয়েছিল বিজেপি, যেখানে মাত্র ৫৩টাতে এগিয়েছিল তৃণমূল। আর একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাচ্ছে সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে যেমন, মালদা (৭৯%), উত্তর দিনাজপুর (৭৬%), দার্জিলিং (৭৯%), কোচবিহার (৬৫%), দক্ষিণ দিনাজপুর ও নদিয়ায় (৬৩%) বিজেপি হিন্দুভোট বেশি পেয়েছে।  সেই তুলনায় কলকাতা (৪৬%), পূর্ব মেদিনীপুর (৪৮%), হাওড়া ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা (৫১%), পশ্চিম মেদিনীপুর ও মুর্শিদাবাদে (৫০%) বিজেপির ভোটশেয়ার কম ছিল। এবারের ভোটে দক্ষিণের এই সব এলাকাগুলিতে ভোটশেয়ার বাড়ানোর চেষ্টা করছে বিজেপি।

মহিষাসুরমর্দিনীর রূপদাত্রী শ্রাবন্তী চট্টোপাধ্যায় কি শত্রুদমনে সক্ষম হবেন, জনতার রায় ১০ এপ্রিল ...
এই প্রেক্ষিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে হিন্দু তফসিলি জাতি-উপজাতিদের ভোট। পশ্চিমবঙ্গে মোট জনসংখ্যার ২৩%  রাজবংশী, মতুয়া, বাউরিদের মতো তফসিলি জাতির লোকজন। এর বাইরে উত্তরে চা বাগানের শ্রমিক, পশ্চিমে জঙ্গলমহলের আদিবাসীরা রয়েছেন, যাঁরা ইতিমধ্যেই বিজেপিকে পছন্দ করছেন। হিন্দু ভোটশেয়ার বাড়ানোর জন্য রাজবংশী, নমঃশূদ্র ও চা-বাগানের শ্রমিকদের ভোটশেয়ারের পুরোটা নিজের ঝুলিতে আনার চেষ্টা করছে বিজেপি। এবারের বাজেটে চা বাগানের মহিলা শ্রমিক ও শিশুদের উন্নয়ন প্রকল্পে ১০০০ কোটি টাকার একটা ফান্ড রেখেছে বিজেপির কেন্দ্রীয় সরকার। রাজবংশী ভোট ঝুলিতে পুরতে সাংসদ নিশীথ প্রামাণিককে দিনহাটা বিধানসভা কেন্দ্র থেকে ফের দাঁড় করানো হয়েছে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ঘোষণা করেছেন, প্যারামিলিটারি বাহিনীতে নারায়ণী আর্মি ব্যাটেলিয়ন তৈরি করা হবে যেখানে রাজবংশী যুবকদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।  একই কারণে মতুয়া ভোট এককাট্টা করার চেষ্টা চলছে। দ্রুত সিএএ লাগু করে বাংলাদেশের উদ্বাস্তু মতুয়াদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে বলে আশ্বাস দিচ্ছে বিজেপি। ৫০তম স্বাধীনতা বর্ষপূর্তি উপলক্ষে বাংলাদেশে গিয়ে মতুয়াদের তীর্থক্ষেত্র ওড়াকান্দি পরিদর্শন করে এসেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। অডিও ক্লিপে প্রশান্তও মতুয়া ভোটের কথা উল্লেখ করেছেন। তাঁর কথায়, ‘আমাদের সমীক্ষার হিসাব বলছে, লোকসভা নির্বাচনের মতো একতরফা না হলেও এখনও মতুয়া ভোটের ৭৫ শতাংশ বিজেপির পক্ষে এবং ২৫ শতাংশ তৃণমূলের পক্ষে যাবে।’  পাশাপাশি ১ কোটি হিন্দিভাষী এবং ২৭ শতাংশ দলিত ভোটার পুরোপুরি বিজেপির সঙ্গে রয়েছে বলেও জানিয়েছেন প্রশান্ত। 


