তপন মল্লিকঃ- বিদায় নিয়েও ফিরে এসেছে শীত। আবহাওয়া যথেষ্ট ঠান্ডা না হলেও যেন ভরপুর শীতের আমেজ। কিন্তু বাংলার হাওয়ায় রাজনৈতিক উত্তাপ ক্রমশ বেড়েই চলেছে। আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের দামামায় সপ্তাহের শুরুতেই সেই উত্তাপ বেড়েছে বাংলার নয়া রাজনৈতিক টক্করে।
নন্দীগ্রামে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনসভা একই সময়ে কলকাতার টালিগঞ্জ থেকে রাসবিহারী মিছিল করে জনসভা করবেন সদ্য তৃণমূল-ত্যাগী শুভেন্দু অধিকারী।
সেই নন্দীগ্রাম যেখান থেকে বঙ্গ রাজনীতির পালবদলের সুচনা হয়েছিল একদিন। ঘুরে ফিরে সেই নন্দীগ্রামই যেন আবার বঙ্গ রাজনীতির আলোকবৃত্ত হতে চাইছে। ২০০৭-এ শুরু হয়েছিল নন্দীগ্রাম আন্দোলন। সেদিন থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছায়াসঙ্গী ছিলেন শুভেন্দু অধিকারী। ১৩ বছরের দোলাচলে প্রেক্ষাপট অনেকটাই বদলে গিয়েছে।
এই প্রথম শুভেন্দু ছাড়াই নন্দীগ্রামে মমতা। এমনকি তৃণমূল নেত্রীর পাল্টা হিসেবে ২৪ ঘন্টা পর খেজুরিতে সভা করবেন, সদ্য তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে নাম লেখানো নন্দীগ্রামের প্রাক্তন বিধায়ক শুভেন্দু অধিকারী।
ওদিকে সোমবার যখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নন্দীগ্রামের জনসভায় ভাষণ দেবেন তখন দক্ষিণ কলকাতায় বিজেপির পদযাত্রায় সামনের সারিতে থাকবেন অধিকারী পরিবারের মেজ ছেলে। অন্যদিকে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নন্দীগ্রাম সভায় থাকছেন না শিশির অধিকারী। যাচ্ছেন না দিব্যেন্দু অধিকারীও।
আরও পড়ুন, মতুয়াদের মন রাখতে বাংলায় আসছেন শাহ, প্রস্তুতি দেখতে সোমবার ঠাকুরনগরে মুকুল-কৈলাস
নন্দীগ্রামের সভা থেকে মমতা বিজেপির বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ শানাবেন। তিনি যা যা বলবেন তার পালটা জবাব অক্ষরে অক্ষরে দিতেই যে শুভেন্দু পাল্টা সভা করবেন তা ১৩ জানুয়ারি ভগবানপুর থেকে বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী আগেই জানিয়েছিলেন। সে কারণেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভার পরের দিন মঙ্গলবার, খেজুরির হেঁড়িয়ায় সভা করবেন শুভেন্দু অধিকারী। ওইদিনই আবার খেজুরিতেই পাল্টা সভা করবে তৃণমূল। সূত্রের খবর, সেখানে থাকতে পারেন মদন মিত্র।
তার আগে সপ্তাহের শুরুর দিন মমতার খাস তালুক দক্ষিণ কলকাতায় বিজেপির হয়ে শুভেন্দু অধিকারীর পদযাত্রা ও সভা। বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না; যেখানেই সভা করছেন তৃণমূল নেত্রী, সেখানেই গেরুয়া শিবির শুভেন্দু অধিকারীকে পাল্টা লড়িয়ে দিচ্ছে সভা বা কর্মসূচি মারফত। যেমন আগামী মঙ্গলবার পুরুলিয়ার হুটমুড়া ফুটবল গ্রাউন্ডে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ২৪ ঘন্টা পরেই পুরুলিয়ার জয়পুরে পাল্টা সভা করবেন শুভেন্দু।
