কোথাও দোল পূর্ণিমাকে দোল যাত্রা বলে। আবার ফাল্গুনী পূর্ণিমাকেও দোল পূর্ণিমা বলা হয়ে থাকে। মতামতের তফাৎ যাই থাক না কেন আসলে এই উৎসব রঙের। এই রাজ্যেরও অনেক জায়গায় দোল উৎসব পালনে রকমফের আছে।
দোলপূর্ণিমায় কালীপুজো
দোল উৎসব মানে সবার চোখে রাধাকৃষ্ণের ছবিটাই ভেসে ওঠে। কিন্তু বাঁকুড়ার ইন্দাসের আকুই গ্রামে পূর্ণিমায় রাধাকৃষ্ণের মিলন উৎসবের জায়গায় মানুষ বিগত পাঁচ দশক ধরে দোলকালী পুজোয় মেতে উঠছেন। অমাবস্যা নয় এখানে কালীর আরাধনা হয় ভরা পূর্ণিমায়।
এক সময় আকুই গ্রামের কিছু যুবক প্রতি অমাবস্যায় কালীপুজো করতেন। হঠাৎই তাঁদের মনে হয়েছিল দোলের দিন কালীপুজো করলে কেমন হয়। যেমন ভাবা তেমন কাজ। জনৈক পণ্ডিত বিধান দেন, দোলপূর্ণিমাতেও কালী-আরাধনা সম্ভব, তবে অবশ্যই শাক্ত মতে কৃষ্ণকালী রূপে পুজো। আর বলিদান সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
আকুই হাই স্কুল সংলগ্ন মাঠে পাঁচ দিন ধরে চলে এই উৎসব। দোলের আগের দিন চাঁচর দিয়ে উৎসবের সূচনা হয়। স্থানীয় বাসিন্দা এবং বাইরে থেকে আসা ভক্তদের প্রণামীতে এখানে কালীর স্থায়ী মন্দির তৈরি হয়েছে। প্রতি দিন পুজো হওয়ার পাশাপাশি অমাবস্যায় বিশেষ পুজো হয়।
দোলকালী পুজো ঘিরে আকুই গ্রামে উৎসব চলে। রং খেলায় মেতে ওঠেন গ্রামের সব মানুষ। চার দিন গোটা গ্রাম মেতে ওঠে অন্য এক আনন্দে। ইন্দাসের সীমানা ছাড়িয়ে সোনামুখী, পাত্রসায়ের, বিষ্ণুপুর-সহ পার্শ্ববর্তী বর্ধমান জেলার মানুষও যোগ দেন ভিন্ন ধরনের এই দোল উৎসবে।
দোলে রঙ নেই
চারদিকে দোল উৎসবে সবাই যখন রং খেলায় মেতে তখন এই রাজ্যেরই বর্ধমান শহর এদিন রং খেলবে না। ইতিহাস প্রাচীন এই শহর এদিন একেবারেই রঙ এড়িয়ে যাবে। কোন নিয়ম বা নিষেধাঙ্গা নয়। বহু প্রাচীন রীতি। রাজ আমল থেকে এই প্রথা চলে আসছে বর্ধমানে। পরদিন সবাই যেখন রঙ তুলতে ব্যস্ত তখন রঙের উৎসবে মেতে ওঠেন বর্ধমানের বাসিন্দারা।
রাজা নেই, নেই রাজ আমলও কবে ঘুচে গিয়েছে। কিন্তু সে আমলের প্রথাই রীতিতে পরিণত হয়েছে এই শহরে। বর্ধমানের রাজা মহাতাব চাঁদ ১৮৫০ সাল নাগাদ এই প্রথার প্রচলন করেন। তিনি ঘোষণা করেন দোল পূর্ণিমার দিনটি শুধুমাত্র দেবতার দোল হিসেবেই পালিত হবে। দেবতার পায়ে আবির দিয়ে আর্শীবাদ নেবেন বাসিন্দারা। পরদিন দোল খেলবে সাধারন মানুষ।
সে সময় বর্ধমানের সব বৈষ্ণব মন্দিরেই রাজ পরিবারের পক্ষ থেকে দোল পূর্ণিমা পালন করা হত। যেহেতু দোল পূর্ণিমার দিন দেবতার দোল তাই এদিন প্রজাদের দোল খেলা নিষিদ্ধ ছিল। পরদিন শহর আবিরে আবিরে রাঙা হয়ে উঠতো। রাজা নিজেও রাজ কর্মচারীদের সঙ্গে দোল খেলায় মেতে উঠতেন। দেদার খানাপিনার ব্যবস্থা থাকতো রাজবাড়িতে।
পাথরায় অমাবস্যার দোল
পাথরা গ্রামের দোল উৎসব পূর্ণিমায় নয় অমাবশ্যায়। এটি কেবল অনন্য নয়, অসামান্য অনুষ্ঠান। এখানে এই উৎসবের নাম বুড়িমার দোল। এখানে দোল উৎসব পালন হয় দোল পূর্ণিমার পরবর্তী অমাবস্যায় শীতলা মাতার মন্দিরে কৃষ্ণ পক্ষের মধু কৃষ্ণ ত্রয়োদশী তিথিতে। যাকে স্থানীয় ভাবে বলা হয় শীতলা মাতার দোল উৎসব। আর দোল পূর্ণিমার আগের রবিবারে সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি, পাথরার বিভিন্ন মন্দিরে নাচে, গানে, অভিনয়ে, আবিরে, বাউল গানে, ছৌ নাচে হয় বসন্ত উৎসব।
অমাবস্যার দোল উৎসবের দু তিনদিন আগে ঢাক-ঢোল বাজিয়ে, ঢেরা পিটিয়ে সমস্ত গ্রামবাসীদের আমন্ত্রণ করা হয় দোল উৎসবে অংশগ্রহণ করার জন্য। এরপর অমাবস্যা তিথির আগের দিন, মূর্তি সহ পুরোহিত, ভক্ত, কচি কাঁচারা ঢাকের বোলের সঙ্গে গ্রাম পরিদর্শন করে। থাকে কীর্তনের দল।সন্ধ্যাবেলা বুড়িমার থানে হয় চাঁচর উৎসব।
পরের দিন শীতলা মন্দির প্রাঙ্গনে হৈ হৈ করে অনুষ্ঠিত হয় পাথরার দোল উৎসব। সারা গ্রাম ভেঙে পড়ে এখানে। এই দোল উৎসবের আরেকটি বিশেষত্ত্ব, উপস্থিত সবাইকে ধর্ম বর্ন নির্বিশেষে সেদিন পাত পেড়ে অন্নভোগের প্রসাদ খাওয়ানো হয়। বুড়িমার দোল আসলে বসন্ত উৎসবের দেখা ভূ ভারতে আর কোথাও মেলে কিনা জানা নেই।