অডিও ক্লিপে প্রশান্ত বামদল থেকে কি ভাবে ভোট বিজেপির দিকে যাচ্ছে, সে কথা বলেছেন। এটা ঠিক, ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে বিজেপির ৪০.৬৪ শতাংশ ভোটের মধ্যে প্রায় ১৩ শতাংশ ভোট এসেছিল বামদল থেকে আর ৭ শতাংশ কংগ্রেস থেকে। হিন্দু ভোটের হিসাব ধরলে এই সুইং আরও বেশি। লোকনীতি সিএসডিএস ডাটা অনুযায়ী, ২০১৯-এর ভোটে বিজেপি ৫৭ শতাংশ হিন্দু ভোট পেয়েছিল। যেখানে ২০১৪ সালে তারা পেয়েছিল ২১ শতাংশ। বামেদের ক্ষেত্রে হিন্দু ভোট ২০২৪ সালে যেখানে ২৯ শতাংশ ছিল, ২০১৯-এ কমে হয় ৬ শতাংশ। কংগ্রেসের ক্ষেত্রে ৬ থেকে কমে ৩ শতাংশ। অর্থাৎ, ভোট সুইয়েংর ক্ষেত্রেও বিজেপির মেরুকরণের রাজনীতি কাজ করেছে পুরোদমে। রায়গঞ্জের মতো আসন যেখানে প্রায় ৪৯ শতাংশ মুসলিম ভোটার রয়েছে, সেখানেও এই হিন্দু ভোট এককাট্টা হওয়ার জন্য আসন জিতে বেরিয়ে গিয়েছে বিজেপি। এই আসনে মুসলিম ভোট ভাগ হয়েছিল তৃণমূলের কানাইয়ালাল আগরওয়াল ও সিপিএমের সাংসদ মহম্মদ সেলিমের মধ্যে। কিন্তু হিন্দুভোটের পুরোটাই পেয়ে জিতে গিয়েছেন বিজেপির দেবশ্রী চৌধুরী। একই ভাবে কোচবিহার আসনে প্রায় ৩০ শতাংশ মুসলিম ভোটার থাকা সত্ত্বেও তৃণমূলের পরেশচন্দ্র অধিকারীকে ৫৪ হাজার ভোটে হারিয়ে দেন বিজেপির নিশীথ প্রামাণিক। ২০১৪ সালে এই আসনে যেখানে বিজেপির ভোটশেয়ার ছিল ২৮ শতাংশ, ২০১৯-এ বেড়ে হয় ৪৮ শতাংশ। বালুরঘাটের ক্ষেত্রেও এক ছবি। এক তৃতীয়াংশ মুসলিম ভোট থাকা সত্ত্বেও এই আসনে তৃণমূলের বুদ্ধিজীবী নেত্রী অর্পিতা ঘোষকে ১৩ হাজার ভোটে হারিয়ে দেন বিজেপির সুকান্ত মজুমদার। 


এই সব দেখেশুনে বিপদঘণ্টি টের পেয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর মাথার উপরে চিরাচরিত ওড়নাটা আর নেই। বরং মন্দিরে-মন্দিরে পুজো দিচ্ছেন। ইমামদের মতো পুরোহিতদের জন্য ভাতা ঘোষণা করছেন। আর মমতাও জোর দিয়েছেন তফসিলি জাতি-উপজাতিদের ভোটব্যাঙ্কে। রাজ্যে ৬৮টি বিধানসভা কেন্দ্রের আসন তফসিলি উপজাতির জন্য সংরক্ষিত হলেও এই ক্যাটেগরিতে তৃণমূলের প্রার্থী ৭৯ জন। ১৭ মার্চ তৃণমূল যে নির্বাচনী ইস্তাহার প্রকাশ করেছে, তাতে ন্যূনতম আয় সুনিশ্চিত প্রকল্পে জেনারেল ক্যাটেগরির মহিলাদের হাতে যেখানে মাসে ৫০০ টাকা ভাতা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, সেখানে তফসিলি জাতি-উপজাতি এবং দলিত মহিলাদের ১০০০ টাকা করে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। মাহাতোদের এসসি ক্যাটেগরিতে ঢোকানোর জন্য কেন্দ্রে চিঠি পাঠিয়েছেন মমতা। রাজ্য পুলিশে আলাদা করে নারায়ণী ব্যাটেলিয়ন, গোর্খা ব্যাটেলিয়ন ও জঙ্গলমহল ব্যাটেলিয়ন গড়ার ঘোষণা করেছেন, যেখানে সংশ্লিষ্ট এলাকার যুবকেরা কাজে অগ্রাধিকার পাবেন। জমির অধিকার দেওয়া হচ্ছে মতুয়াদের। মতুয়াদের উন্নয়নে বোর্ড গড়তে ১০ কোটি টাকার ফান্ড গড়েছেন মমতা। নমঃশূদ্রদের উন্নয়নেও ৫ কোটি টাকার একটা ফান্ড তৈরি করা হয়েছে। গোর্খা ভোটের জন্য ইতিমধ্যে বিমল গুরুংকে দলে টেনেছে তৃণমূল। 
ভোটের ফল কার দিকে যাবে, সময় বলবে। আপাতত রাজ্যের ভোট মানচিত্রে তারা যে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পেরেছে, এতেই খুশি বাংলার হিন্দুরা। 

 

Share this article
click me!

Latest Videos

'আমি বলছি, আমার নাম করে লিখে রাখুন' ঝাঁঝিয়ে উঠে যা বললেন শুভেন্দু | Suvendu Adhikari
প্রেমের নামে এসব কী! নিখোঁজ নাবালিকার মর্মান্তিক পরিণতি, শোকের ছায়া পরিবারে | Nadia News Today
‘২৬ এর নির্বাচনই তৃণমূলের শেষ নির্বাচন!’ Samik-এর সাবধানবাণী Mamata-কে, দেখুন | By Election Results
বাপ রে! ইঞ্জেকশন দিয়ে অজ্ঞান করে ডাকাতি! আতঙ্কের ছায়া গোটা এলাকায় | Salt Lake Theft News Today
রেলের উন্নয়নের নামে রাতের আঁধারে ধ্বংস হকারদের রুটিরুজি! Sheoraphuli-তে হাহাকার! | Hooghly News