মিসক্যারেজের পরেও গর্ভধারণ সম্ভব হতে পারে জানালেন বিশেষজ্ঞ। জেনে নিন ৬ টি উপায়!
একজন নারীর জন্য মিসক্যারেজ সবচেয়ে দুঃখ জনক একটি বিষয়। তাই এই বিষয় টি নিয়ে সব নারীরাই চিন্তিত থাকেন। বিশেষ করে যে সব নারীদের একবার হলেও জীবনে অনিচ্ছাকৃত গর্ভপাত বা মিসক্যারেজ ঘটেছে তাঁরা পুনরায় গর্ভ ধারণ করতে পারবেন কিনা এ বিষয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন। মিসক্যারেজের পর প্রত্যেক নারীদেরই কিছু কমন প্রশ্ন থাকে যেমন, 'আমি কি আবার গর্ভধারণ করতে পারবো?' বা ' আমি কি বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসা করবো?', জানালেন ডক্টর গুরপ্রীত সিং কলরা, মেডিকেল ডিরেক্টর ইন্ডিয়া, এ.আর.টি ফার্টিলিটি ক্লিনিক, একাডেমিক লেকচারার ইউনিভার্সিটি অফ ব্রিস্টল(ইউকে) ফেলো ফ্যাকাল্টি অফ মেডিক্যাল লিডারশিপ এন্ড ম্যানেজমেন্ট(ইউকে)।
ডাক্তার কলরা আরও বলেন , 'মিস ক্যারেজ খুবই কমন একটি ব্যাপার, মিস ক্যারেজের পরে সব নারীরাই সুস্থ সন্তান চান,এবং মিসক্যারেজের পরেও আপনি স্বাভাবিক ভাবেই আর পাঁচ জন নারীর মতনই গর্ভধারণ করতে পারবে,' এর জন্য ছয়টি গুরুত্বপূর্ন বিষয় কে মাথায় রাখতে হবে তিনি বলেন। কি কি সেই গুরুত্বপূর্ন বিষয়? চলুন জেনে নিই
আরও পড়ুন,এই গরমে কালোজাম খান, শরীর থেকে সারা জীবনের জন্য পালাবে ১২ টা রোগ
আরও পড়ুন,ঘুরতে গিয়ে হঠাৎ অসুস্থ হওয়ার ভয়? ব্যাগে রাখুন ঘরোয়া প্রতিকারের ওষুধ গুলো
১)সমস্যা টি কি বুঝতে হবে
অনেক নারীরা আছেন যাদের মিস ক্যারিজ হয়েছে, তাঁরা ভয় পান যে তাঁরা আর বোধয় গর্ভধারণ করতে পারবেন না এবং একবার মিসক্যারেজ হওয়া মানে পরের গর্ভ ধারন গুলির সম্ভাবনাও নষ্ট হয়ে যাওয়া। কিন্তু ডক্টর কলরার মতে, একবার গর্ভনষ্ট হওয়া মানে এই নয় যে আপনি একটি পূর্ণ ও স্বাভাবিক গর্ভ ধারণ করতে পারবেন না।
গর্ভাবস্থার প্রথম অবস্থায় যদি মিসক্যারেজ হয় তবে 'ক্রোমোজোমাল অ্যবনর্ম্যলিটিস' এর কারনে হয়, যেটা একজন নারীর দেহের গর্ভধারণ ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে না। শতকরা ১% বা ২% নারী দের ক্ষেত্রে ২ বার পরপর মিসক্যারেজ এর ঘটনা দেখা যায়। মোট গর্ভধারিনী মহিলা দের মধ্যে ২০% মিসক্যারেজ লক্ষ্য করা যায়। জাদেরমধ্যে অনেকেরই পরপর দুবার গর্ভ নষ্ট হয়েছে। এই ধরনের মহিলা দের ক্ষত্রে মিসক্যারেজের সম্ভাবনা ২৮% বেড়ে যায়, কিন্তু তার পরেও ৭২% সম্ভাবনা থাকে স্বাভাবিক ভাবে গর্ভধারণের। এই সমস্যা টি বুঝতে পারলেই এটি গর্ভপাত সম্পর্কিত সব ধরনের মানসিক দুশ্চিন্তা কে কমিয়ে দেবে যার ফলে আবার গর্ভধারণের জন্য নিজের মন কে প্রস্তুত করা অনেক সহজ হবে, জানালেন ডক্টর কলরা।
২) কিছু টা সময় দিন নিজে কে
গর্ভপাত বিষয় টি একজন মহিলা কে শারীরিক ও মানসিক ভাবে খুবই বিপর্যস্ত করে তোলে। তাই এই ধরনের অভিজ্ঞতার পরে নিজের যত্ন নিন এবং বেশি করে বিশ্রাম নিন। যখন কয়েক মাস পর শরীর নিজের স্বাভাবিক ছন্দে ফিরে আসবে, তারপরেও কিছু টা সময় নিন এবং তারপর গর্ভধারণের জন্য চেষ্টা করতে পারেন।