কার্যত নন্দীগ্রামের ভূমিপুত্র শুভেন্দু অধিকারীর গেরুয়া শিবের যোগদান সরাসরি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধেই চ্যালেঞ্জ। অন্যদিকে তৃণমূলের ছোট বর সব নেতাই শুভেন্দু অধিকারী প্রসঙ্গ উঠলেই তাঁকে বিশ্বাসঘাতক এবং মীরজাফর বলে আক্রমণ করছেন। পাল্টা শুভেন্দু অধিকারী তৃণমূলকে দেশের সব থেকে সুবিধাবাদী দল এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সব থেকে সুবিধাবাদী নেত্রী বলে পাল্টা জবাব দিচ্ছেন। স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন ১৯৯৮, ১৯৯৯ এবং ২০০৪ সালের নির্বাচনে বিজেপির সমর্থনে লড়াইয়ের কথা। এছাড়াও ১৯৯৮ এবং ১৯৯৯ সালে পরপর দুবার অটলবিহারী মন্ত্রিসভায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে রেল ও কয়লা দফতরের মন্ত্রী ছিলেন, বলছেন সেই কথাও ।
আরও পড়ুন, আজ অভিষেকের গড়ে শোভন-বৈশাখী, বিষ্ণুপুরে রোড শো থেকে কী বার্তা
প্রসঙ্গত, ২০১১ সালে রাজ্যপাটে পালাবদলে নন্দীগ্রামের বিধায়ক হয়েছিলেন ফিরোজা বিবি। তারপর শুভেন্দু অধিকারী ২০১৪ সালে তমলুক লোকসভা কেন্দ্র থেকে জিতে সাংসদ হন। এরপর শুভেন্দু প্রায় ৮১ হাজার ভোটে জিতে ২০১৬ সালে নন্দীগ্রামের বিধায়ক নির্বাচিত হন। তবে এরপর থেকেই নন্দীগ্রামে তৃণমূলের পায়ের নীচ থেকে মাটি সরতে থাকে। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে নন্দীগ্রামে তৃণমূলের লিড কমে হয় প্রায় ৬৮ হাজার। আর বিজেপি-র ভোট বেড়ে যায় ৬২ হাজারের থেকে বেশি। অর্থাৎ গত কয়েক বছরে নন্দীগ্রামে বিজেপি-র উত্থান স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। পাশাপাশি একথাও ঠিক নন্দীগ্রাম আন্দোলন থেকেই শুভেন্দুর রাজনৈতিক উত্থান। আর সেই মাটিতেই এখন লড়াই শুরু হয়ে গিয়েছে তৃণমূল বনাম বিজেপির বলা ভাল, লড়াইটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বনাম শুভেন্দু অধিকারীর।
একুশের ভোটে বিজেপি যে শুভেন্দুকে সামনে রেখেই নন্দীগ্রামকে অ্যাডভান্টেজ করবে সেটা শুধু রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মত নয়, অন্যদিকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও চেষ্টা করবেন তাঁর একার ক্যারিশ্মায় নন্দীগ্রামের মাটি দখল করে রাখতে। যদিও নন্দীগ্রামে তৃণমূলের নেতাদের বিরুদ্ধে প্রচুর দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। তাই নন্দীগ্রাম আন্দোলনের আবেগকে উসকে দিয়ে মমতা একাই লড়াই চালাতে সচেষ্ট হয়ে উঠেছেন। অন্যদিকে শুভেন্দু বলছেন নন্দীগ্রাম কারও একার লড়াইয়ের জমি নয়। নন্দীগ্রাম আন্দোলনের স্মৃতি নিয়ে যুদ্ধ এখন তাই শুভেন্দু বনাম মমতার। এই অবস্থায় সোমবার নন্দীগ্রামে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনসমাবেশ। তৃণমূলের দাবি, ৩ লক্ষের বেশি জমায়েত হবে সেই সভায়। তারপরের দিনই পাল্টা সভা শুভেন্দুর। তিনি ইতিমধ্যেই ঘোষণা করেছেন, দুই মেদিনীপুরে ৩৫টি আসনেই হারবে ঘাসফুল, ফুটবে পদ্ম। একুশে কাকে বাছবে নন্দীগ্রাম? প্রশ্নটা সহজ হলেও উত্তরের জন্য এখনও বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।