৩) শারীরিক কারণ
ডাক্তার রা পরামর্শ দেন, একটি মিসক্যারেজের পর অন্তত ৩ মাস অপেক্ষা করার বা একটি পূর্ণ মাসিক সাইকেল সম্পুর্ন হওয়ার পর গর্ভধারণের চেষ্টা করতে। মিসক্যারেজের দু সপ্তাহ পর 'অভ্যুলেশন' শুরু হয় কিন্তু এ সময় শরীর প্রায় ২-৩ মাস অবধি সময় নেয় স্বাভাবিক ও নিয়মিত ভাবে ঋতুচক্র হওয়ার জন্য। 'এছাড়াও এইচ.সি.জি হরমোন ই বিষয়ে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়, মিসক্যারেজের পর এই হরমোন টি নিজের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতেও ২-৩ মাস সময় নেয়, তাই এর আগে যদি কেউ কনসিভ করতে চেষ্টা করেন তালে সেটা 'ফলস প্রেগন্যান্সি' হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।এই হরমোনল লেভেলের পতন এর চিকিৎসা করাতে গেলেও মিসক্যারেজের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়।
কিছু গর্ভপাতের জন্য চিকিৎসা বা অস্ত্রোপচার সহায়তার প্রয়োজন যেমন প্রসারণ বা ডায়েলেশন এবং কিউরেটেজ (D&C)। আপনি যদি গর্ভপাতের চিকিৎসার মধ্য দিয়ে যান তবে আপনার শরীর কে নিজের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে আরও সময় নেয় এবং আপনি আবার গর্ভধারণের চেষ্টা করার আগে আপনাকে আরও অপেক্ষা করার পরামর্শ দেওয়া হয়।
৪)মানসিক কারণ
“যখনই এটা ঘটুক না কেন, গর্ভপাত একজন দম্পতিকে আবেগপ্রবণ করে তোলে। দুঃখ, ক্রোধ এবং এমনকি অপরাধবোধের তীব্র অনুভূতি হয় এই সময়। কিন্তু একটি অনাগত শিশুর ক্ষতির প্রতিক্রিয়া করার কোন "স্বাভাবিক" উপায় নেই। কিছু গর্ভপাত কয়েক ঘন্টার মধ্যে ঘটে, অন্যগুলি কয়েক দিন বা এমনকি সপ্তাহও নিতে পারে। স্বাভাবিকভাবেই, এগুলি একজন দম্পতির কাছে মানসিক ভাবে মেনে নেয়া অত্যন্ত কঠিনএবং মানসিক ভাবে এই পরিস্থিতি থেকে নিজে কে পুনরুদ্ধার করতে অনেক মাস সময় নিতে পারে,” ডাঃ কালরা বলেছেন। তিনি আরও বলেন 'যদিও আপনি একটি সন্তান চান, মানসিকভাবে প্রস্তুত হওয়ার আগে গর্ভধারণের জন্য তাড়াহুড়ো করবেন না। গর্ভপাত থেকে মানসিকভাবে পুনরুদ্ধার করার জন্য কোন নির্দিষ্ট সময় নেই, কারণ এটি একটি খুবই দুর্বল মুহূর্ত। মানসিক চাপ এবং নেতিবাচক আবেগ মুক্ত থাকা আপনার ভবিষ্যতের গর্ভাবস্থায় আরও ভাল প্রভাব ফেলবে।
৫) অন্তর্নিহিত সমস্যার চিহ্নিতকরণ
'আপনার যদি একের অধিক মিসক্যারেজ হয়ে থাকে তবে ফুল বডি চেকআপ করানো দরকার, এর পিছনে গভীর কোনো সমস্যা আছে কিনা তা জানার জন্য। যেমন ডায়াবেটিস, পিসিওএস, অটোইমিউন কন্ডিশন, থাইরয়েড এগুলি রোগ গর্ভপাতের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। খুব তাড়াতাড়ি যদি এগুলি ধরা পড়ে এবং চিকিৎসা শুরু করা যায় তালে আপনিও একটি সুস্থ সুন্দর সন্তানের জন্ম দিতে পারবেন।' বলেন ডক্টর কলরা
৬)হেলদি লাইফ স্টাইল মেন্টেন
একটি স্বাস্থ্যকর গর্ভাবস্থার জন্য জীবনধারা পরিবর্তন গুরুত্বপূর্ণ। একটি সুষম খাদ্যতালিকা রাখতে হবে যাতে শাক-সবজি, ডাল, ফলমূল এবং আয়রন সমৃদ্ধ খাবার থাকে, এগুলি শরীরে প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ করে। এর পাশাপাশি প্রতিদিন অন্তত আট গ্লাস জল পান করুন।
ধূমপান, অ্যালকোহল সেবন বা বিনোদনমূলক ওষুধ আপনার গর্ভধারণকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারে। এই অভ্যাসগুলি এড়িয়ে চলুন এবং আপনার ক্যাফেইন গ্রহণের পরিমাণ প্রতিদিন 200mg এর কম সীমাবদ্ধ করুন। আপনার রুটিনে হালকা থেকে মাঝারি ব্যায়াম অন্তর্ভুক্ত করুন। এর মধ্যে হাঁটা, যোগব্যায়াম বা জগিং অন্তর্ভুক্ত। শারীরিকভাবে খুব বেশি জোরালো বা কঠোর কোনো কিছু এড়িয়ে চলাই ভালো। চরম ব্যায়াম আপনার 'অভ্যুলেশন' ক্ষমতাকে বাধা দিতে পারে।
এছাড়াও নিজের মন কেও ভালো রাখার চেষ্টা করুন মেডিটেশন বা ধ্যান করুন এবং জার্নাল পড়ুন মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করুন। এছাড়াও আপনাকে ফলিক অ্যাসিডের ওষুধ নেয়ার পরামর্শ দেওয়া হবে কারন এটি শিশুর মধ্যে যে কোনোরকম জন্মকালীন ত্রুটি কে প্রতিরোধ করে।
৭)নিয়মিত শারীরিক পরীক্ষা করান
আপনি যখন গর্ভধারণের চেষ্টা করছেন, বিশেষ করে গর্ভপাতের পরে আপনার ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্টগুলি মেনে চলা গুরুত্বপূর্ণ। আপনার OB-GYN বিশেষজ্ঞ আপনার গর্ভাবস্থা হারানোর পরে সঠিক পদক্ষেপের জন্য আপনাকে গাইড করবেন। আপনি যদি বন্ধ্যাত্বের জন্য কোনো অতিরিক্ত চিকিৎসা খুঁজছেন তাহলে তারা আপনাকে পরামর্শ দিতে পারে।
যদি আপনার গর্ভপাত বা পরবর্তী গর্ভধারণের বিষয়ে আপনার কোন উদ্বেগ থাকে, তাহলে আগে থেকেই আপনার ডাক্তারের সাথে আলোচনা করুন। আপনার চিকিৎসা ইতিহাসের উপর নির্ভর করে, তারা কিছু ওষুধ লিখে দিতে পারে যা আপনার গর্ভধারণের সম্ভাবনাকে উন্নত করতে পারে। যদি আপনার একাধিক গর্ভপাত হয়, তবে তারা কারণগুলি বোঝার জন্য কিছু পরীক্ষার পরামর্শও দিতে পারে।
৮) অভ্যুলেশনের সময় কে শনাক্তকরণ
অভ্যুলেশন বা ডিম্বস্ফোটনের কাছাকাছি সময় আপনার সহবাস করলে আপনাকে গর্ভবতী হওয়ার আরও ভাল সুযোগ করে দেয়। ডিম্বস্ফোটন পূর্বাভাসকারী কিট বা OPK ব্যবহার করে, আপনি কখন ওভুলেট করবেন তা অনুমান করতে পারেন। এই কিটগুলি শরীরে লুটিনাইজিং হরমোনের বৃদ্ধি সনাক্ত করে কাজ করে, যা ডিম্বস্ফোটনের একটি সূচক। গর্ভাবস্থার জন্য চেষ্টা করার সর্বোত্তম সময় হল হরমোন বৃদ্ধির পর।
'তবে, গর্ভপাতের পর নিয়মিত মাসিক শুরু হওয়ার পরেই কিটটি ব্যবহার করা ভাল। যদিও আপনি তার আগে অভ্যুলেট করেন, আপনার শরীরের বিভিন্ন হরমোনের মাত্রা গর্ভধারণ এবং গর্ভাবস্থায় জটিলতার সৃষ্টি করে। একইভাবে, সপ্তাহে প্রায় 2-3 বার নিয়মিত সহবাসের অভ্যাস করা, আপনাকে গর্ভবতী হওয়ার সম্ভাবনা কে বাড়িয়ে দেয়,' ডাঃ কালরা পরামর্শ দেন।